সুখের রাজধানীতেই অসুখী রোনাল্ডো

বিদেশি পর্যটকদের এত বছরের রেটিং অনুযায়ী পোর্তো দ্য বারা হলো ব্রাজিলের তৃতীয় শ্রেষ্ঠ সমুদ্র সৈকত! বিচের ছিমছাম, সুশ্রী নির্জনতা মাপলে সালভাদরের সমুদ্রতটই এক নম্বর। অতলান্তিক যেখানে আছড়ে পড়ছে, তার ঠিক পেছনেই আবার ফুটবল মাঠ। এ দিকে বালিতে জোর কদমে বিচ ফুটবল চলছে। পাশের মাঠে ঘাসের ওপর। রাস্তার মাঝখানে যেখানে ব্যুলেভার্ডের সৌন্দর্য থাকতে পারত, সেখানে আছে কিনা খোলা টেনিস কোর্ট! বিশ্বের আর কোনও সি-বিচে ফুটবল, বিচ ফুটবল আর টেনিসের এমন ত্রিবেণীসঙ্গম নেই। আর কোনওটাই গায়ে ঠোকাঠুকি করে নয়। পর্যাপ্ত জায়গা রেখে।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

সালভাদর শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৪ ০৩:৪৭
Share:

রোনাল্ডোদের চূর্ণ করে ফেরা মুলার, লো-র সাংবাদিক সম্মেলন।

বিদেশি পর্যটকদের এত বছরের রেটিং অনুযায়ী পোর্তো দ্য বারা হলো ব্রাজিলের তৃতীয় শ্রেষ্ঠ সমুদ্র সৈকত!

Advertisement

বিচের ছিমছাম, সুশ্রী নির্জনতা মাপলে সালভাদরের সমুদ্রতটই এক নম্বর। অতলান্তিক যেখানে আছড়ে পড়ছে, তার ঠিক পেছনেই আবার ফুটবল মাঠ। এ দিকে বালিতে জোর কদমে বিচ ফুটবল চলছে। পাশের মাঠে ঘাসের ওপর। রাস্তার মাঝখানে যেখানে ব্যুলেভার্ডের সৌন্দর্য থাকতে পারত, সেখানে আছে কিনা খোলা টেনিস কোর্ট! বিশ্বের আর কোনও সি-বিচে ফুটবল, বিচ ফুটবল আর টেনিসের এমন ত্রিবেণীসঙ্গম নেই। আর কোনওটাই গায়ে ঠোকাঠুকি করে নয়। পর্যাপ্ত জায়গা রেখে।

সালভাদর এক সময় ব্রাজিলের রাজধানী ছিল এবং রাজধানী হয়েও স্থপতিদের চেয়ে বোধহয় খোলা জায়গাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছে। মঙ্গলবার সেখান দিয়ে এরিনা ফন্তে নোভা অভিমুখী হওয়ার সময় মনে হচ্ছিল, সমুদ্র এই নতুন তৈরি স্টেডিয়াম থেকে অনেকটা দূরে ঘন বসতিপূর্ণ এলাকায় হয়েও সেই খোলা জায়গাটাকেই তো মাঠে তুলে আনল। বিশ্বব্যাপী কোচ এবং স্থপতিরা যে কমন লোভনীয় জায়গাটার জন্য ছোঁকছোঁক করে থাকেন, সেই ওপেন স্পেস কাজে লাগিয়েই তো ক্যুপ দ্য মুন্দে শিহরন ফেলে দিয়েছে জার্মানি!

Advertisement

চব্বিশ ঘণ্টা হয়ে গেল সিআর সেভেনদের পর্যুদস্ত হওয়ার। আয়োজক দেশ নিজেরা সেই সময়ের মধ্যে ফোর্তালেজায় মাঠে নেমেছে। অথচ সালভাদর উপকূলে সোমবারের হ্যাংওভার কিছুতেই যেন যাওয়ার নয়। স্বয়ং মারাদোনা টিভিতে খেলা দেখে ভেনেজুয়েলার টিভি চ্যানেলকে বলেছেন, জার্মান পারফেকশন দেখে তিনি স্তম্ভিত। লোথার ম্যাথেউজ মুগ্ধ বিস্ময়ে জার্মান টিমের প্রশংসা করে বলেছেন, এরা কাপ জেতার দাবিদার। যে শহরে সুপার ভিভিআইপিদের মধ্যেই এই চূড়ান্ত জার্মান আগ্রাসন ঘটল, সেখানকার হাওয়ায় তার টাটকা রেশ তো থাকবেই।

স্টেডিয়ামে মিশেল প্লাতিনি আর সেপ ব্লাটার ছাড়াও ছিলেন জার্মান চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেল। ছিলেন ফিগো। ছিল আবেগ এবং সমর্থক-অঙ্কে অনেক বেশি এগিয়ে থাকা পর্তুগাল। ঢাক এই শহরের সবচেয়ে ফেভারিট বাদ্যযন্ত্র। সেটা এবং মাদল জাতীয় আরও নানান কিছু আনা হয়েছিল স্টেডিয়ামে। সেগুলো নীরবই থেকে গিয়েছে। বরং জার্মান সমর্থকেরা মঙ্গলবার সকালেও শহরের রাস্তায়-রাস্তায় তীব্র উল্লাস করে গেলেন ‘মুলার মুলার’ বলে। কী বাজখাঁই চিৎকার তাঁদের! রোনাল্ডো সম্পর্কেও কিছু একটা বলছিলেন, বুঝতে পারিনি। তবে হাত দিয়ে যে সঙ্কেত করতে দেখলাম তার বঙ্গানুবাদ ওহে রোনাল্ডো, পাতালপ্রবেশ করো!

পর্তুগালের কাপ-ভাগ্য কিন্তু সত্যিই পাতালপ্রবেশের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। ইংল্যান্ড, উরুগুয়ে, ইতালিকে নিয়ে গ্রুপ ডি যে অর্থে মৃত্যুগুহা, রোনাল্ডোদের জি গ্রুপ যদিও মোটেও তা নয়। বাংলা হিসেবে ঘানা আর যুক্তরাষ্ট্র, দুটো ম্যাচ জিতলেই হল। ঘানার বিখ্যাত ওঝা কোয়াকু বনসাম অবশ্য আগাম হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন যে, তিনি রোনাল্ডোর ওপর ঘানা ম্যাচে ব্ল্যাক ম্যাজিক করছেন। চারটে মৃত কুকুর নিয়ে যজ্ঞ হচ্ছে। রোনাল্ডোর ছবির গায়ে শয়তানের বিশেষ পাউডার ঘষা চলছে। এগুলো সমস্যা নয়। দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠলে বিপক্ষে পড়বে হয় বেলজিয়াম, নয় রাশিয়া। তারাও কেউ আর্জেন্তিনা, নেদারল্যান্ডস বা ব্রাজিল নয়! কোয়ার্টার ফাইনাল অবধি রুট ম্যাপ মোটেও আমাজনের গভীর জঙ্গল নয়!

তা হলে?

সমস্যা আসলে রোনাল্ডোর নিজের টিমে। পেপে-র লালকার্ড। ফাবিও কোয়েন্ত্রাও-র চোট। ফরোয়ার্ড লাইনে নানি চূড়ান্ত অফ-ফর্মে। আলমেইডা একটা বল বাড়াতে পারছেন না। কাল একটা সময় তো বল না পেয়ে রোনাল্ডো চেঁচামেচি করাই শুরু করেন। হাফটাইমের একটু আগে দেখলাম ক্যাপ্টেনের আর্মব্যান্ড খুলে ক্ষোভে মাঠ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। কোচ পাওলো বেন্তো বুঝিয়ে-বাঝিয়ে তাঁর মাথা ঠান্ডা করেন।

এটা নিছকই এক দিন খারাপ খেলে ম্যাচ হারা হলে এত দীর্ঘস্থায়ী হতো না প্রভাব। আসলে কাল তো নিছক একটা টিম আর একটাকে ৪-০ হারায়নি। দু’টো টিমই নিজস্ব পারফরম্যান্সে দুটো বিবৃতি দিয়েছে।

জার্মানি: আমরা চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের দাবিদার এবং দৌড়ের এখনও অনেক বাকি। কিন্তু লাতিন আমেরিকায় ইউরোপের দল জেতে না, এই মিথটা এ বার আমরা চুরমার করতে চাই।

ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো: আমার দলের নাম পর্তুগাল হলেও সবটাই আমি। হারলেও রোনাল্ডো। জিতলেও রোনাল্ডো। আর আমার চিরকালীন স্বপ্নই খানখান হয়ে টিম-সহ আমি বেরিয়ে যেতে পারি বিশ্বকাপ থেকে।

সালভাদর এমনই আমুদে, খোলামেলা আর অনর্গল শহর যে, তাকে বলা হয় ব্রাজিলের সুখের রাজধানী। সেই শহরই কিনা বিশ্বের এক নম্বর ফুটবলারের কাপ-ভাগ্যের নেটওয়ার্কে চির অসুখ রেখে দেওয়ার সিগন্যাল পাঠিয়ে রাখল। সার্বিয়ান রেফারিকে প্রকাশ্যে এত দুষল পর্তুগাল! অথচ ম্যাচ রেকর্ড বলছে গোটা ম্যাচে রোনাল্ডোকে ফাউল করা হয়েছে মাত্র দু’বার। তাঁর পাহারায় যিনি ছিলেন, সেই জার্মান রাইট-ব্যাক জেরোম বোয়াতেং বরং ডান দিক দিয়ে ওভারল্যাপ করেছেন। পর্তুগাল গোলমুখে ক্রস রেখেছেন একাধিক বার। মার্কার যদি এত ওভারল্যাপে যেতে পারে, তা হলে তিনি বিশ্বকাপ পর্যায়েও এক নম্বর না ক্লাব পর্যায়ের এক নম্বর, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই।

উঠছেও। সিআর সেভেনের ক্যাপটিভ অডিয়েন্স ওয়েবে বলাবলি শুরু করেছে, তিরিশ বছর বাদে যখন মেসির সঙ্গে লড়াইয়ের চূড়ান্ত মূল্যায়ন হবে, তখন তো এ বারের বিশ্বকাপটাই তাঁর নির্ধারক হবে। চার বছর বাদে রাশিয়া বিশ্বকাপের সময় রোনাল্ডোর বয়স হবে তেত্রিশ। ধরে নেওয়া যায় এটাই শেষ। অতএব সিভি-র যে জায়গাটা একই রকম উজ্জ্বল নয়, সেটা আগামী দশ দিনেই যা ঠিক করার করতে হবে।

বেশ কয়েক মাস ধরে জল্পনা চলেছে পর্তুগাল-জার্মানি মেগা ম্যাচের ভাগ্য নিয়ে। তখন ভাবা হয়েছিল, পরিবেশের সাহায্যটা রোনাল্ডোদের পক্ষে যাবে। ম্যাচ যে পড়েছে দুপুর একটায় এবং ফুটবল ইতিহাস বলছে, জার্মানরা সব পারে। শুধু গরমটা ম্যানেজ করতে পারে না।

প্রত্যাশা মতো আবহাওয়ার রেফারিং সোমবার রোনাল্ডোদের পক্ষেই ছিল। খেলা হল তিরিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস সমন্বিত ভূমধ্যসাগরীয় গরমে। পর্তুগাল সমর্থকেরা আশায় ছিলেন, সুইডেনে গত নভেম্বরের হাড়-কাঁপানো ঠান্ডার মধ্যে বিশ্বকাপের প্লে-অফ ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেছিলেন রোনাল্ডো। সালভাদরের গরম তো সেখানে নস্যি!

রোনাল্ডো নিজেও তো নানা ভাবে প্রাণপণ তৈরি হয়েছেন প্রথম রাউন্ডের ডার্বি ম্যাচের জন্য। সে দিন ইংরেজি সাবটাইটেল দিয়ে সিআর সেভেনের ইন্টারভিউ চলছিল নিজের দেশের টিভি নেটওয়ার্কে। যেখানে বলছিলেন, “জার্মানদের জন্য আমি গুছিয়ে তৈরি।” রোনাল্ডোকে মাঠে দেখলেও বোঝা যায়, তাঁর মধ্যে সব সময় একটা এক নম্বরে থেকে যাওয়ার রোখ কাজ করে। জার্মানি চার গোলের মাধ্যমে যে বিবৃতিটা দিল, সেটা বিশ্বকাপে তিনি দেবেন বলেই না এত দিন অদম্য খেটেছেন! হাঁটুতে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বেঁধেও প্র্যাকটিসে কামাই দেননি।

তিন ফুটবল মহানায়ক ব্রাজিল বিশ্বকাপের প্রথম চার দিনে তাঁদের ওপেনিং সিকোয়েন্স দেখালেন। বন্ডের ছবির প্রথম দৃশ্যে যেমন একটা ডায়লগ থাকবেই দ্য নেম ইজ বন্ড, জেমস বন্ড। সেই শন কনারি থেকে রজার মুর, পিয়ার্স ব্রসনান থেকে ড্যানিয়েল ক্রেগ সবাই এক উদ্বোধনী সংলাপ বলেছেন। কিন্তু আজও সেরা উদ্বোধনী লাইনটা ঠোঁটে সিগারেট ঝুলিয়ে শন কনারিরই কিনা, তা নিয়ে মতামতের যুদ্ধ চলে।

ব্রাজিল বিশ্বকাপে মহাতারকাদের ওপেনিং সিকোয়েন্সটাও তো বন্ডের ছবির মতোই যার-যার পারফরম্যান্স। যার ওপর বিশ্বব্যাপী ফুটবল ভক্তদের অনন্ত কাটাছেঁড়া শুরু হয়ে গিয়েছে। আর তাতে সবার আগে থেকে গেলেন নেইমার। মেসি বা রোনাল্ডোর চেয়ে টেনশনে তাঁকে অনেক কম আক্রান্ত দেখিয়েছে।

তার একটা কারণ অবশ্যই হতে পারে কম বয়স। নেইমার জানেন, চার বছর পরেও তাঁর দরজা খোলা থাকবে। মেসি বা রোনাল্ডো নিশ্চিত নন। ক্লাব ফুটবলে নিজেদের আর প্রমাণ করার কিছু নেই। কিন্তু দেশের হয়ে রাজমুকুট পরার এটাই শেষ সুযোগ। দেশের চাপটা অনেক বেশি। টেনিস সার্কিটে এই জন্য মহাতারকারা সাধারণত ডেভিস কাপ খেলতে চান না। ভয় পান ডেভিস কাপ সিন্ড্রোমের। যে ভীতি বলে, সার্কিটে নিজেকে সামলাতে পারি! একটা আস্ত দেশের চাপ নেব কী করে?

মেসি তো তবু একটা গোল করে উদ্বোধনী সংলাপটা উতরে দিয়েছেন। তাঁর সামনে এখন ইরান আর নাইজিরিয়া। রোনাল্ডো পাচ্ছেন চোটগ্রস্ত, অবিশ্বাসী দল আর সম্ভাব্য সমালোচকদের দাঁত-নখ। ক্লাব সেরা মানেই বিশ্বসেরা নয়, এই দর্শনের টেস্ট-টিউব বেবিও তাঁকেই করা হবে বলে সবাই তৈরি রয়েছে।

ডেটলাইন ২৬ জুন। সিআর সেভেনের অসুখী জীবন গ্রুপ লিগের শেষ ম্যাচের দিন বদলায় কি না, গোটা বিশ্ব রোমাঞ্চিত হয়ে দেখবে!

ছবি: গৌতম ভট্টাচার্য

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement