এ ভাবেই মাচার উপর বসে থাকেন প্রার্থী-সহ অন্যান্যরা।—নিজস্ব চিত্র।
দিন-রাত গুলতানি আর চা-পান-বিড়ি ধংসের সংস্কৃতিটা বাঙালির প্রায় রক্তে আছে বললে খুব একটা ভুল বলা চলে না। কিন্তু মাচায় বসে গুলতানি করার জন্য যদি দিনে ২০০ টাকা মেলে, তা-ই বা মন্দ কী। আর চা-পান-ডিম-কলা তো পুরো নিখরচায়!
বসিরহাট মহকুমার বাদুড়িয়া ব্লকে পঞ্চায়েত, পুরসভা, বিধানসভা, লোকসভা— যে কোনও ভোট এলেই শুরু হয়ে যায় পাড়ায় পাড়ায় বাঁশের মাচা বাঁধার কাজ। সেই মাচায় আড্ডা জমান বিভিন্ন রাজনৈতিক শিবিরের মানুষজন। মাচায় ভিড় যার বেশি, জনসমর্থন সে দিকেই ঢলে, এমনটাই এখানকার প্রচলিত ধারণা। সন্ধে হলেই মাচা ভরে যায় ভিড়ে। আলোচনা-সমালোচনায় উত্তাপ বাড়ে। বাড়ে চা, বিস্কুট, সিঙ্গাড়া, পান, মুড়ি খাওয়ার ধুম। ভোর রাত পর্যন্ত চলে মাচার আড্ডা। প্রার্থীরা যে যাঁর মাচার লোকজনের সঙ্গে ঘুরে ফিরে দেখা করে যান। সব মিলিয়ে ভোট এলে রীতিমতো উৎসবের চেহারা নেয় বাদুড়িয়া।
১৭টি ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেল, শ’পাঁচেক মাচা তৈরি হয়েছে। সব দলের প্রার্থীদেরই মাচা আছে। বাঁশ চেরাই করে চটা তৈরি হয়। সেই চটা পাশাপাশি সাজিয়ে তৈরি হয় মাচা। মাটিতে পোঁতা খুঁটির উপরে ফেলা হয় চটা। কাদের কোন মাচা, তা চিনতে মাচার উপরে কিংবা চার পাশে লাগিয়ে দেওয়া হয় সেই দলের পতাকা। প্রার্থীর কাট আউট।
তারাগুনিয়ার ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে ২৫৫ নম্বর বুধ এলাকায় গিয়ে নজরে পড়ল, রাস্তার এক পাশে তৃণমূল এবং অন্য পাশে সিপিএম ও কংগ্রেসের মাচা সেজেছে। চার পাশে ঝুলছে অসংখ্য পতাকা, প্রার্থীদের কাট আউট। রুদ্রুপুর, আড়বালিয়ার মতো বিভিন্ন এলাকায় একই চিত্র।
কিন্তু ক্লাব, পার্টি অফিস থাকতে কেন মাচায় বসায
প্রশ্ন করতেই স্থানীয় একটি ক্লাবের সদস্য আরিফ বিল্লা, এসাদুর জামানরা বলেন, ‘‘আমাদের এখানে ক্লাব ঘরে বসে রাজনীতির চল নেই। তাই ভোট এলে মাচা তৈরি হয়। তা ছাড়া, মাচায় বসলে ডিম, কলা, লাড্ডুর পাশাপাশি মাঝে মধ্যে মুরগির ঝোলও মেলে।’’ তবে দলের ক্ষমতা অনুসারে টিফিন মেলে বলে জানালেন তাঁরা।
কথা বলার ফাঁকে সেখানে এসে পৌঁছলেন সিপিএমের এক প্রার্থী। দলবল নিয়ে সাত সকালে বেরিয়ে ছিলেন প্রচারে। মাচায় বসে বিশ্রাম নেওয়ার ফাঁকে জানালেন, এখানে ‘মাচা কালচার’ বহু দিনের। মাচায় বসা মানুষের ভিড় বলে দেয় প্রার্থীর বর্তমান অবস্থা। তবে সেই ভিড় ধরে রাখতে খরচ বেশ ভারি হয়ে পড়ে প্রার্থীদের কাছে। এক একজনকে ৫০ থেকে শুরু করে ২০০ টাকা পর্যন্ত রোজ দিতে হয়। এরপরে আছে টিফিন খরচ। সমর্থকদের আবদার মেটানো। সব মিলিয়ে দিনে তো ২-৪ হাজার টাকা খরচ হবেই। যা টানতে না পেরে অনেক প্রার্থীই মাঝ পথে রণে ভঙ্গ দেন বলেও জানালেন তিনি। তখন সেই প্রার্থীর লোক চলে যায় অন্য দলে, অন্য মাচায়।
তৃণমূল, কংগ্রেস এবং বিজেপি প্রার্থীরা অবশ্য সরাসরি স্বীকার করতে চাইলেন না মাচার কথা। কেউ কেউ বললেন, ‘‘আসলে দলীয় কর্মীরা দিনভর পরিশ্রম করে একটু বিশ্রাম নিতে মাচা তৈরি হয়। তবে যতটা বলা হয়, মাচা চালাতে খরচ তত নয়। তবে হ্যাঁ, টিফিন-সহ কিছু খরচ তো হয়ই।’’ বাদুড়িয়া ঘুরে তৃণমূল এবং সিপিএমের মাচাই বেশি চোখে পড়ল। তবে কংগ্রেস, বিজেপি এমনকী, নির্দল প্রার্থীরও মাচা আছে। ওয়ার্ড-পিছু এক একটি দলকে ১০-১২টি পর্যন্ত মাচা সাজাতে দেখা গেল।
তৃণমূলের খগেন মণ্ডল, ফজলু রহমান, সিপিএমের নাসিরউদ্দিন মণ্ডল, কংগ্রেসের আক্রম খাঁ ও রতন বৈদ্যরা বললেন, ‘‘ভোট এলেই আমাদের এলাকা যেন একটা উৎসবের চেহারা নেয়। পাড়ায় পাড়ায় মাচা তৈরির ধুম পড়ে যায়। ভোটের পরে প্রার্থীরা তাঁদের প্রতিশ্রুতি রাখুন না রাখুন— ভোটের আগে ক’টা দিন মাচায় থাকা মানুষগুলোকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার সাহস করেন না কেউ। কারণ, সকাল-সন্ধ্যা ভালমন্দ টিফিন না পেলে এক মাচার লোক অন্য মাচায় চলে যেতে পারে।’’ তবে মাচার লোকেদের মধ্যে ঝুটঝামেলা হয় না বলেও দাবি করলেন সকলে।
আক্তারউল খান, বিপিন মণ্ডল, খগেন পাত্র, আইজুল মোল্লাদের মতো বাসিন্দারা জানালেন, ‘‘মাচায় বসে কর্মীদের ভোটের ডিউটি ভাগ করা হয়। দলের ক্ষমতা অনুসারে এক এক জনের এক এক রকম ‘মজুরি’ দেওয়া হয়। তবে ইদানীং কেউ ২০০ টাকার কম রোজে মাচায় বসতে চায় না। এক দলের লোক যাতে অন্য দলে যেতে না পারে, সে জন্য এই খরচ করেন সব প্রার্থীই। কর্মীদের ধরে রাখতে রাতভর জেগে পালা করে পাহারা দেওয়া হয়। ভোটারদের বাড়িতে কেউ যাতে উপঢৌকন পৌঁছে দিতে না পারে, সে দিকটাতেও লক্ষ রাখা হয়। ভোটের দিন ওই মাচাতেই বুথ বসানো হয়।