ষাটের দশকে যেমন ছিল চিৎপুর রোড। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
‘‘চিৎপুর পূজে রাজা সর্বমঙ্গলা।/নিশি দিশি বাহে ডিঙ্গা নাহি হেলা।।’’ (প্রক্ষিপ্ত)। ‘‘ত্বরায় চলিল তরি তিলেক না রয়/ চিত্রপুর সালিখা এড়াইয়া যায়।’’ (প্রক্ষিপ্ত)। সপ্তদশ শতকে বাংলাকাব্যে চিৎপুর হয়তো প্রক্ষিপ্ত। কিন্তু ইতিহাসে প্রক্ষিপ্ত নয় গ্রাম চিত্তেশ্বরীপুর ওরফে চিত্রপুর বা চিৎপুর। ১৭৯২-৯৩ সালে তৈরি আপজন সাহেবের মানচিত্রে সাবেকি চিৎপুর গ্রাম থেকে কালীঘাট পর্যন্ত প্রসারিত রাস্তাকে বলা হয়েছে ‘রোড টু চিৎপুর’। অর্থাৎ চিৎপুর নামক গ্রামে যাবার রাস্তা। তারও আগে ইংরেজের তৈরি মানচিত্রে রয়েছে এই রাস্তা। সেখানে তার পরিচয় ‘পিলগ্রিম পাথ’। তীর্থযাত্রীদের পথ। এ পথ কোন্ তীর্থে নিয়ে যায় যাত্রীকে, তা-ও বলা আছে মানচিত্রে,— ‘রোড টু কালীঘাট’। এ পথেই আদি কলকাতার বুকের ওপর দিয়ে সুতানুটি থেকে বনপথ ধরে তীর্থযাত্রীরা পৌঁছাতেন গোবিন্দপুর ছাড়িয়ে কালীঘাটে। ইংরেজ আমলে এই চিৎপুর কলকাতার হৃৎপিণ্ডে একটি ধমনীর মতো। তার ডাইনে বাঁয়ে শৈশবের কলকাতা, আজ যাকে বলা হয় আদি কলকাতা। এ পথেই সিরাজদৌল্লার ফৌজ পৌঁছে ছিল ট্যাঙ্কস স্কোয়ারে, ফোর্ট উইলিয়ামের দরজায়। এ বাহিনীকে ঠেকাবার জন্য পেরিন সাহেবের বাগানে কামান বসিয়ে ছিল ইংরেজরা। এই পেরিনের বাগান থেকেই সম্ভবত বাগবাজার। বাগবাজারের খালের ধারে ভাবছিলাম, চিৎপুর পরিক্রমা শুরু করব কোথা থেকে? খালের ওপারে কাশীপুর রোড। এ পারে আগে ছিল হ্যারিসন রোড পর্যন্ত আপার চিৎপুর রোড, পরের অংশটুকু লোয়ার চিৎপুর রোড। আজ গোটা রাস্তাটি রবীন্দ্র সরণি। এই দীর্ঘ রাস্তার দু’ধারে এখনও ছড়িয়ে রয়েছে কলকাতার স্মৃতিবৈভব। সে স্মৃতি আজ প্রায়শ জীর্ণ, ধুলিমিলন, তবু অবহেলার যোগ্য নয়, কেন না আজ নাম তার যাই হোক, চিৎপুর রোড এক আশ্চর্য স্মৃতির সরণি। এ পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে জেগে ওঠে হারানো সুতানুটি। সম্ভবত হারানো কলকাতাও।
আরও পড়ুন: ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে খুলে দেওয়া হল হাওড়া ভাসমান সেতু
শুরু করেছি বাগবাজারের খাল ছাড়িয়ে আরও উত্তর থেকে। চিৎপুরের খাল অর্থাৎ বাগবাজারের খাল কাটা হয় ১৮৩৩ নাগাদ। খালের মুখে কলের দরজা— স্লুইস গেট। হুতোম বলেছেন, এক সময় দর্শনীয় ছিল সেই দরজা খোলা আর বন্ধ করা। এখন যেমন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাতাল রেলের মাটি তোলা দেখতেন অসংখ্য দর্শক। চিৎপুর ব্রিজ তৈরি হয় অনেক পরে ১৯৩৪ সালে। চিৎপুর ব্রিজের উপর যদি দাঁড়ানো যায় তবে উত্তর দিকে দেখা যায় তিন-তিনটি গম্বুজ। সেটি একটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ। দাঁড়িয়ে আছে এক উঁচু পোস্তার ওপর। অন্য ধরনের স্থাপত্য। তার সঙ্গে কলকাতার অন্যান্য মসজিদের মিল কম। তাকালে মনে পড়ে যায় মুর্শিদাবাদের কিংবা গৌড়ের মসজিদগুলোর কথা। পুরোপুরি মুসলিম স্থাপত্য। সাধারণের কাছে এ মসজিদের নাম ভোসড়ি শা বা বসরি শা-র মসজিদ। জনশ্রুতি—এর নির্মাতা রেজা খাঁ। এককালে তাঁকে বলা হত চিৎপুরের নবাব। কেউ কেউ বলেন মসজিদটি ১৮০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং প্রতিষ্ঠাতা জাফর আলি খাঁ। এই মসজিদের চত্বরেই রয়েছে ভোসড়ি শা পীরের মাজার। দূর আরব থেকে নাকি এসেছিলেন এই সুন্নি পীর সাহেব। আজও তিনি সাধারণের কাছে জাগ্রত ধর্মপুরুষ। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে মানুষ নিরাময়ের আশায় এখানে ধর্না দেন। আশীর্বাদী ফুল, মাটি বা জল নিয়ে ঘরে ফেরেন। ভোসড়ি শা নিরাময়ী ওষুধ দেন, এখনও সাধারণ মানুষের তাই বিশ্বাস। শুনে ভাল লাগল যাঁরা এখানে আসেন, তাঁদের মধ্যে হিন্দুরাই দলে ভারী। পীর সাহেব সে দিক থেকেও এক নিরাময়ী শক্তিবিশেষ।
এ বার রবীন্দ্র সরণি ধরে দক্ষিণে একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়া যাক। চিৎপুর অ্যাপ্রোচ রোডটি এখন নামকরণ হয়েছে মোহিত মৈত্র সরণি এবং এটি পুরানো রাস্তার সঙ্গে যেখানে যুক্ত হয়েছে, সেখানেই বাগবাজারের ট্রামের শেষ টার্মিনাস। ১৮৮৪ সালে ঘোড়ায় টানা ট্রামলাইন বসেছিল এই পথে। তারপরে বছর আঠারো বাদে শুরু হয়েছে বৈদ্যুতিক এই ট্রাম চলাচলের, যা আজও চলেছে বাগবাজার-বিবাদী বাগের মধ্যে। দক্ষিণমুখো এ রাস্তা ধরে চলতে শুরু করলে, প্রথমেই পড়ে ডানহাতি এক অ্যাডভোকেট পরিবারের বাড়ি, যার মাথার উপর বসানো রয়েছে ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় উপবিষ্ট চিৎপুরি মার্বেল পাথরে তৈরি এক ছোটখাটো বুদ্ধের মূর্তি। বাড়ির বহির্সজ্জায় দর্শনীয় গুরুত্বের কথা ভেবে হয়তো গৃহস্বামীরা এই মূর্তিটি বসিয়েছিলেন।
একটু এগিয়ে গেলেই বাঁ দিকে পড়বে পর পর গুটিকয় মোটরগাড়ি সারাইয়ের কারখানা, তারপর ইট চুন বালি সিমেন্টের গুদাম ও বিক্রয়কেন্দ্র। এ সব পেরিয়ে এলেই ডানদিকে হালের চক্র রেলপথের বাগবাজার স্টেশনের উত্তর প্রান্তের স্ট্র্যান্ড রোডের লাগোয়া ফাঁকা জায়গায় ভাগীরথীকে এখান থেকে দর্শন করা যায়। একটু গেলেই ডানদিকে ৫৭৫ নম্বরের এক দোতলা বাড়ির প্রবেশপথে মার্বেল-ফলকে লেখা আছে ‘ঠাকুরবাড়ি’। তবে তখন সেটির জব্বর মেরামতকার্য চলছে। কিন্তু পুরাতন এ বাড়িটির ছাদ, ছাড়া ছাড়া লোহার কড়ির মধ্যবর্তী স্থানটি অর্ধগোলাকৃতি খিলেন করে তৈরি, সাবেকী স্থাপত্যকর্মের এক সাক্ষ্য। বেশ বোঝা যাচ্ছে, একদা গঙ্গার পূণ্যতোয়া প্রবাহের মাহাত্ম্যের কথা ভেবে নদীতীরে এমন অনেক মন্দির বা ঠাকুরবাড়ি নির্মাণ করেছিলেন সেকালের ধনাঢ্য পরিবারগণ। আজ হয়তো প্রতিষ্ঠাতার উত্তরাধিকারীগণের হাত ফেরি হয়ে চলে এসেছে হালের ডেভেলপারদের হাতে, যাদের কল্যাণে আজ ঠাকুরবাড়িকে দোকানঘর, অফিসবাড়ি বা গুদামঘরে রূপান্তরিত করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। খোঁজ করে জানা গেল, স্থাপত্য নিদর্শনটির স্থাপয়িতা ছিলেন সেকালের বিখ্যাত চক্ষু চিকিৎসক ডাঃ মম্নথনাথ চট্টোপাধ্যায়, যাঁর নামে একটি চোখের হাসপাতাল আছে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডে।
(উপরের নিবন্ধটি তারাপদ সাঁতরা-র ‘কীর্তিবাস কলকাতা’ গ্রন্থের ‘স্মৃতির সরণি: চিৎপুর রোড’ অধ্যায় থেকে নেওয়া। আজ তার প্রথম অংশ প্রকাশিত হল। সৌজন্যে আনন্দ পাবলিশার্স)