বাঙালির বিলেত পাড়ি

পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। ভূপ্রকৃতিও কম আকর্ষণীয় নয়। ইংল্যান্ড ঘুরে এসে লিখছেন সুচিন্ত্য চট্টরাজ ঘড়িতে সময় রাত সাড়ে দশটা। বিমানবন্দর থেকে যাওয়ার পথে ক্রয়ডন, থর্নটন, ব্রিক্সটন, নরবারির মতো ছোট ছোট জনপদ নজরে পড়ল। চোখ টানল গৃহশৈলী।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০২:৫৩
Share:

টেমসের অন্য পাড়ে বিগবেন। ছবি: লেখক

গত বছর গরমের ছুটির এক ভোরে পৌঁছে গেলাম দমদম বিমানবন্দরে। গন্তব্য, লন্ডনের গ্যাটউইক বিমানবন্দর। দুর্গাপুর থেকে লন্ডন। দীর্ঘ যাত্রাপথ। দুবাই হয়ে যখন গ্যাটউইকে নামলাম তখন বৃষ্টি পড়ছে। ঠান্ডা আছে ভালই। হোটেল নয়, থাকব লন্ডনে এক আত্মীয়ের ফ্ল্যাটে। লন্ডনে যখন পৌঁছলাম, ঘড়িতে সময় রাত সাড়ে দশটা। বিমানবন্দর থেকে যাওয়ার পথে ক্রয়ডন, থর্নটন, ব্রিক্সটন, নরবারির মতো ছোট ছোট জনপদ নজরে পড়ল। চোখ টানল গৃহশৈলী।

Advertisement

সকালে দরজা খুলে বাইরে দাঁড়ালাম। আমাদের তিন সপ্তাহের বাসস্থান ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজ রোডে। এই ব্রিজ নিয়ে ওয়ার্ডসওয়ার্থের বিখ্যাত সনেট রয়েছে। সামনে বড় রাস্তা। সব সময় ব্যস্ত। সব কিছুই চলছে দ্রুত গতিতে। কিন্তু নিয়ম মেনে। টেমসের দক্ষিণ তীর ধরে ঘুরতে বেরোলাম। আমাদের ফ্ল্যাটের পিছনেই লোয়ার মার্শ। একটা সময় জলা জায়গা ছিল। দু’দিকে ফুটপাথে নানা দেশের খাবারের দোকান। বাঁ দিকে ঘুরেই ওয়াটারলু স্টেশন। হাঁটতে হাঁটতেই পৌঁছলাম টেমসের দক্ষিণ তীরে রয়্যাল ফেস্টিভ্যাল হলে। এই হলের বাইরে নেলসন ম্যান্ডেলার আবক্ষ মূর্তি রয়েছে। ভিতরে ছ’টি তলায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের বন্দোবস্ত। বাইরের ব্যালকনি থেকে নজর পড়ে টেমসের অসাধারণ সৌন্দর্য। নদীর বুকে রকমারি জলযান চলছে। প্রচুর পর্যটকের ভিড়। রয়্যাল ফেস্টিভ্যাল হলে আছে কবিতার বই-এর লাইব্রেরি। রবীন্দ্রনাথের অনেকগুলি কাব্যগ্রন্থের পুরনো সংস্করণ রয়েছে এখানে। ওখান থেকে বেরিয়ে আবার টেমসের দক্ষিণ পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে বিখ্যাত লন্ডন আই-তে পৌঁছে গেলাম। এখান থেকে লন্ডন শহরকে অপূর্ব দেখায়। পাশেই সবুজ, সুন্দর ঘাসের বাগান, জুবিলি গার্ডেন্স। অনেকে বসে গল্প করছেন। আশেপাশে পায়রা আর হাঁস ঘুরে বেড়াচ্ছে। এগোলাম সামনের দিকে। বাঁ দিকে লন্ডন ডাঞ্জন (Dungeon)। একটু এগিয়ে ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজ থেকে হেঁটে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট। পাশে বিগবেন। এটা টেমসের উত্তর পা়ড়। পার্লামেন্টের পাশ দিয়ে এগোতেই বিস্তৃত সবুজ ঘাসের মাঝে রঁদা’র এক অপূর্ব ভাস্কর্য। পার্লামেন্টের ভিতরে ক্রমওয়েল, রিচার্ড দ্য গ্রেটের পূর্ণাবয়ব মূর্তি। ডান দিকে, একটু এগোলেই বিগবেন, বাঁ’দিকে পার্লামেন্ট স্কোয়্যার। সেখানে চার্চিল, গাঁধীজি, ম্যান্ডেলার পূর্ণাবয়ব মূর্তি রয়েছে। সেখান থেকে গেলাম বাকিংহাম প্যালেসের দিকে। চারদিকে রাজকীয় আভিজাত্যের প্রতীক। গোটা জায়গাটাই ওয়েস্টমিনস্টার। চারিদিকে পুরনো সংস্কৃতির ছাপ।

এর পরে এগোলাম ট্রাফালগার স্কোয়্যারের দিকে। সেখানেই আছে স্টেট আর্ট গ্যালারি। স্কোয়্যারের ফোয়ারার জলে অনেকে স্নান করছেন। এ সব দেখে ফিরে এলাম। বিকেলে আবার ভ্রমণ শুরু। গেলাম লন্ডনের উপকণ্ঠে ব্ল্যাকহিথে। নরম্যানদের বিজয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই অঞ্চলের ইতিহাস। আর্থার কোনান ডয়েল এখানে লিখেছিলেন ‘দ্য ম্যান উইথ দ্য টুইস্টেড লিপ’। সামনেই এক মধ্যযুগীয় চার্চের ধ্বংসাবশেষ। সেখানে আছে এডমন্ড হ্যারির সমাধি।

Advertisement

পর দিন সকালে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে গিয়ে রবিবারের প্রার্থনাসভায় যোগ দিলাম। পৃথিবীর পুরনো ঐতিহ্যময় চার্চগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। এই চার্চ প্রতিষ্ঠিত হয় ৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে। পার্লামেন্ট স্কোয়্যারের ঠিক পাশে অবস্থিত এই চার্চ গথিক স্থাপত্যের এক অনুপম নিদর্শন। ব্রিটিশ রাজপরিবারের যাবতীয় কাজকর্ম এই প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চেই হয়। প্রার্থনা কক্ষ থেকে করিডর ধরে বাইরে বেরোনোর পথে দু’দিকে চোখে পড়ল সন্তদের মূর্তি। স্যার আইজাক নিউটনের সমাধি আছে এই চার্চেই।

পরের দিন আমাদের গন্তব্য ছিল শার্লক হোমস মিউজিয়াম— ২২১ বি, বেকার স্ট্রিটে। কোনান ডয়েলের বর্ণনা অনুযায়ী, হোমসের বাড়ি এটাই। প্রবেশ মূল্য, মাথা পিছু ১৫ পাউন্ড। ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় সাড়ে বারোশো টাকা। মিউজিয়ামের এক অংশে হোমস সংক্রান্ত অনেক স্মারক বিক্রি হচ্ছে। হোমসের শয়ন কক্ষ সাজানো বিভিন্ন ছবি, টেবিল, বই, ব্যবহার্য জিনিসপত্র, চেম্বার পট ইত্যাদি দিয়ে। পাশেই বসার ঘর। সেখানে টেবিলের উপরে চোখে পড়ল হোমসের একটা টুপি, আতসকাচ, পাইপ। দো’তলা ও তিন তলার সমস্তটা জুড়ে রয়েছে হোমসের গল্পের বিভিন্ন চরিত্রের ছবি, প্লাস্টার অফ প্যারিসের মূর্তি, মার্বেল মূর্তি। ‘দ্য হাউন্ড অব দ্য বাস্কারভিলস’-এর হাউন্ডের মতো একটি ‘স্টাফড’ করা কুকুরের মুখও রয়েছে দেখলাম।

বেকার স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে একটু এগিয়ে লর্ডস। বিখ্যাত ক্রিকেট মাঠ। ডান দিকে যে রিজেন্ট পার্ক তা রাজ পরিবারের সম্পত্তি। প্রায় সাড়ে ৩০০ একর জুড়ে এই পার্ক। অনেক পাখি, হাঁস, হরিণের নির্ভয় বিচরণভূমি। বিচ, ওক, ফারে চারদিক ভরে আছে।

সন্ধ্যাবেলা বেরোলাম ম্যাঞ্চেস্টারের উদ্দেশ্যে। ঘড়ি বলছে এখন সন্ধ্যা। তবে বাইরে তীব্র রোদ। দূরত্ব প্রায় দু’শো মাইল। ম্যাঞ্চেস্টার পৌঁছতে রাত ১১টা বেজে গেল। পরের দিন গেলাম চেশায়ার-এর ডান হাম ম্যাসিতে। মধ্যযুগীয় এক পার্ক, এখন জাতীয় সম্পত্তি। ওক, বিচ, রডোডেনড্রন, বার্চ, চেস্টনাট, নানা রকম পাইন ভরা এই পার্কে হরিণ ঘুরে বেরায়। বেশ কয়েকটি জলাশয়ও রয়েছে। সেখানে নানা ধরনের হাঁস, সারস, হরিণের বাস। রয়েছে বিশাল বড় প্রাসাদ। পাশেই রয়েছে আস্তাবল।

এর পরে আমাদের গন্তব্য ডার্বিশায়ারের অন্তর্গত পিক ডিস্ট্রিক্টের ব্লু-জন-ক্যাভার্ন। এখানে ব্লু-জন নামের পাথর পাওয়া যায়। এগুলি গয়নায় ব্যবহৃত হয়। পিক ডিস্ট্রিক্ট পুরোটাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর। অনুচ্চ পাহাড়। আর তার ঢাল। সবুজ ঘাস। ওক আর চেস্টনাটে ঢাকা। চরে বেড়াচ্ছে হৃষ্টপুষ্ট অগুন্তি ভেড়া আর পনি। রয়েছে স্ট্যালাকটাইট, স্ট্যালাগমাইটের অপূর্ব কারুকার্যে ভরা এক গুহা।

এর পরের কয়েক দিন কাটল ম্যাঞ্চেস্টারের আশপাশেই। গেলাম হ্যালিফ্যাক্স রোড ধরে হলিংওয়ার্থ লেক দেখতে। কাছেই বিখ্যাত মুর। যার বর্ণনা রয়েছে এমিলি ব্রন্টির ‘উদারিং হাইটস্’-এ (Wuthering Heights)। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনিভার্সিটির মিউজিয়াম যথেষ্ট সমৃদ্ধ। সেখানে মিশরের মমিও আছে।

এ বার লন্ডনে ফেরা। একশো মাইল গিয়ে ডানদিকে ঘুরে পৌঁছালাম অ্যাভন নদীর ধারে স্ট্র্যাটফোর্ডে শেকসপিয়রের বাড়িতে। প্রবেশমূল্য মাথাপিছু ১৭ পাউন্ড। ঢুকলাম, তীর্থযাত্রার মতো। অসাধারণ সব স্মৃতিচিহ্ন। শোবার ঘর, থাকার ঘর। সেখানে সাজানো আছে ৪০০ বছরেরও বেশি আগে যে সব খাবার পাওয়া যেত তার কিছু নিদর্শন। আছে আগুন জ্বেলে রাখার ব্যবস্থা। এক জায়গায় রয়েছে দর্শনার্থীদের স্বাক্ষর। যার মধ্যে আছেন ওয়াল্টার স্কট ও চার্লস ডিকেন্স। শেকসপিয়ার যে টেবিলে বসে লিখতেন তার পাশেই আছে এক দেরাজ। সেখানে বিখ্যাত নাটকগুলির পাণ্ডুলিপি রাখতেন তিনি। বাইরের বাগানে রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ মূর্তি।

পরের দিন আমাদের গন্তব্যস্থল ছিল গ্রেট রাসেল স্ট্রিটে ব্রিটিশ মিউজিয়াম। ভারতীয় গ্যালারিটি রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলছে বলে বন্ধ। কিন্তু মিশরের গ্যালারিতে কয়েক হাজার বছর আগের ফ্যারাওদের পাথরের মূর্তি ও বিভিন্ন মমি রয়েছে। সাইপ্রাস, গ্রিস, রোমান গ্যালারিতে অসাধারণ সব নিদর্শনে ভরা। এক মোহবিষ্ট পরিবেশ। বাড়ির সামনেই ল্যামবেথ নর্থে ইম্পিরিয়াল ওয়্যার মিউজিয়াম। সেখানে আছে নাৎসিদের হাতে ইহুদি নিধনের বর্ণনা, হলোকস্ট। এক দিন গেলাম ব্রাইটনের সমুদ্রের ধারে। প্রখর রোদ। অথচ কনকনে ঠান্ডা হাওয়া। মেরিন ড্রাইভ অনেকটাই উপরে।

লন্ডন শহরের সঙ্গে পরিচিত হতে হলে হেঁটে ঘোরা ভাল। টেমসের দক্ষিণ তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে শেকসপিয়রের গ্লোব থিয়েটার। একটু এগোতেই প্রায় হাজার বছরের পুরনো সাউথওয়ার্ক ক্যাথিড্রাল। কাছেই লন্ডন ব্রিজ, একটু এগিয়ে লন্ডন মনুমেন্ট। সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল দেখে ল্যামবেথ ব্রিজ, ওয়াটারলু ব্রিজ, ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজ ধরে নিজের পছন্দসই জায়গাগুলি দেখে নেওয়া যায়। অক্সফোর্ড স্ট্রিটে কিছু কেনাকাটাও করতে পারেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement