মদমহেশ্বর। — নিজস্ব চিত্র।
গাড়োয়াল হিমবাহের অন্তর্গত সর্বপরিচিত ট্রেক রুট হল পঞ্চকেদার। কেদারনাথ, মদমহেশ্বর, তুঙ্গনাথ, রুদ্রনাথ ও কল্পেশ্বর হল এর অন্তর্ভুক্ত। স্বর্গারোহণের পথে মহিষরূপী শিব ভীম দ্বারা আবিষ্ট হয়ে খণ্ডিতভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল এই সকল স্থানে। এদেরকে কেন্দ্র করেই এই তীর্থস্থানগুলি গড়ে উঠেছে বলে মানুষের বিশ্বাস। এই সব মন্দির দর্শনের উদ্দেশে মানুষের পদচারণা বহু যুগ ধরে। এই ট্রেক রুটে গাড়োয়াল হিমালয়ের সবরকম প্রাকৃতিক বৈচিত্র ধরা পড়ে। তীর্থস্থানগুলি সরাসরি হাঁটা পথে যাওয়া যায়। সে পথ কঠিন। যদি গাড়ির সাহায্য নেওয়া যায় তবে বারবার ওঠানামা করতে হয়। পথ হবে অনেক সহজ।
হাওড়া থেকে ট্রেনে হরিদ্বার/ঋষিকেশ/নাজিবাবাদ/। তারপর মোটরপথে রুদ্রপ্রয়াগ ও শোনপ্রয়াগ হয়ে গৌরীকুণ্ড।
প্রথম দিন গৌরীকুণ্ড (১৯৮২মি)-ভীমবলী (২৬৬০মি)-লিনচোলী(৩১৪৮মি)-১৩কিমি
গৌরীকুণ্ড থেকে পুরনো পথের পাশাপাশি নতুন পথে হাঁটা শুরু করুন। জঙ্গল চটি ছাড়িয়ে এগিয়ে চলুন রামওয়ারার দিকে। মন্দাকিনী নদী থাকবে ডানদিকে। রামওয়ারা যেতে হবে না। এক কিলোমিটার আগেই ভীমবলী থেকে নেমে আসবেন নদীর পাশে। মন্দাকিনী পেরিয়ে তীব্র চড়াইপথে নদীর বামতটে খালনি ধারের পশ্চিমঢালে উঠে চলুন। একটানা চড়াই পথে অরণ্যের মধ্যে দিয়ে নতুন তৈরি বাঁধানো পথে পৌঁছে যাবেন একটা নালার পাশে। নালাটি পেরিয়ে উঠে আসবেন ঘাসে ঢাকা পাহাড়ের ঢালে। পৌঁছে যাবেন লিনচোলীর সরকারি আস্তানায়। এক পরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকা-খাওয়ার সব ব্যবস্থাই আছে।
দ্বিতীয় দিন লিনচোলী-কেদারনাথ (৩৫৮৪মি)-৪কিমি
লিনচোলী থেকে উন্মুক্ত হবে কেদারনাথ শৃঙ্গ-সহ তুষারাবৃত পর্বতমালা। গাছপালাও কমে যাবে। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হবে কেদারনাথ মন্দির অঞ্চল। মন্দির থেকে দু’কিলোমিটার আগেই কেদারনাথ বেসক্যাম্পে গড়ে উঠেছে থাকার সরকারি আস্তানা। ওখানে মালপত্র রেখে সরস্বতী নালা পেরিয়ে কেদারনাথ মন্দিরে পৌঁছে যাবেন। মন্দিরদর্শন, পূজার্চনা ও চারপাশটা ঘুরে ফিরে আসুন কেদারনাথের সরকারি আস্তানায়।
আরও পড়ুন, পাহাড়ের কোলে লেপচাখা
তৃতীয় দিন কেদারনাথ-লিনচোলী-ভীমবলী-গৌরীকুণ্ড-১৭কিমি
গৌরীকুণ্ড-উখীমঠ-গাড়িপথ
সকালে বেরিয়ে একইপথে অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে গৌরীকুণ্ড নেমে আসতে পারবেন। গৌরীকুণ্ড থেকে গাড়ি চেপে গুপ্তকাশী হয়ে উখীমঠ চলে আসবেন। এখানে মন্দির দর্শন করুন। শীতকালে এই মন্দিরেই মদমহেশ্বরের বিগ্রহ পূজিত হয়।
কেদারনাথ মন্দির।
চতুর্থ দিন উখীমঠ-যোগাসু-ওনিওনা-রাঁশি-গাড়িপথ
রাঁশি (১৯৮০মি)-গৌণ্ডার (২০৭০মি)-৭কিমি
উখীমঠ থেকে গাড়ি চেপে মনশুনা, যোগাসু ও ওনিওনা ছাড়িয়ে রাঁশির কাছাকাছি পৌঁছন যায়। সুন্দর হাঁটাপথে উঠে আসবেন রাঁশি গ্রামে। রাঁশি থেকে প্রায় সমতল পথে আরও ঘণ্টা দুয়েক হাঁটলেই গৌণ্ডার পৌঁছে যাবেন।
পঞ্চম দিন গৌণ্ডার-বানতোলি-খাডোরা (২০২০মি)-নানু (২৩৩০মি)-মদমহেশ্বর (৩৪৯০মি)-১০কিমি
গৌণ্ডার থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে বানতোলি। মার্কণ্ডেও গঙ্গা ও মদমহেশ্বর গঙ্গার সঙ্গমস্থলের নিকটে এই ছোট্ট সুন্দর জায়গাটিতেও থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। আগের দিন এখানে রাত্রিবাস করতে পারেন। এখান থেকে শুরু হবে কঠিন চড়াইপথ। বড় বড় গাছপালার মধ্য দিয়ে প্রশস্ত পথ। ক্রমে মদমহেশ্বর গঙ্গার প্রবাহ দূরে চলে যাবে। স্পষ্ট হবে গৌণ্ডার ও রাঁশি গ্রাম। খাডোরা চটিতে টুকটাক খাবার পাবেন। ঘাস ও গুল্মে ঢাকা পাহাড়ের ঢাল ধরে পাকদণ্ডী চড়াইপথে উঠে আসবেন নানু। এখানেও দোকান ও জলের ব্যবস্থা আছে। বনের মধ্যে মাঝে মাঝেই উন্মুক্ত ঘাসের ঢাল রয়েছে। পথের দূরত্ব কম হলেও সবটাই চড়াইপথ। অনেকটা সময় লাগবে। মাত্র ৯ কিলোমিটার পথে উঠতে হবে চার হাজার ফুট। উঠে আসবেন মদমহেশ্বরে। ধারাবাহিক সবুজের মাঝে পাহাড়ের কোলে মদমহেশ্বর মন্দির অসাধারণ। এখানে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।
মদমহেশ্বর যাওয়ার পথ।
ষষ্ঠ দিন মদমহেশ্বর-গৌণ্ডার-রাঁশি-১৭কিমি
খুব ভোরে উঠে আসুন বুড়ো মদমহেশ্বেরের মন্দিরে। ঘাসে ঢাকা প্রান্তরের মাঝে এক ছোট্ট মন্দির। এখান থেকে চারপাশের দৃশ্য অপূর্ব। চৌখাম্বা ও মান্দানি শৃঙ্গমালাকে খুব কাছ থেকে দেখা যাবে। আছে এক ছোট্ট জলাশয়। তারপর নেমে আসুন মদমহেশ্বরে। একই পথে একটানা নেমে আসবেন বানতোলি। বানতোলি থেকে চলে আসবেন রাঁশি। রাকেশ্বরী মন্দিরকে ঘিরে এটি একটি বড় গ্রাম।
সপ্তম দিন রাঁশি-ওনিওনা-উখীমঠ-চোপতা-গাড়িপথ
চোপতা (২৫০০মি)-তুঙ্গনাথ (৩৫৪৯মি)-হাঁটাপথ
রাঁশি থেকে খুব ভোরে বেরিয়ে ওনিওনা হয়ে জিপে ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে চলে আসবেন উখীমঠ। উখীমঠ থেকে গাড়িপথে ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই চোপতা পৌঁছে যাবেন। চোপতা থেকে তুঙ্গনাথ মাত্র সাড়ে তিন কিলোমিটার চড়াই পথ। ধীরে ধীরে পাথর বাঁধান পথে উঠতে থাকুন। খানিকটা ওঠার পর বড় গাছপালা থাকবে না। পাহাড়ের ঢাল থাকবে ঘাসে ঢাকা। এরই মধ্যে দিয়ে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই উঠে আসবেন তুঙ্গনাথ। মন্দির সংলগ্ন গেস্ট হাউস বা অন্যত্র থাকতে পারবেন। এখানকার মন্দিরে মহিষরূপী শিবের বাহু অংশটি আছে পাথরের আকারে।
আরও পড়ুন, অরণ্যের মাঝে নিভৃতে
অষ্টম দিন তুঙ্গনাথ-চন্দ্রশীলা (৩৬৮০মি)-চোপতা-৫কিমি- হাঁটাপথ
চোপতা-মণ্ডল-২৭ কিমি- গাড়িপথ
মণ্ডল (১৫৬৮ মি)-অনুসূয়া (২১৯৫মি)-৬কিমি হাঁটাপথ
ভোররাতে বেরিয়ে পড়ুন চন্দ্রশীলার উদ্দেশে। পাথরের উপর হালকা বরফের আস্তরণ থাকতে পারে। সাবধানে উঠে আসবেন চন্দ্রশীলার উপরে। এখান থেকে গাড়োয়াল ও কুমায়ুঁর মাঝে বহু শৃঙ্গমালাই দেখা যাবে। দেখা যাবে নন্দাদেবী, চৌখাম্বা, কেদারনাথ, ত্রিশূল-সহ বহু পর্বতচূড়া। নেমে আসবেন তুঙ্গনাথ মন্দিরে। মন্দির দর্শন করে একই পথে নেমে আসবেন চোপতা। চোপতা থেকে বাসে বা ছোটগাড়ি চেপে মণ্ডল মাত্র ২৭কিমি দূরে। মণ্ডল থেকে সহজপথে উঠে আসবেন অনুসূয়া গ্রামে। অনুসূয়া মায়ের মন্দিরকে ঘিরে এটি একটি ছোট্ট গ্রাম।
তুঙ্গনাথ মন্দির।
নবম দিন অনুসূয়া-অত্রিমুনির আশ্রম-নওলা পাস (৪২০০মি)-রুদ্রনাথ (৩৫৫৭মি)-১৬কিমি
এদিন অনেকটা চড়াইপথে চলতে হবে। দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়ুন। অল্প অল্প চড়াইপথে চলে আসবেন অত্রিমুনির আশ্রমের কাছে। খুবই সাবধানে যাবেন মন্দির দর্শন করতে। ফিরে আসুন মূলপথে। সামান্য এগিয়ে বালখিল্য গঙ্গা পেরিয়ে ঘনবনের মাঝে শুরু হবে একটানা চড়াই পথ। পথে জলকষ্ট আছে। একসময় গাছপালা কমে আসবে। শুরু হবে চারণভূমি। এরই মধ্যে দিয়ে উঠে আসবেন রুদ্রনাথওয়ালা গিরিশিরার উপরে অবস্থিত নওলা পাসে। এখান থেকে নন্দাদেবী সমেত বহু শৃঙ্গমালা দেখা যাবে। উত্তর-পূর্বদিকে গিরিশিরাটির গায়ে গায়ে পৌঁছে যাবেন রুদ্রনাথ মন্দিরে। নির্জন পরিবেশে এ জায়গাটি ভাল লাগবে। মহিষরূপী শিবের মস্তক অংশটি এখানে পূজিত হয়।
আরও পড়ুন, সবুজে ঘেরা রাঁচী
দশম দিন রুদ্রনাথ-পানার (২২৮৬মি)-টোলি-দুমক-২০কিমি
এদিনও অনেকটা পথ চলতে হবে। ভোর ভোর হাঁটা শুরু করে পাহাড়ের ঢাল ধরে একইপথে উঠে আসবেন পিতুর ধার। এরপর উৎরাই পথে বুগিয়ালের মধ্য দিয়ে নেমে আসবেন পানার বুগিয়ালে। এখানে খাওয়া ও থাকার সামান্য ব্যবস্থা পাওয়া যায়। এখান থেকে দু’টি পথ। মূলপথটি নেমে যায় সাগর অভিমুখে। ওপথে নয়। আপনি বাঁদিকে, অর্থাৎ উত্তরমুখী পথে নামতে থাকুন। অনেকটা পথ পেরিয়ে সরাসরি নেমে আসুন কালাপানি নালার ধারে। নালাটি পেরিয়ে আরও খানিকটা চলার পর পৌঁছে যাবেন দুমক গ্রামে।
একাদশ দিন দুমক (২১৩৪ মি)-কালগোট (২০৭৩মি)-উর্বশী পাস (৩০৪৮মি)-দেবগ্রাম (২১০০মি)-২০কিমি
ওঠানামা পথ ধরে হাঁটা। পরের গ্রাম কালগোট থেকে একটা পথ চলে যায় বংশীনারায়ণ অভিমুখে। আপনি চলুন পূর্বমুখী পথে উর্গম উপত্যকা দিকে। সারাদিনে অনেকটা ওঠানামা পথ পেরিয়ে উর্গমের মাঝে দেবগ্রাম পৌঁছে যাবেন।
আরও পড়ুন, ভাটোয়ারি-পাওয়ালি কাঁটা-ত্রিযুগীনারায়ণ
দ্বাদশ দিন দেবগ্রাম (২১৫০মি)-কল্পেশ্বর-সালনা-হেলাং-১১কিমি
দেবগ্রাম থেকে সহজপথে থেকে এক কিলোমিটার দূরে কল্পগঙ্গার উপর পুল পেরিয়ে উঠে আসবেন কল্পেশ্বর মন্দিরে। নদীর বামতটে একটা হুমড়ি খাওয়া পাথরের নীচে অন্ধকারের মাঝে এই মন্দিরটি। মহাদেবের জটা অংশটি রয়েছে এখানে। দর্শনের পর একই পথে ফিরে চলুন দেবগ্রামে। বাঁদিকে নদীর বামতটে দেখতে পাবেন এক সুন্দর ঝর্না। সালনা থেকে হেলাং গাড়িপথ। চামোলী-যোশীমঠ বাসরাস্তার উপর অবস্থিত হেলাং-এ পৌঁছে শেষ হবে পঞ্চকেদার পদযাত্রা।
কল্পেশ্বর মন্দির।
হেলাং থেকে গাড়িপথে চামোলী হয়ে হরিদ্বার ফিরে আসুন।
আরও পড়ুন, হর-কি-দূন
পথে প্রায় সর্বত্রই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। অনুসূয়া-রুদ্রনাথ-দুমক পথ ছাড়া পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজনে মালবাহক গৌরীকুণ্ড, রাঁশি, অনুসূয়া থেকে সংগ্রহ করতে পারেন। উখীমঠ থেকে গাড়ি চেপে চোপতা যাওয়ার পথে সারি গ্রামে যেতে পারেন। সারি থেকে দেউরিয়া তাল ঘুরে আসতে ঘণ্টা চারেক সময় লাগবে। সেক্ষেত্রে প্রোগ্রামে একদিন বেশি সময় লাগবে। তুঙ্গনাথ থেকে সরাসরি হাঁটাপথে মণ্ডল নেমে আসতে পারেন। তবে পথপ্রদর্শক ছাড়া পথ ভুলের আশঙ্কা আছে। মণ্ডল ও গোপেশ্বরের মাঝে সাগর নামক স্থান থেকেও রুদ্রনাথ যাওয়া যায়।
(লেখক পরিচিতি: আক্ষরিক অর্থেই রতনলাল বিশ্বাস ভূপর্যটক। তাঁর ট্রেকিংয়ের শুরু সেই ১৯৭২ সালে। ট্রেকিংয়ে সেঞ্চুরি করে ফেলেছেন তিনি। এ পর্যন্ত মোট ১০১টি ট্রেকিং সম্পন্ন। ব্যাঙ্কে না ঢুকে পূর্ব রেলে চাকরি নিয়েছিলেন বেড়ানোর নেশায়। শুধু পাহাড়েই নয়, গঙ্গাসাগর থেকে হেঁটে মুম্বইয়ে আরব সাগরের উপকূল পর্যন্ত পৌঁছেছেন রতনলাল, সে যাত্রায় পেরিয়েছেন প্রায় চার হাজার কিলোমিটার। হেঁটেছেন শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ উপকূল ধরেও। ’৭৮ সাল থেকে নেপালে ট্রেক করেছেন পর পর ২৫ বছর। ’৮৭ থেকে ৩০ বছর ধরে যাচ্ছেন লাদাখে। এ পর্যন্ত ট্রেকিং পথ পেরিয়েছেন প্রায় ১৮ হাজার কিলোমিটার। পাশাপাশি চলেছে নিরন্তর ক্যামেরার লেন্সে চোখ রাখা। এ পর্যন্ত লিখেছেন ভ্রমণ সংক্রান্ত আটটি গ্রন্থ। চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন বছর তিনেক। কিন্তু পদব্রজে বিশ্ব পরিক্রমার নেশা থেকে অবসর নেবেন, এমনটা স্বপ্নেও ভাবেন না রতনলাল।)
ছবি— লেখক।