গোসাবায় ‘দুয়ারে ত্রাণ’-এর জন্য আবেদন সংগ্রহ করতে বিডিও অফিসে ড্রপ বক্স রাখা হয়েছে (বাঁ দিকে)। নিজস্ব চিত্র। পাথরের কুয়েমুড়ি গ্রামে ফ্লাড শেল্টার থেকে ক্ষতিপূরণের ফর্ম দেওয়া হচ্ছে (ডান দিকে)। নিজস্ব চিত্র।
ইয়াসের জলোচ্ছ্বাসের মতোই উপচে পড়ছে ক্ষতিপূরণের আবেদনপত্র।
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, রবিবার পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের চেয়ে আবেদনপত্র জমা পড়েছে কমবেশি এক লক্ষ ৭১ হাজার। সংখ্যা দেখে চোখ কপালে ওঠার মতো অবস্থা প্রশাসনের কর্তাদের। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের সংখ্যা এত বেশি নয় বলে মনে করেন তাঁরা। আগামী শুক্রবার পর্যন্ত আবেদনপত্র জমা নেওয়া হবে। আধিকারিকদের বড় অংশের ধারণা, আবেদনকারীর সংখ্যা দুই লক্ষ পেরবে।
এই বিশাল সংখ্যক আবেদনপত্র কী ভাবে খতিয়ে দেখা হবে, তা নিয়ে চিন্তায় ব্লক স্তরের আধিকারিকেরা। প্রশাসনের কড়া নির্দেশ, সরেজমিনে তদন্ত না করে কাউকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া যাবে না। আধিকারিকদের একাংশ মনে করছেন, ক্ষয়ক্ষতি না হলেও স্রেফ ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশায় আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন বহু মানুষ। যাচাই করে দেখলেই তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। কিন্তু সমস্যা হল, এই বিশাল সংখ্যক আবেদনপত্র খতিয়ে দেখার মতো সরকারি কর্মীর অভাব রয়েছে জেলায়।
প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, ‘‘বাড়ি ভেঙেছে দাবি করে যাঁরা ক্ষতিপূরণ চেয়েছেন, তাঁদের আবেদন খতিয়ে দেখার জন্য হুগলি থেকেও অনেক সরকারি কর্মীকে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় পাঠানো হবে। এই মর্মে নির্দেশ জারি হয়েছে নবান্ন থেকে। তেমনই, উত্তর ২৪ পরগনায় যাবেন নদিয়া জেলার অনেক কর্মী-অধিকারিক। পূর্ব মেদিনীপুরে যাবেন বাঁকুড়া জেলার অনেক কর্মী ও আধিকারিক। তদন্তের সময় আবেদনকারীর বাড়ির ছবি তোলা হবে।’’
প্রশাসন সূত্রে খবর, কাকদ্বীপ এবং সাগর ব্লক থেকে ২০ হাজারের বেশি ক্ষতিপূরণের আবেদনপত্র জমা পড়েছে রবিবার পর্যন্ত। গোসাবা, নামখানা ও কুলতলি থেকেও প্রচুর মানুষ ক্ষতিপূরণ চেয়ে আবেদন করেছেন। গোটা জেলাজুড়ে প্রচুর ভুয়ো আবেদনপত্র জমা পড়েছে বলে আশঙ্কা করছেন আধিকারিকদের একাংশ। শিবির হচ্ছে দেখে অনেকেই ক্ষতিপূরণের আবেদন করেছেন। এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘‘পেলে ভাল না পেলেও ক্ষতি নেই— এই ভাবনা থেকে বহু মানুষ ক্ষতিপূরণ চেয়ে আবেদন করেছেন।’’
জেলার উপকূলবর্তী একটি ব্লকের বিডিও বলেন, ‘‘আমার ব্লকে যত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে আমাদের কাছে খবর, তার থেকে অনেক বেশি মানুষ ক্ষতিপূরণ চেয়ে আবেদন করেছেন। আমি এমন কয়েকটি গ্রামের কথা জানি, যেখানে ইয়াসের দিন জল ওঠেনি। অথচ, সেই গ্রামের অনেকে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন। তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেই তা বুঝতে পেরেছি।’’
আমপানে ক্ষতিপূরণ দেওয়া নিয়ে দুর্নীতির ভুরি ভুরি অভিযোগ এসেছিল এই জেলায়। শাসক দলের পঞ্চায়েত ও ব্লক স্তরের জনপ্রতিনিধিদের একাংশের বিরুদ্ধে টাকা লুটের অভিযোগ তুলেছিল বিরোধীরা। এক আধিকারিক বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কড়া নির্দেশে ইয়াসে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কোনও সুযোগ নেই। গোটা প্রক্রিয়াই পরিচালিত হবে প্রশাসনিক কর্তাদের নির্দেশে।’’ এতেই চিন্তার মেঘ ঘনিয়েছে প্রশাসনে।
এক বিডিও-র কথায়, ‘‘সবাইকে দিয়ে তদন্ত সম্ভব নয়। এই কাজের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত আধিকারিক। কিন্তু অত আধিকারিক পাব কোথায়।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘আবেদনকারীর সংখ্যা খুব বেশি হওয়ায় তদন্তের জন্য অনেক সময় প্রয়োজন। অবস্থা এমন যে, দিনে ১২-১৪ ঘণ্টা করে তদন্ত করতে হবে। সব আবেদন খতিয়ে দেখতে হলে কয়েকটি ব্লকে ২০-২৫টি করে দল গড়তে হবে। তুলনায় কম আবেদন এসেছে, এমন ব্লক থেকে কর্মীদের ওই ব্লকগুলিতে পাঠানোর কথা বলা হয়েছে।’’
ব্লকের ‘এক্সটেনশন অফিসার’রাই মূলত আবেদনপত্র সরেজমিনে খতিয়ে দেখার কাজ করবেন।
উপকূলবর্তী আর একটি ব্লকের বিডিও বলেন, ‘‘এত বেশি আবেদন করার নেপথ্যে আরও একটি কারণ রয়েছে। ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচিতে বহু মানুষ উপকৃত হয়েছেন। এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যিনি স্বাস্থ্যসাথীর কার্ডের জন্য আবেদন করে তা পাননি। আবেদন করে অন্য পরিষেবাও পেয়েছেন প্রায় সকলে। ফলে মানুষের মধ্যে প্রত্যাশা জন্মেছে। তাঁরা ভাবছেন, এ বারও ক্ষতিপূরণের আবেদন করলে তা পাওয়া
যাবে।’’
প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, প্রতিটি আবেদনপত্র খতিয়ে দেখা হবে। তাহলে ক্ষতিপূরণ নিয়ে কোনও অভিযোগ আসবে না।