কামদুনি কাণ্ড অনেকেরই স্মৃতি থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রতীকী ছবি।
দশক ঘুরতে চলল। সরকারি আইনজীবী বদল হয়েছেন এক ডজনেরও বেশি। দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের মাস ছয়েক পরেকার কামদুনি কাণ্ড অনেকেরই স্মৃতি থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। তাই ফের ‘কলকাতা’ আসছে কামদুনি। মনে করিয়ে দিতে। বিচার চাইতে। সঙ্গী এক রাশ ক্ষোভ। এক বার আদিগঙ্গার তীরবর্তী কালীঘাট তো এক বার গঙ্গাপাড়ের নবান্ন। কোনও ‘দূত’ নয়, এ বারেও সরাসরি ‘দিদি’রই দেখা চায় কামদুনি।
কেন?
কামদুনিতে গণধর্ষণের পরে খুন হওয়া কলেজছাত্রীর পরিবার, সহপাঠী, গ্রামের মেয়ে-বৌদের বক্তব্য, দিল্লির নির্ভয়া-কাণ্ডের (২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর) বিচার হয়েছে। দোষীরা সাজা পেয়েছে, তা-ও অনেক দিন হল। তার মাস ছয়েক পরে, ২০১৩ সালের ৭ জুন কামদুনিতে ওই কলেজছাত্রীকে গণধর্ষণ করে খুন করা হয়। নিম্ন আদালত তিন আসামির ফাঁসি এবং অন্য তিন আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া সত্ত্বেও দণ্ডিতদের আপিল মামলা শেষ না-হওয়ায় সেই শাস্তি কার্যকর হয়নি। দশ বছর ধরে আপিল মামলার বিচার চলছে তো চলছেই। কবে হবে দোষীদের শাস্তি, প্রশ্ন কামদুনির।
মৃতার মা রবিবার বলেন, ‘‘কলকাতা হাই কোর্টে এখনও আমার মেয়ের হত্যা মামলা চলছে। অথচ সরকার পক্ষের হয়ে কোনও কৌঁসুলি মামলায় লড়তে চাইছেন না। পাঁচ থেকে ছ’বার এজলাস বদল হয়েছে। মোট ১৪ জন আইনজীবী এই মামলা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। কেন?’’ মৃতার দাদার অভিযোগ, ‘‘সরকারি কৌঁসুলিকে অর্থের প্রলোভনের পাশাপাশি নানা ভাবে ভয় দেখানো হচ্ছে। তাই তাঁরা কামদুনি মামলা থেকে নাম প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন।’’
সরকারি কৌঁসুলি না-দাঁড়ালে যে মামলা চলতে পারে না, সেটাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানাতে চায় কামদুনির গণধর্ষিতা কলেজছাত্রীর পরিবার। শুধু মামলার ক্ষতি বা দেরি নয়, মামলা সংক্রান্ত খবরাখবরও তাঁরা জানতে পারছেন না বলে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দু’বার চিঠি লিখে অভিযোগ করেছেন মৃতার মা। তাঁর কথায়, ‘‘কিন্তু কিছুতেই দিদিকে সে-কথা জানাতে পারছি না।’’
বছর দশেক আগে পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে একটি পরিত্যক্ত জায়গায় টেনে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে দেহ ছুড়ে ফেলা হয় ডিরোজিয়ো কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ওই ছাত্রীর। পরের দিন সকালে এলাকার প্রিয় মেয়েটির ওই হাল দেখে উতরোল কান্নার সঙ্গে গর্জে ওঠে কামদুনি। কলকাতার রাজপথ থেকে দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনেও পাড়ি দেয় গোটা গ্রাম। সেই ছাত্রীর সহপাঠী টুম্পা কয়াল বলেন, ‘‘দশ-দশটা বছর ধরে কোথায়, কার কাছে যাইনি আমরা! মেয়ে-বৌ কারও পক্ষেই কি সংসার, কাজকর্ম ফেলে এ ভাবে ঘোরা সম্ভব! আদালতে যেতে যেতেই বুড়ো হয়ে গেলাম। চোখ খোলা রাখি বা বন্ধ করি, আজও দেখতে পাই ওকে।’’
‘দিদিকে (মমতা) চাই’, ‘দিদিকে সরাসরি বলতে চাই’— এমন আর্জি আগেও করেছে কামদুনি। কামদুনির বধূ মৌসুমী কয়াল এ দিন বলেন, ‘‘কামদুনিতে এসে দিদি বলেছিলেন, এক মাসে চার্জশিট ও দ্রুত সাজা হবে। কত নেতা-মন্ত্রী কামদুনি এসে কত উন্নয়ন, কত কিছু বলে গেল। কোথায় সে-সব! দোষীদের সাজা তো দূরের কথা, প্রতিদিন একের পর এক মহিলা নিগ্রহ, মৃত্যুর কথা শুনতে শুনতে নিজেকেই অপরাধী মনে হয়।’’
আজকাল কথা বলা প্রায় ছে়ড়েই দিয়েছেন মৃতার বাবা। জানালেন, মামলায় সাহায্য করছেন আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় ও শীর্ষেন্দু সিংহ রায়। ওই আইনজীবীরা জানান, কামদুনি গণধর্ষণ ও খুন মামলায় বছর ছয়েক আগে তিন অভিযুক্তকে ফাঁসি এবং তিন জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছিল নগর দায়রা আদালত। সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ২০১৬ সালে কলকাতা হাই কোর্টে আবেদন করেন দণ্ডিতেরা।
ফাঁসির আদেশ পালনের জন্য হাই কোর্টের ‘রেফারেন্স’ বা অনুমতির দরকার হয়। বর্তমানে বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী ও বিচারপতি অজয়কুমার গুপ্তের ঘরে মামলার শুনানি চলছে। পরবর্তী শুনানি ২০ মার্চ। জয়ন্ত বলেন, ‘‘১৪ জন সরকারি আইনজীবী পরিবর্তন হয়েছে। প্রথম সারির সরকারি আইনজীবীরা দাঁড়াতে অনীহা প্রকাশ করেছেন। বেশির ভাগ সরকারি আইনজীবীর সঙ্গে অভিযুক্ত পক্ষ সরাসরি যোগাযোগ করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।’’