প্রতিবেদন: রিঙ্কি, চিত্রগ্রহণ: শুভদীপ, সম্পাদনা: সুব্রত
পড়াশোনার প্রতি ছোট থেকেই প্রবল ঝোঁক। উত্তর ২৪ পরগনার গুমার তারক চন্দ্র দু’চোখে আঁধার নিয়েও স্বপ্ন দেখেছেন আকাশ ছোঁয়ার। কিন্তু স্বপ্ন দেখাটাই তো শেষ নয়, বরং শুরু। দু’চোখে দৃষ্টি নেই, পেটে ভাত নেই। তবু স্বপ্ন দেখা ছাড়েননি। দৃষ্টিহীনদের আবাসিক স্কুলে পড়তে পড়তেই বাবাকে হারিয়েছেন। বাড়ি বাড়ি রাঁধুনির কাজ করে দুই ভাইবোনের পেট চালিয়েছেন মা। প্রচণ্ড আর্থিক কষ্টে পড়েছেন। কখনও এমন সময় এসেছে যখন মনে হয়েছে, এই শেষ, লেখাপড়াটা বোধহয় আর চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে না। কিন্তু ঠিক পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন কিছু মানুষ, যাঁদের অনেকেই সম্পূর্ণ অচেনা। তাঁদের সহযোগিতায় আর নিজের অদম্য জেদে ‘বড়’ হয়ে ওঠার লড়াই থামেনি। দৃষ্টিহীন হয়েও সাধারণ স্কুলে পড়েছেন। ইতিহাসে স্নাতকোত্তর হয়েছেন। হোঁচট খেয়েছেন, কখনও বা মুখ থুবড়ে পড়েছেন, ফের ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। সমস্ত প্রতিবন্ধকতা পার করে আজ দোহারিয়া বিধানপল্লী হাই স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক তারক।
দীর্ঘ লড়াইয়ের শেষে জেদি, লড়াকু ব্যক্তির সাফল্য। এখানেই থেমে যেতে পারতেন তারক, এখানেই তাঁর গল্পের রূপকথার মতো ক্লাইম্যাক্স লেখা যেত। কিন্তু তারক যে ব্যক্তিকে ছাপিয়ে সমষ্টির স্বপ্ন দেখে এসেছেন বরাবর। অন্যের জন্য কিছু করার ইচ্ছে তাই থামতে দেয়নি তাঁকে। দৃষ্টিহীন ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার চড়াইয়ে কী কী বাধার মুখে পড়তে হয় তা তাঁর থেকে ভাল আর কে জানে! পড়ার ইচ্ছে থাকলেও ব্রেল বা অডিয়ো মাধ্যমে সব বই পাওয়া যায় না। তাই শুধুমাত্র দৃষ্টিহীন বলেই বহু ছাত্রছাত্রীরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েন। গুমায় তারক খুলে ফেললেন অডিও বইয়ের লাইব্রেরি। আজ রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে দৃষ্টিহীন ছাত্রছাত্রীরা আসেন এই লাইব্রেরিতে। শুধু দৃষ্টিহীন ছাত্রছাত্রীদের জন্য নয়, সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের পাশেও সমান ভাবে হাজির ‘তারক স্যার’। যে কোনও প্রয়োজনেই তাঁর ঘরের দরজা খোলা।
আমরা যারা দু’চোখে দেখতে পাই, তারা আসলে সব দেখতে পাই কি? অন্যের যন্ত্রণা দেখার জন্য রক্তমাংসের চোখের প্রয়োজন পড়ে না তারক চন্দ্রদের মতো মানুষের। গুরুর কাজ অন্ধকারে আলোর দিশা দেখানো। তারকের ইচ্ছে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হোক সকলের জীবন। আঁধার দেশের লাইট হাউস তিনি।