রক্ষণের দুই স্তম্ভ থিয়াগো ও দাভিদ
বিশ্বকাপ শুরু হতে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা। আর প্রথম ম্যাচেই ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে নামছে আমার ফেভারিট দল ব্রাজিল!
আসলে কঙ্কাল ছাড়া যেমন দেহ হয় না, তেমনই ব্রাজিল ছাড়া বিশ্বকাপ ফুটবলটাও হয় না বলেই আমার অন্তত মনে হয়। অথচ মজার ব্যাপার এটাই যে আমাদের শৈশবে ফুটবল শিক্ষার সময় এই ব্রাজিলম্যানিয়া ব্যাপারটা কিন্তু একদমই ছিল না। কারণ সেই সময়ে আমাদের দেশে টিভি না থাকায় কী ব্রাজিল, কী মারাকানাসবই ছিল আমাদের অজানা। আর আমাদের ফুটবল শিক্ষার অ, আ, ক, খ—সবই ছিল ব্রিটিশ ঘরানার। অর্থাৎ সেই লং বল থিওরি। আমার মেন্টর বলাইবাবুর (প্রয়াত বলাইদাস চট্টোপাধ্যায়) কাছ থেকে চোখ বড় বড় করে শুনতাম কলকাতা ময়দানে পল কলভিন বনাম গোষ্ঠ পালের লড়াই। আরও একটু বড় হওয়ার পর শুনলাম স্ট্যানলি ম্যাথেউজ, টম ফিনে, টনি লটনদের নাম।
খবরের কাগজে তখন একটুআধটু চোখ রাখার সুবাদে জানতে পেরেছি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বকাপের আসর বসেছিল ব্রাজিলে। আমার দেশ বুট পরে খেলতে অভ্যস্ত না হওয়ায় সেখানে যেতে পারেনি। ওখানে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে উরুগুয়ে। ব্যস, এটুকুই তখন আমার বিশ্বকাপ জ্ঞান। মারাকানায় ব্রাজিলের সেই দুঃখের দিনের ‘মারাকানাজো এপিসোড’ জেনেছি বহু পরে। সত্তর দশকে এসে।
ব্রাজিল নামটা ফের শুনলাম ১৯৫৪ সালে। তত দিনে পুসকাস, হিদেকুটি, ককসিস, জিবরদের হাঙ্গেরিকে জেনে ফেলেছি। সে বারের বিশ্বকাপের মাঝেই কলকাতার ইংরেজি কাগজে বড় বড় করে হেডিং হল ‘ব্যাটল অব বার্ন’— পড়ে জানলাম কোয়ার্টার ফাইনালে হাঙ্গেরি-ব্রাজিল দ্বৈরথে দু’দলের ফুটবলারদের রক্তক্ষয়ী মারপিট। সে বারই প্রথম শুনলাম ব্রাজিলের ডিডি, ভাভা, জালমা সান্তোসদের নাম। চার বছর পরে বয়সটা আরও একটু বাড়ল। ভারতীয় ফুটবলের মূলস্রোতে তখন গা ভাসিয়ে দিয়েছি। ঠিক সেই সময় ১৯৫৮-র বিশ্বকাপে ফুটবল দেবতা বোধহয় আমার বিশ্ব ফুটবলের জ্ঞান আরও প্রসারিত করতে দুই দেবদূতকে পাঠালেন— পেলে আর গ্যারিঞ্চা। খবরের কাগজের সৌজন্যে সুইডেনের ফুটবল মাঠে এই দুই তরুণ ফুটবলারের নানা কেরামতির গল্প শুনে আমিও ব্রাজিলের ইন্দ্রজালে সেই যে আটকে গেলাম, আর বেরোতে পারিনি।
কী সব গল্প! রাশিয়ার বিরুদ্ধে জীবনের প্রথম বিশ্বকাপ ম্যাচ খেলতে নেমে ব্রাজিলের জাতীয় সঙ্গীতের সময় গ্যারিঞ্চা নাকি হাসছিল। নিলটন সান্তোস অবাক চোখে তাকালে গ্যারিঞ্চা বলে, “ম্যাচ নিয়ে ভেবো না। ওটা জিতবই। ওদের গোলকিপারের গোঁফটা চার্লি চ্যাপলিনের মতো লাগছে না!” ভাবুন একবার। নিজের দেশের হয়ে আমিও অলিম্পিকে খেলেছি। জানি, এই সব ম্যাচের হাইপ। সেখানে এত হাল্কা থাকা যায়? পেলে-গ্যারিঞ্চা তার পরে বিশ্ব ফুটবল কী ভাবে দাপিয়েছে তা ইতিহাস। সবাই তা জানে। রোমাঞ্চকর এই ফুটবলের জন্যই ব্রাজিল বাঙালি ফুটবল জনতার হৃদয়ে।
ব্রাজিল মানেই ফুটবল, ফুটবল আর ফুটবল। পেলে থেকে জিকো, কারেকা থেকে রোমারিও, রোনাল্ডো-রোনাল্ডিনহো থেকে আজকের নেইমার-অস্কার সবাই এক-একটা আস্ত বিনোদন। গতি, পজেসন, ড্রিবল, পাসিং সব কিছুতেই অন্যদের চেয়ে আলাদা। চোখ ধাঁধানো কারিকুরি। যে রকম আমাদের সাত্তার, আমেদ খান, ভেঙ্কটেশরা মাটিতে বল রেখে স্কিলফুল ফুটবল খেলত, তার সঙ্গে ওদের খেলার মিল খুঁজে পাই।
বিরাশিতে মাঠে বসে দেখেছিলাম ব্রাজিল-ইতালি ম্যাচটা। তেলে সান্তানার সেই ব্রাজিল টিমটায় জিকো, সক্রেটিস, ফালকাও— কাকে ছেড়ে কাকে রাখব! কিন্তু ওরা পাওলো রোসির কাছে হেরে যাওয়ার পর দেখেছিলাম হলুদ জার্সি পরা সমর্থকদের কান্না। ঠিক সে ভাবেই নব্বইয়ে গ্যালারিতে বসে দেখেছিলাম ব্রাজিল-আর্জেন্তিনা ম্যাচ। মারাদোনার পাস থেকে কানিজিয়ার গোলে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেলেও ব্রাজিল সমর্থকদের গুন্ডামি বা জাতীয় পতাকার অবমাননা করতে দেখিনি। চুরানব্বইয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোজ বোল স্টেডিয়ামে রোমারিওর ব্রাজিলকে চ্যাম্পিয়ন হতে দেখেছিলাম নিজের চোখে। সেই রাতে বুঝেছিলাম ফুটবলটা ওদের কাছে সত্যিই ঈশ্বর!
শেষ বার ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিতেছে এক যুগ আগে। যে পজেশনাল এবং পাসিং গেমের জন্য ব্রাজিলকে ভাল লাগে, মানছি সেই খেলাটা আজ স্পেন প্রায় হাইজ্যাক করে নিয়েছে। তা সত্ত্বেও বলব এ বারের বিশ্বকাপেও স্কোলারির দলেক উপেক্ষা করা যাবে না। এত দিন ওদের রক্ষণটা ভোগাত। এ বার থিয়াগো সিলভার নেতৃত্বে ওদের রক্ষণ চমৎকার। বিশেষ করে দুই সাইড ব্যাক দানি আলভেজ এবং মার্সেলো। রক্ষণের সঙ্গে আক্রমণটাও ওরা চমৎকার বজায় রাখছে। যা গত বছর কনফেডারেশনস কাপের সময় থেকেই দেখে আসছি। আর ওরা ওভারল্যাপে গেলে পওলিনহো এবং লুইস গুস্তাভো রক্ষণ সামাল দেওয়ার জন্য তৈরি। সুতরাং ওদের রক্ষণকে বোকা বানিয়ে গোল করা বেশ কঠিন। আর মাঝমাঠে তো অস্কার পেন্ডুলামের মতো এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত জুড়ে খেলা তৈরি করে। গোল করার জন্য নেইমার, হাল্ক, ফ্রেড তো নিজের দিনে একাই একশো। বিশেষ করে বাঁ দিকে নেইমার-মার্সেলো যুগলবন্দি।
বিশ্বকাপে এ বারের ব্রাজিল তাই ব্যালান্সড টিম। সব কিছু ঠিকঠাক চললে স্কোলারির দল ফাইনালে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। আর তা যদি না হয়, সেটা এই বিশ্বকাপের বড় অঘটন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
যদি বিরাশি, ছিয়াশি বা গত বারের মতো নক আউটের শুরুতে বিশ্বকাপ থেকে ব্রাজিলের বিদায় হয়ে যায়? তা হলেও ব্রাজিল ব্রাজিলই থাকবে। কারণ, হারলেও ফুটবলের মহাকাব্যে ব্রাজিল পরাজিত বীর। কর্ণ, ইন্দ্রজিতের মতো। যাদের ক্যারিশমা কখনও মলিন হয় না।
ব্রাজিল বনাম ক্রোয়েশিয়া। সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন।