ব্রাসিলিয়া এয়ারপোর্টটা অসাধারণ! বাইরে বেরোলেই পরের পর ঝাঁ-চকচকে অত্যাধুনিক স্থাপত্য! মনেই হবে না প্রকৃতিগত ভাবে তৃতীয় বিশ্বের এক দেশের রাজধানীতে পা দিলাম! ব্রাজিল তো দিনের শেষে তৃতীয় বিশ্বই! রাষ্ট্রপুঞ্জে পাত্তা পায় না। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য নয়। তার জিডিপি-ও যে বড় মুখ করে বলার মতো নয়।
আসলে ব্রাজিলের রাজধানী বয়সেও উদ্ভিন্নযৌবনা। সবে চুয়ান্নতে পড়ল। একটা শহরের পক্ষে চুয়ান্নটা কোনও বয়সই নয়। তার শুধু সামনে তাকানোর সময় এখন।
কী ট্র্যাজিক বৈপরীত্য দেখুন! বিশ্বসেরা ফুটবলারের কাছে কিন্তু উনত্রিশটাই হয়ে যায় বিশ্বকাপের বিদায়ী বেলা। কেবলই পিছন ফিরে নুড়ি কুড়নোর সময়!
ব্রাজিলের এই নবীন নগরীতে আগামী বিষ্যুদবার সাঙ্গ হয়ে যাওয়া উচিত ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর বিশ্বকাপ-গাথা। আমাজন তীরবর্তী মানাউস আজ রাত্তিরে তাঁকে ভেন্টিলেটরে আচ্ছন্ন অবস্থায় দক্ষিণ ব্রাজিলে ফিরিয়ে দিচ্ছে। অবস্থা বিচারে ভেন্টিলেটরই বটে। কারণ পর্তুগাল মাত্র এক পয়েন্টে দাঁড়িয়ে আছে। শেষ ম্যাচে সেই ভয়ঙ্কর ওঝা-বিশিষ্ট ঘানার টিমকে তাদের বড় ব্যবধানে হারাতেই হবে। আবার ঠিক একই সময় রেকিফের ম্যাচে মার্কিনদের হারতে হবে জার্মানির কাছে। মার্কিনরা ড্র করে ফেললেই শেষ। ঘানাকে হারাতে না পারলেও শেষ।
এমন একটা সরু চিলতের ওপর পর্তুগাল দাঁড়িয়ে যেখান থেকে উদ্ধার অসম্ভব নয়। কিন্তু যত দূর দেখা যাচ্ছে, খাদই খাদ!
ব্রাসিলিয়া মিডিয়া সেন্টারে ব্রাজিলের ম্যাচ টিকিট তুলতে গিয়ে পর্তুগালের এক সাংবাদিকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, যিনি আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় রোনাল্ডোর বিশ্বকাপ অভিযান শেষ পড়তে পড়তে তিতিবিরক্ত। “এ বার হবে না ধরে নিলাম। কিন্তু শেষ কেন, আমাকে বলতে পারেন? ক্লোজে ছত্রিশ বছর বয়সে গোল করে যাচ্ছে। ইনিয়েস্তা তিরিশোর্ধ্ব হয়েও এ বার খেলল। তা হলে রোনাল্ডো রাশিয়ায় খেলবে না কেন? ওর তো তখন বয়স হবে তেত্রিশ!”
যুক্তি হিসেবে পেশ করাই যায় এবং আসলে যায় না! প্রথমত, ক্লোজে আর রোনাল্ডোকে গড়িয়াহাটের মাছের বাজারে সবচেয়ে চোর দাঁড়িপাল্লাতেও সমান দেখানো সম্ভব নয়। দু’জনের উপর চাহিদার বহরটাই আলাদা। ক্লোজে হলেন অনেকের মধ্যে এক জন। টিমে খুব প্রয়োজনীয়, কিন্তু টিম ছাপিয়ে নয়। জার্মান টিম যবে পৌঁছেছে, ধরে নেওয়া যায় তারই এক অদৃশ্য মুখ হিসেবে ক্লোজেও ব্রাজিল পৌঁছেছেন। রোনাল্ডোর ব্যাপারটা একেবারেই আলাদা। তিনি দেশের ফুটবল ফেডারেশনের অনুমতি নিয়ে নিজস্ব চার্টার্ড বিমানে এসেছেন। সঙ্গে গোটা পরিবার। দু’শোর মতো সাংবাদিক। আর সেই বিমানে করেই ঘুরপাক খাচ্ছেন ব্রাজিল। ক্লোজে-র জন্য জীবিত বা মৃত কেউ জার্মান টিম হোটেলে দাঁড়িয়েছিল বলে মনে হয় না। কিন্তু ঠিক এগারো দিন আগে রোনাল্ডো যখন ক্যাম্পিনোসের রয়্যাল পাম হোটেলে পৌঁছন, সেখানে তাঁকে বরণের জন্য অপেক্ষায় ছিল হাজারের ওপর দর্শক। ডোনাল্ড ডাক সেজে দাঁড়ানো এক যুবক আর বক্ষদেশ উন্মুক্ত করে দাঁড়ানো এক ব্রাজিলীয় মডেল। তরুণীর নাম মিস বামবাম। তাঁর দাবি সিআর সেভেনের সঙ্গে নাকি এক কালে প্রেমের সম্পর্ক হয়েছিল। এর পর পর্তুগাল প্র্যাকটিসে গিয়ে মিস বামবাম ঢুকে পড়তে চাইলে নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁকে সরিয়ে দেন। আপাতত তাঁকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে রোনাল্ডোর পিছু ধাওয়া না করতে।
কাহিনির সারমর্ম: রোনাল্ডো মানেই গণ-হিস্টিরিয়া আর তার লেজুড় হিসেবে উচ্চাকাঙ্খী সব ফুটবল চাহিদা।
ক্লাব ফুটবলের কেড়ে নেওয়ার পরিমাপটাও রোনাল্ডোর ক্ষেত্রে অনেক বেশি। আগামী চার বছর ধরে রিয়াল তাঁকে পিষবে। যদি অন্য কোথাও চলে যান, তারাও ক্লাব ফুটবলের বৃহত্তম সাফল্যের যন্ত্র হিসেবেই ঘানি টানাবে। তার পর আর কোথায় রাশিয়া! কোথায় ২০১৮!
সুতরাং বিশ্বকাপে যদি কিছু দাগ রাখতে হয়, এ বারই! এই ভেন্টিলেটরে থাকা অবস্থাতেই! কাল বেলো হরাইজন্তে থেকে ব্রাসিলিয়া আসার সময় পাশের সিটে এক ব্রাজিলীয় টিনএজারকে পেলাম যে ফুটবল ক্লিনিকের ছাত্র। ব্রাজিল-ক্যামেরুন ম্যাচ দেখতে বাবার সঙ্গে হলুদ জার্সিতেই প্লেনে এসেছে। কিন্তু তার হৃদয়ের রং লাল। অকৃত্রিম রোনাল্ডো ভক্ত।
বলল, ক্লিনিকের স্পেশ্যাল ফ্রি-কিক সেকশন রয়েছে। যেখানে আলাদা করে রোনাল্ডোর ফ্রি-কিক টিউশন দেওয়া হয়। বিস্ময়কর শুধু নয়, অতীব বিস্ময়কর। যে ব্রাজিল এত ভাল ভাল সব ফ্রি-কিক-মারিয়ে দেখেছে। জিকো। সক্রেটিস। রোনাল্ডিনহো। তারা নিজেদের তারকা ছেড়ে ফুটবল সিলেবাসে রোনাল্ডো পড়াচ্ছে কেন? কারণ রোনাল্ডোর ওই বিশেষ ফ্রি-কিক নেওয়ার দক্ষতা। গোটা বিশ্ব যাকে নাক্ল-বল ফ্রি-কিক বলে জানে!
ছেলেটির মুখে শুনলাম, ক্লিনিকের ফুটবল শিক্ষকেরা শরীর ও পায়ের পজিশনিং কেটে কেটে নাক্ল-বল মারা শেখান। ডান পায়ে মারলে ডান পা-টা একটু ব্যাঁকা করে আসবে। চেটোটা সাইড করে বলের তলার দিকে মারলে এমন একটা ব্যাক-স্পিন পাবে যে, বলটা রিভার্স সুইংয়ের মতো উল্টো দিকে চলে যাবে। গোলকিপার কেবল জাল থেকে বলটা এর পর কুড়িয়ে আনবে।
বিমান থেকে নামতে নামতে সন্ধে সাতটা। পর্তুগাল-যুক্তরাষ্ট্র এই শুরু হল। ব্রাসিলিয়া বিমানবন্দরের ভেতরের কফিশপটায় একমাত্র টিভি লাগানো। সবাই ভিড় করে সেখানে ম্যাচ দেখছে। ছেলেটিকেও দেখলাম বাবার সঙ্গে খেলা দেখছে। শুরুতেই তিন মার্কিন ডিফেন্ডারকে টলিয়ে রোনাল্ডো বেরোলেন। কিন্তু সেটা সেন্টার সার্কলের কাছে একেবারেই নিরামিষ আক্রমণ। পর্তুগাল ফ্রি-কিকও পেল। জার্মানির দিন যেমন মেরেছিলেন রোনাল্ডো, অতগুলো না হলেও এক-আধটা মারলেন। কিন্তু নাক্ল-বল কোথায়? চোট তো বাঁ পায়ে! তার জন্য ডান পায়ে পঁচিশ গজের ফ্রি-কিকও মারা যাবে না কেন? ভারেলাকে দিয়ে শেষ মুহূর্তের গোল শোধ তো ডান পায়ের লম্বা ক্রসেই।
আসলে ব্রাজিল বিশ্বকাপের রোনাল্ডোকে দেখে মনে হচ্ছে, ফুটবল জীবনের নজিরবিহীন প্রত্যাশার চাপ ম্যানেজ করতে পারছেন না। কোথাও পরিচিত মস্তানিটা হারিয়ে ফেলছেন। যেটা তাঁর চরিত্রের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী। ব্রাজিল নেমে প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনেই তো বলেছিলেন, “আমার কাউকে কিছু প্রমাণ করার নেই। আমার সিভি দেখে নিন। সব আছে।” সেই সাংবাদিক সম্মেলন দেখে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ফুটবল সাংবাদিক তাঁর কলামে লেখেন, ‘রোনাল্ডোটা যাচ্ছেতাই। পর্তুগালের সেরা জাদুর যে গুণই থাক, বিনয় তার মধ্যে পড়ে না।’
কাল একেবারে ফাঁকায় একা গোলকিপারকে পেয়ে গিয়েছিলেন রোনাল্ডো। পরে রেফারি অফসাইড দেন। কিন্তু আত্মবিশ্বাস এমনই ভঙ্গুর অবস্থায় যে, সেটাও গোলে মারতে পারেননি। যা দ্রুতই সোশ্যাল মিডিয়ায় অভিহিত হয়ে গিয়েছে, ‘রোনাল্ডোর ব্রাজিল কমেডি’ হিসেবে।
তাঁর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী খেলা শেষের তিরিশ সেকেন্ড আগে গোল করে পোপ-সম অভ্যর্থনা পাচ্ছেন ব্রাজিলীয় কাগজে।
আর তিনি তিরিশ সেকেন্ড আগে গোল করিয়েও মন কাড়তে ব্যর্থ। ইন্টারনেটে যেমন এই গোল করানোর পরেও রোনাল্ডো জোক্স অব্যাহত। অথচ এই সোশ্যাল মিডিয়ায় তিনি বরাবরের ফুটবল সম্রাট! মেসিরও আগে। জার্মানি ম্যাচের পর সেখানেই কিনা লিখেছিল, বান্ধবী ইরিনা শায়েক বলছেন, ঘুম থেকে ওঠো। আর রোনাল্ডো ধড়ফড়িয়ে উঠে বলেছেন, আচ্ছা মুলার কি আরও কয়েকটা গোল দিয়ে ফেলেছে?
যুক্তরাষ্ট্র ম্যাচের পর বেরিয়েছে, এক বিচারক মা-বাবার ঝগড়ায় যন্ত্রণাকাতর ছেলেকে জিজ্ঞেস করছেন, তুমি কার কাছে থাকবে? মা?
না, মা মারে।
বাবার কাছে থাকবে?
না, বাবাও মারে।
তা হলে?
আমি ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর কাছে থাকতে চাই। ওর কাউকে মারার শক্তি নেই।
নবীন এই শহর যদি বৃহস্পতিবার তাঁর অকল্পনীয় উত্থান দেখে তো এক রকম। শোকগাথা তখন লোকগাথায় পরিণত হবে। কিন্তু গতিপ্রকৃতি যে ভাবে দাঁড় বাইছে, তাতে বিশ্বকাপে এটা রোনাল্ডোর অন্তিম ম্যাচই না হয়ে দাঁড়ায়।
তখন ভবিষ্যৎ কী ভাবে মাপবে তাঁকে? বেকহ্যামের মতো দূরছাই করে দিয়ে বলবে, বিজ্ঞাপনী হাইপ-ই শুধু বড় প্লেয়ার বানিয়ে দিয়েছিল? যা মস্তানি, সব ক্লাব ফুটবলে! স্বদেশীয় ফিগোই তো বলে দিয়েছেন, পর্তুগালে অমর হতে গেলে রোনাল্ডোকে ওয়ার্ল্ড কাপে ভাল খেলতে হবে। রবার্তো কার্লোস বলছেন, “বিশ্বসেরা ও ছিল? না মেসি? যখন তিরিশ বছর পর মূল্যায়ন হবে, তখন ব্রাজিল বিশ্বকাপটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর ধরা হবে।”
প্রাক্তনদের করা এ সব ফুটবলীয় বিষয়সম্পত্তির হিসেবেও ক্রমশ অনগ্রসর হয়ে পড়ছেন রোনাল্ডো। তাঁর হয়ে এটুকু বলারও কেউ নেই যে, চোট নিয়েও দ্যাখো রোনাল্ডো পালিয়ে যাচ্ছে না! পর্তুগালের প্রতি কমিটমেন্টের জন্য রিয়ালের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হতে পারে জেনেও পুরো বিশ্বকাপ খেলে দিচ্ছে। অনেকে তো মাঠেই নামত না এই প্রচণ্ড চাপের মুখে!
ব্রাজিলে পা দেওয়ার মাত্র বারো দিনের মধ্যেই পাকেচক্রে যা দাঁড়াল, রোনাল্ডোর ফুটবল-প্রতিভা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ব্রাসিলিয়ার গারদে আটক!
মানে গ্যারিঞ্চা স্টেডিয়ামের নামকরণ যাঁর স্মৃতিতে, ভাগ্য কি সে পথেই চালিত করছে রোনাল্ডোকে? যে, ন্যায়বিচার পাবেন খেলা ছাড়ারও অনেক পরে?
আবার কি তাঁকে সম্মানে ভরিয়ে দেবে আজ থেকে বছর কুড়ি-তিরিশ বাদের কোনও ফুটবল-গবেষক। যে হয়তো লিখবে, ২০১৪-য় পৌঁছে বিশ্বকাপ নিতান্তই একটা সমাজবাদী চেতনায় পরিণত হয়েছিল। যেখানকার শ্রেষ্ঠ মানে তীক্ষ্ন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক, কঠোর পুঁজিবাদী সমাজের গ্রহণযোগ্য শ্রেষ্ঠ নয়।
ওটা পর্তুগাল নয়, রিয়াল দিতে পারে। একাধিক বার তো রোনাল্ডোকে দিয়েওছে!
কিন্তু যত দিন না সেই মূল্যায়ন হচ্ছে, শোকগাথা আর ইন্টারনেট জোকস তৈরি চলবেই। কারই বা মনে থাকবে ব্রাজিলে নাক্ল-বল টিউশনের কথা!