শোকার্ত: সন্তানকে হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন জুলফিকারের মা। ছবি: নিজস্ব চিত্র
বোমাকে বল ভেবেছিল বছর আটেকের শিশু তিনটি। খেলতে গিয়ে সেই বোমা ফেটে গত মঙ্গলবার গুরুতর জখম হয়েছিল তারা। পাঁচদিন চিকিৎসা চলার পর রবিবার মৃত্যু হল একটি শিশুর। অন্য দু’জন এখন আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে।
জীবনতলা থানার ঘুটিয়ারিশরিফ ফাঁড়ির হাসপাতাল রোড এলাকায় গত মঙ্গলবার এই বিস্ফোরণ হয়। আহতদের তড়িঘড়ি প্রথমে স্থানীয় ব্লক প্রাথমিক হাসপাতাল ও পরে সেখান থেকে কলকাতায় স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে জুলফিকার লে (৮) নামের শিশুটির এ দিন মৃত্যু হয়েছে কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। মোহিত শেখ ও রোহিত শেখ নামের দুই শিশুর অবস্থাও গুরুতর বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
রবিবার দুপুরে জুলফিকারের মৃত্যুর খবর এলাকায় পৌঁছতেই সেখানে নেমে আসে শোকের ছায়া। কান্নায় ভেঙে পড়েন জুলফিকারের মা বেবি লে। ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে কার্যত বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি। তাঁর মুখে শুধু একটাই কথা, “দোষীদের শাস্তি চাই।’’ একই অবস্থা জুলফিকারের বাবা জুম্মান লে’রও। ছেলের মৃতদেহ বাড়ি নিয়ে আসার জন্য কলকাতার হাসপাতালে রয়েছেন তিনি। ফোনে বলেন, “যাদের জন্য আমার সন্তানকে এ ভাবে কষ্ট পেয়ে অকালে মরতে হল তাদের শাস্তি চাই।’’ এ দিন ছেলের মৃত্যুর খবর এসে পৌঁছতেই ঘুটিয়ারি শরিফের ভাড়া বাড়ি ছেড়ে জীবনতলা থানার মটেরদিঘিতে নিজেদের বাড়িতে বাকি তিন সন্তানকে নিয়ে রওনা দেন বেবি।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, গত মঙ্গলবার দুপুর ৩টে নাগাদ বাড়ির পিছনে খেলা করছিল তিন শিশু। সেখানেই বোমা শুকোতে দিয়েছিল বাড়ির মালিক রাজ্জাক শেখ। বোমাগুলিকে বল ভেবে খেলতে গিয়ে বিস্ফোরণ হয়। আর সেই বিস্ফোরণেই গুরুতর জখম হয় তিন শিশু। ঘটনার খবর পেয়ে ঘুটিয়ারি শরিফ ফাঁড়ির পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে ব্যাগ ভর্তি বোমা উদ্ধার করে। এই ঘটনায় বাড়ির মালিক রাজ্জাক শেখকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
ঘুটিয়ারি শরিফ শিয়ালদহ রেল লাইনের পাশে হাসপাতাল রোড এলাকায় একটি বাড়ি রয়েছে রাজ্জাকের। সেই বাড়িতে বেশ কয়েকটি ভাড়া ঘর রয়েছে। সেই ভাড়া ঘরেই পরিবারের সঙ্গে থাকত এই শিশুগুলি। দুপুরে খাওয়ার পর যখন বাড়ির সকলে ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ওই সময় শিশুরা বোমাকে বল ভেবে খেলতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে।
কিন্তু বাড়িতে কেন বোমা মজুত রেখেছিল রাজ্জাক? পুলিশের দাবি, এলাকায় নানা সমাজবিরোধী কাজের সঙ্গে যুক্ত সে। তবে কী কারণে সে বোমা মজুত রেখেছিল তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
যদিও এই ঘটনায় এলাকায় নতুন করে তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দল প্রকাশ্যে চলে এসেছে। এলাকার তৃণমূল নেতা তথা বাঁশড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য মোবারক সর্দার বলেন, “পঞ্চায়েতের উপপ্রধান আবুল কাশেম সর্দারের মদতেই বাড়িতে বোমা মজুত করেছিল রাজ্জাক। এলাকায় অশান্তি ছড়ানো ও তৃণমূল কর্মীদের উপর হামলার জন্য এই বোমা মজুত করা হয়েছিল। এলাকার যুব তৃণমূল নেতৃত্বের মদতেই বাড়িতে বোমা মজুত রেখেছিল অভিযুক্ত।’’ যদিও এই ঘটনার পিছনে কোনও রাজনীতি নেই বলেই দাবি করেছেন কাশেম।
তিনি বলেন, “যে কোনও মৃত্যুই দুঃখজনক। আমরা ওই পরিবারের পাশে আছি। এই ঘটনার পিছনে কোনও রাজনীতি নেই। যার বাড়িতে ঘটনাটি ঘটেছে সেই রাজ্জাক শেখ একজন সমাজবিরোধী। নানা অসামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত সে। পুলিশ ঘটনার তদন্ত করে দোষীদের গ্রেফতার করুক।’’ এই ঘটনার পিছনে গোষ্ঠীকোন্দলের কথা মানতে চাননি বাঁশড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতি বিজন মণ্ডল। তিনি বলেন, “খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। এই ঘটনায় যে বা যারা জড়িত তাদের কঠোর শাস্তি দাবি করছি। তবে এই ঘটনায় কোনও তৃণমূল কর্মী জড়িত নয়। অতীতে এই এলাকায় অনেক অশান্তি থাকলেও বর্তমানে এই এলাকা অনেক শান্ত। তৃণমূল নেতৃত্ব এলাকায় শান্তি বজায় রেখেছে।’’
দুর্ঘটনার পরেই গত বুধবার এলাকার বিধায়ক শ্যামল মণ্ডল, জেলা পরিষদের সদস্য তথা কর্মাধ্যক্ষ শৈবাল লাহিড়ী যান জখম শিশুদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে। তাদের চিকিৎসার জন্য পরিবারগুলিকে আর্থিক সাহায্যও করেন তারা। এ বিষয়ে বিধায়ক বলেন, “আমরা ওই শিশুদের পরিবারের পাশে আছি। সকলের চিকিৎসা যাতে ঠিকঠাক ভাবে হয় সে দিকে আমরা নজর রাখছি। তবে আজ সকালে একজনের মৃত্যু হয়েছে। এই ঘটনার পিছনে যে বা যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পুলিশ প্রশাসনকে।’’
দলমত নির্বিশেষে যাতে পুলিশ দোষীদের গ্রেফতার করে সেই দাবি তুলেছেন এলাকার সাধারণ মানুষও। এলাকার বাসিন্দা রানি শেখ, হাসিনা বিবিরা বলেন, “আমরাও চাই দোষীদের শাস্তি হোক। যে ভাবে এক মায়ের কোল খালি হল সে ভাবে যেন কোনও সন্তানকে অকালে মরতে না হয়।’’