রইল বাকি এক রে

সিবেলেস ফাউন্টেন নামে মাদ্রিদ শহরে একটা নির্দিষ্ট জায়গা রয়েছে রিয়াল সমর্থকদের জন্য! টিম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ চ্যাম্পিয়ন হোক বা বায়ার্নের বিরুদ্ধে জমকালো সেমিফাইনাল জিতে উঠুক, উচ্ছ্বাস প্রকাশের এটাই পীঠস্থান। প্লেয়ারদের জন্য যেমন হোটেলে নির্দিষ্ট টিমরুম, তেমনই এটা হল টিম সাপোর্টার্স লোকেশন। তফাতের মধ্যে, উৎসবে অংশ নেওয়ার জন্য শুধু সমর্থকেরা নন, রোনাল্ডোদেরও এখানে আসাটা বেসরকারি ভাবে বাধ্যতামূলক। মেলবোর্ন ক্রিকেট মাঠের কাছাকাছি এরকমই একটা খোলা জায়গা বরাদ্দ আছে অজি ক্রিকেট সমর্থকদের জন্য। এমসিজির যাবতীয় উচ্ছ্বাসের হাইলাইটস শুধু ওখানে দাঁড়ালেই দেখে নেওয়া সম্ভব! ঠিক সময়ে পৌঁছলে মাইকেল ক্লার্কদেরও পাওয়া যেতে পারে।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৪ ০৩:২১
Share:

দিল সে...। প্রতিপক্ষ দুই টিমের মালিক হতে পারেন। কিন্তু খেলার পরে আলিঙ্গনে প্রীতি ও তাঁর প্রথম ছবির নায়ক। বুধবার এমন মুহূর্তের সাক্ষী রইল ইডেন। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।

সিবেলেস ফাউন্টেন নামে মাদ্রিদ শহরে একটা নির্দিষ্ট জায়গা রয়েছে রিয়াল সমর্থকদের জন্য! টিম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ চ্যাম্পিয়ন হোক বা বায়ার্নের বিরুদ্ধে জমকালো সেমিফাইনাল জিতে উঠুক, উচ্ছ্বাস প্রকাশের এটাই পীঠস্থান। প্লেয়ারদের জন্য যেমন হোটেলে নির্দিষ্ট টিমরুম, তেমনই এটা হল টিম সাপোর্টার্স লোকেশন। তফাতের মধ্যে, উৎসবে অংশ নেওয়ার জন্য শুধু সমর্থকেরা নন, রোনাল্ডোদেরও এখানে আসাটা বেসরকারি ভাবে বাধ্যতামূলক। মেলবোর্ন ক্রিকেট মাঠের কাছাকাছি এরকমই একটা খোলা জায়গা বরাদ্দ আছে অজি ক্রিকেট সমর্থকদের জন্য। এমসিজির যাবতীয় উচ্ছ্বাসের হাইলাইটস শুধু ওখানে দাঁড়ালেই দেখে নেওয়া সম্ভব! ঠিক সময়ে পৌঁছলে মাইকেল ক্লার্কদেরও পাওয়া যেতে পারে।

Advertisement

কলকাতার নব্য সমর্থকেরও কেকেআর ও শাহরুখ নিয়ে মহোৎসবে মাতামাতির জন্য ইডেনের বাইরে এই রকম একটা জায়গার একান্ত দরকার হয়ে পড়ছে। নইলে আইপিএল ইতিহাসে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর কামব্যাকের পরেও শহর তার দলের ফাইনালে পৌঁছনো নিয়ে যে উদ্দীপনা দেখল, মাত্রার বিচারে সেটা নেহাত ম্যাড়মেড়ে।

আজ তো সেই সময়, যখন শহরের মধ্যিখানে সবচেয়ে জনবহুল এলাকায় বিলবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হবে— ‘এইট ডাউন, ওয়ান মোর টু গো।’ বা ‘রোববারের বেঙ্গালুরু— আমাদের জন্য তৈরি থেকো!’ বা ‘ম্যাক্সওয়েলের পরিণতি দেখলে, তোমরাও শক খাবে!’

Advertisement

আজকের মতো প্রথমে অসহ্য চাপে পড়া দুশ্চিন্তার ম্যাচ ২৮ রানে বার করা গেলে ইডেন এককালে তার সীমাহীন আনন্দ গ্যালারিতেই শুরু ও শেষ করত। কিন্তু আজ দিন বদলেছে। প্রজন্ম বদলেছে। আর একশো আশি ডিগ্রি বদলেছে ইডেন দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গি। বুধবার রোমাঞ্চ সিরিজের আট নম্বর ম্যাচটা জিতে ওঠার পর শাহরুখ খান যখন ডিগবাজি দিচ্ছেন, গ্যালারি জুড়ে আলোর ছোট ছোট ফুলকি। যদি মনে করে থাকেন বরাবরের মতো ইডেন গ্যালারিতে মশাল জ্বলছিল, দশে মাইনাস দুই।

ওটা মোবাইল ক্যামেরার ফ্ল্যাশের আলো। মশাল নয়। এককালে ইডেনে বসে মহিলারা উল বুনতেন...স্তূপীকৃত কমলালেবু মাঠে খাওয়া হত। কেকেআর তার সাত বছরের আইপিএল ইতিহাসে হোম গ্রাউন্ড থেকে প্রথম ফাইনালে পৌঁছোবার দিন না ছিল কমলালেবু, না উলের কাঁটা। ক্লাব হাউস আর তার আশপাশের মহিলা অধ্যুষিত স্ট্যান্ড যদি কোনও স্যাম্পল হয়, দেখা গেল বৃষ্টিতে খেলা বন্ধের সময়েও লোকে সমানে ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রামে ছবি আপলোড করে চলেছে।

সিডনি হিলের মতো ছোট টুকরো উপখণ্ড কেন ইডেনে তৈরি করা হয়নি, তার জবাবে ইডেন কর্তারা বলতেন, এটা ক্রিকেটের নন্দনকানন। অসভ্য গুলতানির জায়গা নয়। বুধবার সেখানে কিংস ইলেভেনের এক একটা উইকেট পড়া ডিজে দ্বারা আরও রঙিন হয়ে সমাদৃত হচ্ছিল। সচিনের জীবনের শেষ টেস্ট ম্যাচের আগেরটায় ফ্রি টিকিট দিয়েও মাঠে পঁচিশ হাজার লোক জড়ো করা যায়নি। সেখানে উইকডে-তে কি না চারটের সময় সত্তর হাজার লোক গা ঠোকাঠুকি করে খেলা দেখল। প্রেসবক্স থেকে এক ধাপ নেমে প্রেসরুমে পৌঁছবার জন্য যা ঠেলাঠেলি সহ্য করতে হচ্ছিল, এই মাঠে ভারত-পাক ম্যাচ ছাড়া সেই জনসংখ্যার ঘনত্ব কখনও হয়নি।

জেনারেশন ওয়াই ইডেন দর্শকের মানসিকতাও এখন আন্তর্জাতিক আর পাঁচটা খেলার দর্শকের মতো। তার কাছে এখন নিজের শহর সবার আগে। ক্রস-ভূখণ্ড পেশাদারিত্ব আগে। নাগরিকত্ব পরে। নইলে ইডেনের বরাবরের প্রিয় সহবাগকে তারা এমন ব্যারাকিং করত না। ঋদ্ধিমান বনাম মর্কেল লড়াইতেও দক্ষিণ আফ্রিকানকে এমন অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে যেত না। এই মাঠ এখন জানে তার নব্য সমর্থকের প্রথম সবকিছু! যে মনে করে, আমার শহরের গৌরব সবার আগে। মনে করে ব্যক্তি, ভৌগোলিক সীমানা বা দেশ— এসবে বরাবরের মতো আচ্ছন্ন হয়ে থাকাটা প্রাক্-পেশাদারিত্ব কনসেপ্ট। নতুন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দুনিয়ায় যা প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে।

এ বারই আশি বছরে পড়া ইডেন মাঠের উইকেটও কত বদলে বদলে এখন জেনারেশন ওয়াই। এ দিন এসআরকে যেখানে দাঁড়িয়ে আইপিএলে তাঁর বিরুদ্ধে নানান অপ্রীতিকর ভূমিকায় লিপ্ত থাকা নেস ওয়াদিয়াকে জড়াচ্ছিলেন, মাঠের সেই পশ্চিম দিক থেকেই তো হাওয়াটা আসত। আর উইকেট তৈরি করতেন সিসিএফসি মাঠের ব্রিটিশ মালি। এমনই ঘাস থাকত আর অবিরত সুইং করত যে, পঙ্কজ রায় লর্ডসে ব্যর্থ হওয়ার পর বলা হয়েছিল— “সে কী! ইডেনে এত প্র্যাকটিস করেও ইংল্যান্ডে জিরো করল!” হাল আমলের পিচ একেবারেই ঢিমে। গঙ্গার হাওয়া যে বহুদিনই কংক্রিটে অবরুদ্ধ। খুব সঙ্গত কারণেই কেকেআর স্পিন সহায়ক ডিজাইনার উইকেট বানাতে চেয়েছে এখানে। তিন আন্তর্জাতিক স্পিনার যে তাদের টিমে। কিন্তু শ্রীনির বোর্ড বানাতে দেয়নি।

বেসরকারি ভাবে লিখছি, এসআরকে-র কাছে দু’টো ম্যাচ জেতা হয়তো ব্যক্তিগত ভাবে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ— মুম্বই আর পঞ্জাব। কিন্তু তাঁর টিমের কাছে সবচেয়ে বেশি উত্তেজক, চেন্নাইকে হারাতে পারা। অসন্তোষের কারণ— সিএসকে-কে রাঁচিতে নিজেদের মর্জিমতো পিচ তৈরির অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। আর কেকেআর-কে তার হোমেও বলা হয়েছে, আমরা যা তৈরি করে দেব, তাতে চুপচাপ খেলবে। গত পরশু কেকেআর কর্তা বিষণ্ণ সুরে বলছিলেন, ‘‘এর মানে কী। তা হলে হোম আর অ্যাওয়ে ম্যাচে তফাত কী থাকল!”

তখন কেকেআর থোড়াই জানত, প্রকৃতি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মাধ্যমে তাদের মনোমতো এমন স্পিনিং ট্র্যাক বানিয়ে দেবে, যেখানে বল পড়ে দেরিতে আসবে। ঘুরবে। ম্যাক্সওয়েল বা মিলারদের মতো হার্ড হিটারকে ম্যাচ থেকে ক্রমশ নিষ্ক্রিয় করে দেবে। কেকেআর সমর্থকেরা দু’বছর আগের ফাইনালে যাওয়া দেখেছিলেন টিভিতে বসে। লক্ষ্মী আর পাঠানের জেতানো সেই ম্যাচটা যে ঘটেছিল পুণেতে। এখানে চোখের সামনে লাইভ দেখলেন, ম্যাচ থেকে ক্রমাগত হারিয়ে যেতে থাকা গম্ভীরের টিম কী ভাবে টুর্নামেন্টের এক নম্বরকে বার করে দিল ম্যাচ থেকে।

শেষ দেখা হয়েছিল নভেম্বরে। কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। ছ’মাস পরে, বুধবার রাতে ফের দেখা হল
বাংলার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর শাহরুখ খানের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। আইপিএলে নিজের দলের খেলা দেখতে
কলকাতায় এসেছিলেন শাহরুখ। বিকেলে ছিলেন ইডেনে। সেখান থেকেই রাত ৯টার কিছু আগে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনে যান তিনি।
মিনিট পনেরো দু’জনের কথা হয়। পরে বাসভবন থেকে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেই বেরিয়েআসেন শাহরুখ। সঙ্গে মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম,
কেকেআর-এর কর্তাব্যক্তিরা। ফাইনালে জেতার জন্য শাহরুখকে আগাম শুভেচ্ছা জানান মুখ্যমন্ত্রী। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

টি-টোয়েন্টি বা ওয়ান ডে-তে একটা অভিব্যক্তি নিয়ত ব্যবহার হয়— গেমচেঞ্জার। যে ব্যক্তি বা যাঁরা এসে অকস্মাৎ খেলার গতিপথ ঘুরিয়ে দেয়। ২০১৪-র কেকেআরের জন্য একটা নতুন অভিব্যক্তি না বার করলেই নয়। টুর্নামেন্ট চেঞ্জার।

অবিশ্বাস্য নয়, অবিস্মরণীয়। যে টিম সাত ম্যাচে চার পয়েন্ট পেয়ে নিশ্চিত মর্গ যাত্রা করছিল, তারাই কি না টানা আট ম্যাচ জিতে আইপিএল ইতিহাসের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর পুনরুত্থান ঘটাল! ’৯২-এ অস্ট্রেলিয়ায় ইমরানের পাকিস্তান ছাড়া পাশে রাখার মতো নমুনাই মনে পড়ছে না, যেখানে ভস্ম হয়ে যেতে থাকা একটা টিম এমন জীবন্ত হয়ে ভিকট্রি স্ট্যান্ডের শেষ ধাপে এ ভাবে পৌঁছে যায়!

কেকেআর ফ্র্যাঞ্চাইজি হিসেবে এত বছর এত রকম বঞ্চনার শিকার হয়েছে। এসআরকে-র জন্য বাণিজ্যিক জগতে আর জাতীয় পর্যায়ে সবচেয়ে আকর্ষণীয় দল হয়েও কেন্দ্রীয় ক্রিকেট রাজনীতির মানচিত্রে একাধিক বার ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। এ বারের আইপিএল অত্যাশ্চর্য ভাবে সেলুলয়েডের চেয়ে জীবনকে বেশি দুঃসাহসী করে দিয়ে গেল। এটাই হয়তো ক্রিকেটের ন্যায়বিচার ব্যবস্থা।

জেনারেশন ওয়াইতে একটা জিনিস বদলায়নি!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement