আমি মিরজা গালিব ভালবাসি। যখন খুব ছোট ছিলাম, তখন প্রথম দূরদর্শন এই অসাধারণ কবিকে নিয়ে একটা সিরিয়াল দেখাত। সিরিজটা যাঁর সৃষ্টি, তিনি আমার আর এক প্রিয় সাহিত্যিক গুলজার সাব। ওই বয়সে কবিতার কিছুই বুঝতাম না। কিন্তু জানি না কেন, সিরিয়ালটা নেশা হয়ে গিয়েছিল। হতে পারে গালিবের চরিত্রে গুলজার সাব এবং নাসিরুদ্দিন শাহ সাব যে বিশুদ্ধতা এনেছিলেন, তার জন্য। হয়তো এর পিছনে রয়েছে আমার ইতিহাস-প্রীতি।
অসাধারণ ওই সিরিজের পুরো ডিভিডি সেটটা আমার কাছে আছে। একাধিক বার সেগুলো দেখেওছি। এখন কি সেটার মানে বুঝতে পারি? ব্যাপারটা কী জানেন? গালিব বোঝার জিনিস নয়। অনুভব করার জিনিস।
আমি নাস্তিক নই। তবে ধর্ম এবং ঈশ্বর নিয়ে গালিবের কিছু চিন্তাভাবনা আমার খুব ভাল লাগে। রাজস্থানের বিরুদ্ধে ম্যাচের আগের দিন বন্ধুদের সঙ্গে বেরোচ্ছিলাম। গন্তব্য আবু ধাবির বিখ্যাত শেখ জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদ। কেকেআরের এক সতীর্থ শুনে বলল, “ভাল আইডিয়া গোতি। ওখানে গিয়ে কেকেআরের জন্য খুব ভাল করে প্রার্থনা করো। মনে হয় ঈশ্বর আমাদের উপর অখুশি।”
‘খুব ভাল করে প্রার্থনা’ করার প্রস্তাবটা শুনে হেসে ফেলেছিলাম। আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি ঠিকই। কিন্তু কোনও দিন ধর্মীয় স্থানে কোনও দাবি নিয়ে গিয়েছি বলে মনে পড়ছে না। তবে তখন আমাদের কঠিন সময় চলছে। চারটে ম্যাচে আমার মিলিত স্কোর ১। টিম চারটের মধ্যে জিতেছে দুটো ম্যাচ। আর একটা ম্যাচ জিততে পারলে হিসেবটা দাঁড়াবে পাঁচের মধ্যে তিন। যেটা শুনতে অনেক বেশি ভাল লাগে। তা হলে আমি করব? না, করব না? ভাবার চেষ্টা করলাম আমার জায়গায় থাকলে গালিবের প্রতিক্রিয়া কী হত। হয়তো উনি বলতেন, ‘যব সজদে মে নহি গয়ে, তো শিকওয়া ভি না কিয়া।’ অনুবাদের চেষ্টা করছি— ‘আমি পূজো করিনি, তাই নালিশও করব না।’
মসজিদের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে উপরের দিকে এক বার তাকালাম। সন্ধের গেরুয়া আকাশের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে রাজসিক, দুধসাদা মসজিদটা। গম্বুজগুলোর উপর ঝলমলে সোনালি মুকুট। সামনে নীল জলাশয়ের ঝর্নায় অপূর্ব ঐকতান। ভাবছিলাম ঈশ্বর কি চিত্রকর? নাকি সঙ্গীতশিল্পী? ভেতরে ঢোকার সময় আবার মনে হল, গালিব এখানে থাকলে কী বলতেন?
প্রধান প্রার্থনা-কক্ষে দাঁড়িয়ে চার দিকের লোকজন দেখছিলাম। বেশির ভাগই পর্যটক, ফোনের মেগাপিক্সেল ক্যামেরা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে ব্যস্ত। আজ রাতে ফেসবুকে দারুণ ব্যস্ততা থাকবে, ভাবতে ভাবতে চোখ বন্ধ করলাম। প্রার্থনায় মন দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু তার পর অতীত ব্যর্থতা আর ভবিষ্যৎ আকাঙ্খা নিয়ে ভাবনাচিন্তা লড়াইটা জিতে গেল। বর্তমান থেকে তখন আমি অনেক অনেক মাইল দূরে। প্রায় ৪০-৫০ সেকেন্ড ধরে হারা দুটো ম্যাচের শেষ মুহূর্তগুলো নিয়ে ভাবলাম। তার পর এল আমার নিজের আউট হওয়ার হাইলাইট্স ০, ০, ০ আর ১। এই ব্যাপারটাকে পাল্টাতে চাইছিলাম। “ঝাড়লন্ঠনগুলো অসামান্য,” অন্য এক দর্শনপ্রার্থীর মন্তব্য এক ঝটকায় আমাকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনল।
আবার চোখ বন্ধ করলাম। যে ভাবে সব সময় প্রার্থনা করি, এ বার সে ভাবেই প্রার্থনা করলাম। ‘খুব ভাল করে প্রার্থনা’ নয়, কোনও স্বার্থপর দাবি নয়। ঈশ্বরের কাছে শুধু সৎ একটা প্রার্থনা আমাকে সাফল্যের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার মতো বুদ্ধি দিন। আর ব্যর্থতা সহ্য করার ধৈর্য। আমি ধারাবাহিক হতে চেয়েছিলাম। গালিব সাবও মনে হয় সেটাই চাইতেন।
মঙ্গলবার যখন রাজস্থানের ১৫২ তাড়া করছিলাম, তখন মসজিদের সব স্মৃতি আবছা হয়ে গিয়েছে। বাউন্ডারির হিসেবে ম্যাচটা হারার পরে আবার ওটা মনে পড়ল। আমি কি নিজেকে বদলাব? আরও ভাল করে প্রার্থনা করব? বোধহয় না। আমি আরও কঠোর পরিশ্রম করব, একই ভাবে প্রার্থনা করব।
ডাল-ভাতের প্লেটটা নিয়ে ড্রেসিংরুমে বসে বসে ইতিবাচক সব কিছু নিয়ে ভাবছিলাম। সূর্যকুমার যাদব দুর্দান্ত ব্যাট করেছে। সাকিব আল হাসান অল-রাউন্ড ভাল খেলেছে। পয়েন্ট টেবিলে চারেই কেকেআর। আমিও রান পেয়েছি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, আমি ডাল-ভাত খাচ্ছি, ক্রিকেটার হিসেবে আমার ভাল একটা জীবন আছে, সস্নেহ পরিবার আর কয়েক জন খুব ভাল বন্ধু আছে। আর হ্যাঁ, গালিব সাবের মতো আমিও কারও কাছ থেকে টাকা ধার করিনি।