তর্কশাস্ত্রে যার কোনও হদিশ মেলে না, দোর্দণ্ডপ্রতাপ পণ্ডিত ব্রজনাথ তারই সন্ধান পেলেন ভক্তিতে। কিন্তু তর্কশাস্ত্রের বুৎপত্তি থেকেই বুঝলেন, ভক্তির একটি বিগ্রহ প্রয়োজন। কেবল পুথির পাতায় তার স্থান অকুলান।
সেই বিগ্রহ প্রথাগত হলেও তো চলে না। প্রয়োজন এমন একটি মূর্তি, যা নিমেষমাত্র বশ করে দিতে পারে। যা ধরে রাখতে পারে আগ্রহ আজীবন। সেই বিগ্রহ তৈরি করতেও দরকার নতুন হাত। নতুন মন। তাজা চেতনা।
চরম অস্থিরতার মধ্যে রাত কাটিয়ে সকাল হতেই ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন ছুটে গেলেন পাশেই রামসীতা পাড়ার বিহারী কুম্ভকারের বাড়িতে। সাতসকালে বাড়ির দরজায় ব্রজনাথ পণ্ডিতকে দেখে বিহারী কী করবে ভেবে পায় না। সব শুনে বিহারী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন পণ্ডিতমশাইয়ের দিকে। কিছুই বুঝতে পারছেন না তাঁর কথা। শেষে হাতজোড় করে বললেন, “আমরা তিন পুরুষের হাঁড়ি-কলসি গড়ার কুমোর। কোনও দিন অন্য কিছু তৈরি করিনি। আমি জানি না কী ভাবে মাটি দিয়ে মূর্তি তৈরি হয়। আমি কী করে বিগ্রহ গড়ব? ” অনড় ব্রজনাথ বার বার বলতে থাকেন, “একথা তাঁরই। আমি কেবল তাঁর নির্দেশের বাহক মাত্র।”
বড় বিচলিত বোধ করছেন বিহারী। আজীবন হাঁড়িকুড়ি গড়ে এসে এই বৃদ্ধ বয়সে এ কী পরীক্ষা। কী করে কী করবেন সারা দিন আকাশপাতাল ভেবে চলেছেন।
অঘ্রাণের বেলা। দুপুর গড়ালে হঠাৎ করেই যেন সন্ধ্যা নেমে আসে। পড়ন্ত বিকেলে পনে পোড়ানো মাটির ভাঁড়, হাঁড়ি জড়ো করছিলেন প্রবীণ বিহারী পাল। কিছুটা অন্যমনস্ক। গোটা নদে জেলা জুড়ে মাটির হাঁড়ি-কলসি-কুয়োর পাট তৈরিতে তাঁর খ্যাতি ছড়ানো। কাজের ব্যাপারে বড় খুঁতখুঁতে মানুষটি। মাটি মাখা থেকে চাকে ঘোরানো কিংবা পনে লাল টকটকে করে পোড়ানো পর্যন্ত প্রতিটা কাজ নিজের হাতে না করলে শান্তি পান না বিহারী। কিন্তু সকালে বিদ্যারত্ন মশাই চলে যাওয়ার পর থেকেই বিহারীর কানে কেবল তাঁর বলে যাওয়া কথাগুলোই বাজছে। বড় অদ্ভুত কথা বলে গিয়েছেন স্মৃতি এবং নব্যন্যায় শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ব্রজনাথ, “... বিহারী, তোমাকে এমন একটি মূর্তি গড়ে দিতে হবে, যা রাধারানির মতো কিন্তু পুরুষ দেহধারী।”
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই সন্ধ্যা নেমে এলো। হঠাৎ কে যেন তাঁর নাম ধরে ডাকল। তাকিয়ে দেখেন সদর দরজা পার করে কুমোর বাড়ির প্রশস্ত উঠোন দিয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে এক জ্যোতির্ময় কিশোর। দিব্যকান্তি, গৌরবর্ণ, সুগঠিত দেহ। বিহারীর কেমন যেন ঘোর লেগে গেল। কোনও কথা বলার আগেই সেই পরম রূপবান কিশোর বলে উঠল, “বিদ্যারত্ন মশাই আমাকে পাঠিয়েছেন। তিনি যে মূর্তির কথা বলেছেন, সেটি হবে আমারই মতো।” বিহারী সম্মোহিত। কিশোর বলে চলে, “আমাকে দেখ। আমাকে ভাল করে দেখে মাপ নিয়ে নাও।” বলে এক বিশেষ ভঙ্গিতে বিহারীর সামনে দাঁড়াল সে। ভঙ্গিতে নাচের মুদ্রা। বিহারী কুম্ভকার মন্ত্রমুগ্ধের মতো পাটের দড়ি দিয়ে যুবকের দেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গের মাপ নিতে লাগলেন। আর গিঁট দিয়ে চিহ্নিত করে চললেন সেই মাপগুলি।
এক সময়ে মাপ নেওয়া শেষ হল। যুবক বিহারীর কাছে মুড়ি খেতে চাইলেন। সম্বিত ফিরে পেয়ে বিহারী ছুটলেন বাড়ির ভিতর। মুড়ি জল এনে দেখেন উঠোনে কেউ নেই। কিশোর অন্তর্হিত। অন্ধকার নেমে এসেছে চারপাশে। বিষণ্ণ বিহারী ক্ষণ মাত্র নষ্ট না করে ছুটে গেলেন ব্রজনাথের কাছে। সব শুনে ভারতবিখ্যাত স্মার্ত পণ্ডিতের চোখের জল বাঁধ মানলো না। বিহারীর হাত নিজের মাথায় বার বার ভক্তি ভরে ঠেকিয়ে বলতে লাগলেন, “বিহারী তুমি ধন্য। তুমি তাঁর শ্রীঅঙ্গের পরশ পেয়েছো। স্বয়ং তাঁকে প্রত্যক্ষ করেছো। তিনি চৈতন্য মহাপ্রভু। আমি তোমাকে তাঁর মূর্তি নির্মাণের জন্য বলেছিলাম।”
বিহারী পাল পরের মাস চারেকের মধ্যেই অনায়াস দক্ষতায় তৈরি করলেন নৃত্যরত চৈতন্যের মৃন্ময় মূর্তি বা নাটুয়া গৌর। ইতিহাস বলে ১৮৬৫ সালে বৈশাখী পূর্ণিমার দিন ওই মূর্তি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল মথুরানাথের টোল বাড়িতে।
বিগ্রহের বর্তমান সেবাইত মহানাম সম্প্রদায়ের বিবেকবন্ধু ব্রহ্মচারী বলেন, “এই কাহিনি শুধুই কল্পনা নয়। নাটুয়া গৌর নিয়ে যেখানে যা কিছু লিখিত ইতিহাস রয়েছে, তাতে সর্বত্রই একই ভাবে বলা হয়েছে এই বিগ্রহের প্রতিষ্ঠার কাহিনি।” কিন্তু সে সত্য হোক বা না হোক, চৈতন্য পরবর্তী গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে নাটুয়া গৌর বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা বলেই মনে করা হয়। কেননা বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী পূজিত নবদ্বীপের ‘ধামেশ্বর মহাপ্রভু’ এবং মণিপুর রাজকন্যা বিম্বাবতী দেবী প্রতিষ্ঠিত ‘অনু মহাপ্রভু’ মূর্তির পর নাটুয়া গৌর নবদ্বীপের তৃতীয় মহাপ্রভু বিগ্রহ। কিন্তু প্রথম দুটি বিগ্রহের সেবাপুজো হতো সংশ্লিষ্ট পরিবারের অন্দরমহলে। সাধারণের তাতে কোনও অধিকার ছিল না। সেই দিক থেকে নাটুয়া গৌরই প্রথম বিগ্রহ যা প্রকাশ্যে পুজো শুরু হয়েছিল।
দ্বিতীয়ত, এই বিগ্রহকে ঘিরে ব্রজনাথ এবং তৎপুত্র মথুরানাথ পদরত্ন গড়ে তুলেছিলেন এক বৈষ্ণবীয় আন্দোলন। যা হরিভক্তি প্রদায়িনী সভা বা সংক্ষেপে ‘হরিসভা’ নামে পরিচিতি পায়। সারা দেশ জুড়ে হরিনাম সংকীর্তন প্রচারের সূত্রপাত হিসাবে হরিসভাকে আজও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। তৃতীয়ত, নবদ্বীপের স্মার্ত এবং নব্যন্যায়ের পণ্ডিত সমাজের প্রধান ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন নাটুয়া গৌরের হাত ধরেই নবদ্বীপের বৈষ্ণব পরিমণ্ডলে পা রাখেন।
এখানেই শেষ নয় কাহিনি। কথিত আছে, যে বিহারী পাল ওই মূর্তি গড়ে ছিলেন বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার দিনই তিনি মারা যান। বৈশাখী পূর্ণিমার দিন। বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যস্ত সকলে। মথুরানাথের টোলের একটি ঘরে স্থাপন করা হয়েছে অনুপম সেই বিগ্রহ। লোকে ধন্য ধন্য করছে। বিহারী দাঁড়িয়েছিলেন প্রাঙ্গণের একটি গাছের নীচে। বিগ্রহের সোজাসুজি। ভাবাবিষ্ট। ব্রজনাথ তাঁকে দেখেছেন। কিন্তু ডেকে তাঁর তন্ময়তা ভাঙতে চাননি। সকলের খাওয়াদাওয়ার পরে ব্রজনাথ দেখেন তখনও একই ভাবে দাঁড়িয়ে বিহারী। এ বার তিনি বিহারীর গায়ে হাত দিয়ে ডাকতে গেলেন। বিহারী গড়িয়ে পড়লেন গাছের নীচে। বিস্মিত ব্রজনাথ বুঝলেন বিহারী আর নেই। সেই রাতেই গঙ্গার তীরে দাহ করা হয় বিহারীকে।
এর ঠিক ছ’ বছর পরে মৃত্যু হয় বিদ্যারত্ন মশাইয়ের।
মথুরানাথের সেই টোলবাড়িই আজ নবদ্বীপের হরিসভা মন্দির। যেখানে মহা সমারোহে উদাযাপিত হল নাটুয়া গৌরের দেড়শোতম প্রতিষ্ঠা দিবস।