রবিবার বৈঠক শেষে সাংবাদিক সম্মেলনে ডালমিয়া।—নিজস্ব চিত্র।
রাজ্যের ক্রিকেট প্রশাসনে রবিবার সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের আনুষ্ঠানিক আগমনকে ঘিরে মধুচন্দ্রিমার প্রথম প্রহর অন্তর্হিত সর্বনাশা আতঙ্কে।
বরং রবিবার সিএবির বার্ষিক সভার শেষে প্রবল আশঙ্কা উঠে পড়ল সিএবি-তে জগমোহন ডালমিয়া প্রশাসনের ভবিষ্যত্ নিয়ে! প্রশ্ন উঠে গেল, রাজ্য সরকার কী চায়? সিএবি প্রেসিডেন্টের চেয়ারে জগমোহন ডালমিয়াকে তারা চায়, না চায় না? সিএবি সুপ্রিমো ডালমিয়াকে তো সরকারের হেভিওয়েট প্রতিনিধি স্পষ্ট বলে দিলেন, আপনার এত দিনের শাসন-প্রণালী ভুল। নির্বাচনী সভা এ ভাবে হয় না। অপ্রতিদ্বন্দ্বী বলে নিজেই নিজেকে সিএবি প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে দিতে পারেন না আপনি! অন্য কাউকে সেটা করতে হবে। কারণ পার্লামেন্টারি পদ্ধতি সেটাই বলে।
বক্তা রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী, সুব্রত মুখোপাধ্যায়। রবিবারই সিএবির বার্ষিক সভায় যিনি প্রথম এলেন। সিএবি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যাঁর সুসম্পর্কের কথা ময়দান জানে। দ্রুতই শোনা গেল, সাংসদ সুব্রত বক্সীরও নাকি সমর্থন ছিল তাতে।
নাটকের দুই চরিত্রের মধ্যে নরমপন্থী সুব্রত বক্সী। আনন্দবাজারের কাছে তিনি এই নিয়ে কোনও মন্তব্যে যেতে চাইলেন না। শোনা গেল ঘনিষ্ঠমহলে বলেছেন যে, তিনি এ নিয়ে বিশাল প্রতিবাদ মোটেও তোলেননি। কিন্তু সুব্রত মুখোপাধ্যায় চরমপন্থী। এবং বলেছেন, ব্যাপারটার হেস্তনেস্ত করে ছাড়বেন। “আমি দেখব যাতে আইনটা বদলায়। ছাড়ব না। প্রশাসক ডালমিয়াকে নিয়ে আমার কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু সিএবি যে পদ্ধতির কথা বলেছে, তা অর্থহীন। যে নিজেই প্রার্থী, সে কী ভাবে নির্বাচন কনডাক্ট করবে? এটা তো সাধারণ জ্ঞানের ব্যাপার,” বলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়।
সিএবি কর্তাদের কাছে রাতেও পুরো ব্যাপারটা বিস্ময়কর ঠেকছিল। তাঁরা আন্দাজই করতে পারেননি যে, আক্রমণ এ ভাবে আসতে পারে। বিশেষ করে পঞ্চায়েতমন্ত্রী যখন সিএবি প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। বৈঠকে একটা সময় তো পরিস্থিতি এমন হল যে ডালমিয়াকে বলতে হল, “আমাকে নিয়ে এত কিছু হচ্ছে দেখে খুব খারাপ লাগছে। লজ্জিত লাগছে। আপনারা ঠিক করুন, কী করবেন না করবেন!”
বৈঠকে ডালমিয়া পদাধীকারীদের নাম ঘোষণার সময়ই বিপত্তিটা বাঁধে। বালিগঞ্জ ইউনাইটেডের প্রতিনিধিত্ব করতে আসা সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলে ওঠেন, আপনি নিজেই কী ভাবে নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করে দিচ্ছেন? পার্লামেন্টারি প্রসিডিওর সেটা বলে না। আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী না-ই থাকতে পারে। কিন্তু অন্য কারও উচিত আপনার নাম ঘোষণা করা। ডালমিয়া তখন বলেন যে, গত ১৯ জুলাই ঠিক হয়ে গিয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে কোনও প্রার্থী নেই। অতএব তিনি যে সিএবি প্রেসিডেন্ট পদে থাকছেন, সে দিনই সেটা ঠিক হয়ে গিয়েছিল। আর তিনি যা করছেন, সবই সিএবি সংবিধান মেনে। সিএবি সুপ্রিমোর সমর্থনে আর এক প্রভাবশালী কর্তা সুব্রত দত্ত তখন বলতে থাকেন, সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টে সিএবি নথিভুক্ত। তাই প্রেসিডেন্ট বেআইনি কিছু করছেন না। পঞ্চায়েতমন্ত্রীর সমর্থনে তখন আবার নাকি পাল্টা উঠে দাঁড়ান সাংসদ সুব্রত বক্সী। এবং আচমকা তরজার সামনে পড়ে বিহ্বল হয়ে যান ডালমিয়া। রাজ্যের আবাসন ও যুবকল্যাণ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের মধ্যস্থতায় ব্যাপারটা তখনকার মতো মেটে। অরূপ বলে দেন, সিএবি এত দিন যে নিয়ম মেনে এসেছে, সে অনুযায়ীই এটা হয়েছে। এটা নিয়ে টেকনিক্যাল বিতর্ক থাকতেই পারে, কিন্তু এখনকার মতো এটাই কনভেনশন, এটাই নিয়ম। এ বারের মতো পুরনো নিয়মই বহাল থাকুক। অরূপ এটা বলায় সমবেত হাততালিতে সর্বসম্মত ভাবে ডালমিয়ার নাম পাশ হয়ে যায়।
ডালমিয়ার প্রতি অরূপের সমর্থনে যদিও কিছুটা বিভ্রম সৃষ্টি হয়েছে যে, পুরো ঘটনায় কি নবান্নের সর্বাত্মক সমর্থন আছে? নাকি এটা শুধুই সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের একার অভিমত?
সিএবি কোনও ভাবে মানতে চাইছে না যে তারা আইনত কোনও ভুল করেছে। ডালমিয়া পরে বলছিলেন, “সিএবি সংবিধানে যা আছে, সে ভাবেই সব করেছি। যে কেউ আসতে পারেন, তাঁদের মতামত বলতে পারেন। সে সব পরে ভেবে দেখা যাবে।” সংস্থার কোষাধ্যক্ষ বিশ্বরূপ দে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক, “এটাই আইন। এটাই নিয়ম। নতুন আইন আবার কী? সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টে আমাদের মতো দেশের এক কোটি সংস্থা নথিভুক্ত করা আছে। তা হলে কি সবই বেনিয়মে চলছে?” কোনও কোনও সিএবি সদস্যকে আবার বলতে শোনা গেল, অতীতের ডালমিয়া হলে এ সব হত না। কিন্তু এখন তিনি আর অতটা কড়া নন। রাজ্য সরকারের আর এক সাংসদ বলে দিলেন, এত দিন সিএবির আইনকানুনে কেউ খুঁত বার করার সাহস পেত না। সুব্রতবাবু সেটা বার করে দিলেন। বলা হল, কী ভাবে বৈঠকে ডালমিয়া বলতে পারেন, আমি একটা মাত্র মনোনয়ন পেয়েছি। সেটা আমার। তাই আমিই প্রেসিডেন্ট হচ্ছি। যখন অতীতে প্রেসিডেন্ট ইলেকশনের ব্যাপারটা দেখতেন ভাইস প্রেসিডেন্ট।
সিএবি শুনে আবার পাল্টা দিল। সিএবি কর্তাদের বক্তব্য, একমাত্র যদি নির্বাচন হয় সে ক্ষেত্রেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নির্বাহ করেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। ২০১২-এ শেষ বার যা ঘটেছে। সমর পাল যে বার ডালমিয়ার বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থী হয়েছিলেন। আরও যোগ করা হল, ২০০৬-এর নির্বাচনের সময় হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে নিয়োগ করেছিল সিএবি। তিনি তখন দেখে বলেছিলেন, সিএবির আইন ঠিকই আছে। তা হলে তো বলতে হয়, আইন ভুল। সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টটাই ভুল।
পাকেচক্রে পড়ে আসল প্রশ্নটাই কার্যত গৌণ হয়ে গেল গেল। রবিবার যেটা হওয়াই উচিত ছিল। কিন্তু প্রশাসক সৌরভ কতটা সফল হবেন, সেই প্রশ্নটাই কাউকে তুলতে দেখা গেল না!