মাঠের মধ্যে সম্মোহনী মেসি, মাঠের বাইরে মারাদোনা

বিশ্বকাপের হলটা কী! ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে তেতাল্লিশ নম্বরে থাকা ইরান প্রবল মহিমান্বিত আর্জেন্তিনার কাছে শেষ মুহূর্তের গোলে হেরে এমন কাতর যে, গোলকিপার কেঁদেই চলেছেন। বিশ্বকাপের হলটা কী! জার্মানির সঙ্গে ২-২ হওয়ার পর ফিফার সাঁইত্রিশ নম্বর ঘানা উৎসব করবে কী, শোকার্ত এক ডিফেন্ডারকে মাঠ থেকে বার করে আনা যাচ্ছে না... । বিশ্বকাপের হলটা কী! শনিবার লিওনেল মেসি এস্তাদিও মিনেইরো ছাড়ার সময় আর্জেন্টাইন টিম-বাসের বাইরে ভিড় থেকে অনেকে তাঁর উদ্দেশে উচ্ছ্বাসে হলুদ পতাকাও যে ওড়ালেন!\

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

বেলো হরাইজন্তে শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৪ ০৩:৫৫
Share:

ছবি: উৎপল সরকার।

বিশ্বকাপের হলটা কী! ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে তেতাল্লিশ নম্বরে থাকা ইরান প্রবল মহিমান্বিত আর্জেন্তিনার কাছে শেষ মুহূর্তের গোলে হেরে এমন কাতর যে, গোলকিপার কেঁদেই চলেছেন।

Advertisement

বিশ্বকাপের হলটা কী! জার্মানির সঙ্গে ২-২ হওয়ার পর ফিফার সাঁইত্রিশ নম্বর ঘানা উৎসব করবে কী, শোকার্ত এক ডিফেন্ডারকে মাঠ থেকে বার করে আনা যাচ্ছে না... ।

বিশ্বকাপের হলটা কী! শনিবার লিওনেল মেসি এস্তাদিও মিনেইরো ছাড়ার সময় আর্জেন্টাইন টিম-বাসের বাইরে ভিড় থেকে অনেকে তাঁর উদ্দেশে উচ্ছ্বাসে হলুদ পতাকাও যে ওড়ালেন!

Advertisement

বিশ্বকাপের হলটা কী! ব্রাজিলীয় রবিবাসরীয় দৈনিকে স্কোলারির দল-টল নিয়ে আলোচনা ছেড়ে প্রথম পাতায় শিরোনাম দিচ্ছে, ‘না সেলেকাও দো পাপা কুয়েম ফাজ মিলাগ্রে ই মেসি’। গুগুল ট্রান্সলেটর মানে বলছে, মেসির ঘটানো এই মিরাকল একমাত্র পোপই করতে পারতেন! আর একটা কাগজের প্রথম পাতায় সবিস্তার দশটা কারণ। কেন মেসিকে আপনার না দেখলেই নয়!

বিশ্বকাপের হলটা কী! তেহরান থেকে জনাচল্লিশেক ইরান সমর্থক খেলা দেখতে বেলোতে এসেছিলেন। কাল সান্ত্বনা জানাতে তাঁরা টিমের সঙ্গে দেখা করতে যান। বলতে গিয়েছিলেন শুধু ইরান নয়, গোটা এশিয়ার নাম তোমরা উজ্জ্বল করে দিয়েছ। কিন্তু টিম দেখা করেনি। ন্যায্য পেনাল্টি পাইনি। জেতা ম্যাচ হেরে ফিরেছি। এখন কারও সঙ্গে দেখা করার মুড নেই এই কথা শুনে নাকি প্রত্যাখ্যাত হয়ে তাঁরা ফিরে এসেছেন বলে রোববার জানালেন এবিপি-কে।

বিশ্বকাপ প্রথম দশ দিন ছাড়িয়ে যাওয়ার মধ্যেই যে পরিমাণ রঙ্গ, বিহ্বলতা আর নতুন সব নজির তৈরি করছে, তার সঙ্গে একমাত্র যেতে পারে কলকাতায় বহুল প্রচারিত সেই বিজ্ঞাপনী ট্যাগলাইন উল্টে দেখুন, পাল্টে গেছে!

লিওনেল মেসি যেমন! শনিবার ভারতীয় সময় মাঝরাত্তিরে যখন সাংবাদিক সম্মেলন করতে এলেন, তাঁকে দু’ধরনের প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতে হল।

একটা জিনিয়াস মেসি... যাঁর ছবি তুলতে, হাত মেলাতে সাংবাদিকেরা ক্ষুধার্ত ফ্যানের মতো ছুটলেন।

একটা আর্জেন্তিনা অধিনায়ক মেসি, যাঁকে অনেক টিম সমালোচনা এবং বাঁকা-বাঁকা কথা শুনতে হল! যাঁকে পরিষ্কার বলা হল, যে দিন আপনার জিনিয়াস আর্জেন্তিনাকে বাঁচাবে না, সে দিন তাকে রক্ষা করবে কে?

প্রেস কনফারেন্সে যে মেসি এসেছিলেন, তিনি আসলে জিনিয়াস বা ক্যাপ্টেন কোনও সত্তাই ততটা নন। প্রচণ্ডতম ব্যক্তিগত আক্রমণকে ক্রীড়া-নৈপুণ্যে এই মাত্র জয় করে ওঠা এক পরিতৃপ্ত মহাতারকা! শরীরী ভাষাটাই কত পজিটিভ। সামনে এগিয়ে, সবার চোখে চোখ রেখে। বাঁকা প্রশ্নতেও মুখের হাসি না হারানো। ওঠার আগে দলের তরফে অধিনায়ক মেসি কথা দিয়ে গেলেন, পরবর্তী পর্বে তাঁর দলের আরও উন্নতি ঘটবে। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে তিনি দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠার অসাধারণ মুহূর্তটাই মনে রাখতে চান।

নেটে দেখছিলাম লাস ভেগাসের এক জুয়াড়ি মেসির শেষ মুহূর্তের গোলে প্রায় সর্বস্বান্ত হওয়া থেকে বেঁচেছেন। আর্জেন্তিনার জেতার ওপর তিনি ২৪৫ কোটি টাকা বাজি ধরেছিলেন! মেসির নিজেরও তো পাশার দান উল্টো দিকেই চলে যাচ্ছিল। ইরান ম্যাচ জিতেও যা শুনতে হচ্ছে, ড্র করলে বা হারলে বিশ্ব-ফুটবলের শকুনি মামারা তাঁকে ছেড়ে দিতেন নাকি!

ঝলসে ওঠা বাঁ পায়ের জন্য আর্জেন্তিনার অন্য দশ নম্বরকেই লোকে বিশ্বকাপে চিনতে অভ্যস্ত। মেসি যেন সেই পরম্পরাই বহন করে গেলেন ‘হ্যান্ড অব গড’ গোলের আঠাশতম বার্ষিকীর ঠিক এক দিন আগে! এমনই রোমাঞ্চিত করে দিয়েছেন তিনি গোটা ব্রাজিলকে যে, গ্রুপ লিগের গুরুত্বপূর্ণ ক্যামেরুন ম্যাচের আগের দিন প্রথম পাতায় কোথায় নেইমার থাকবেন, তা নয়। পাতা জুড়ে মেসি।

যে ভাবে পশ্চিমি দেশগুলোয় বিজ্ঞাপন দেয়, মৃত্যুর আগে কোন পঞ্চাশটা বই আপনার পড়ে নেওয়া উচিত! সে ভাবেই ব্রাজিলীয় দৈনিক তার পাঠকদের বলেছে, কেন মেসিকে দু’চোখ ভরে দেখে না নিলেই নয়!

১. বিশ্বের যে কোনও খেলাতেই এক নম্বরকে দেখার সুযোগ ছাড়তে নেই।

২. এমন সুযোগ বারবার আসবে না। কবে আবার এ দেশে পাওয়া যাবে, আদৌ যাবে কি না, কেউ জানে না।

৩. ম্যাচের রাজা বস্তুটা কী, সেটা চোখে দেখা দরকার।

৪. ইরানের সঙ্গে গোলটা যেমন মনে একটা বিনা পয়সার অ্যালবাম তুলে ফেলা, তেমন আরও স্মৃতি তৈরির সুযোগ।

৫. আক্রমণ শানানো বলতে কী, সেটা প্রত্যক্ষ করা।

৬. ফুটবল মাঠের তীক্ষ্ন অ্যান্টিসিপেশন শিক্ষা।

৭. ব্রাজিলের তথাকথিত শত্রু দেশের প্লেয়ার কত সম্মানিত হতে পারে, হাতেকলমে দেখা।

৮. রেকর্ডের চাপ নেওয়ার শিক্ষা।

৯. দেখা, পৃথিবীব্যাপী অবিশ্বাসের বিরুদ্ধে কী ভাবে লড়তে হয়!

১০. একটা এক্স ফ্যাক্টর প্রত্যক্ষ করা, যার কোনও ব্যাখ্যা হয় না।

পেলে-রোনাল্ডিনহো-রোনাল্ডোর দেশের কাগজ এটা, ভাবাই যায় না! ব্রাজিলীয়দের যিনি নাচিয়ে দিয়েছেন, তিনি তো আর্জেন্টাইন হৃদয়ের এক নম্বর হবেনই। আর এই জায়গাটাতেই একটা মোচড় আছে। রোববারও প্রায় ফাঁকা বেলো মাঠের বাইরে যে আর্জেন্টাইন গ্রুপকে হুল্লোড়ে মত্ত দেখলাম, তারা মেসিকে এক নম্বরে বসিয়েও দিয়েগোকে তাঁর ওপরে রাখে। তাঁর দিয়েগো মারাদোনার আসলে কোনও নম্বর নেই। কেউ তাঁকে দেশের প্রেসিডেন্ট দেখতে চেয়ে অনবরত ব্রাজিলেও প্ল্যাকার্ড নিয়ে ঘুরছে। কেউ তাঁকে সরাসরি বলছে ঈশ্বর!

জানতাম না যে বুয়েনস আইরেস থেকে দুশো কিলোমিটার দূরে রোজারিওতে মারাদোনাইয়ান চার্চ রয়েছে। যেখানে ভক্তরা দশ নম্বর জার্সি পরে। যেখানে বাইবেলকে সরিয়ে পড়ানো হয় মারাদোনার আত্মজীবনী। সারা বিশ্বে আশি হাজার ভক্তসংখ্যা এই চার্চের। যে তিন প্রতিষ্ঠাতা, তাঁদের এক জন বলেছেন, ক্যাথলিকদের আপসেট হওয়ার কিছু নেই। ফুটবল তো একটা ধর্ম আর আমরা সেই ধর্মের ঈশ্বরের উপাসনা করছি মাত্র। এই ট্রাস্টি বোর্ডে রয়েছেন আর্জেন্তিনার প্রাক্তন ফুটবলার আলেজান্দ্রো ভেরন। তা ভেরন গত বার ২৯ অক্টোবর মাঝরাতে একটা ফোন পান। ট্রাস্টি বোর্ডের এক সদস্যই তাঁকে ফোন করে বলেন, মেরি এক্স-মাস।

ভেরন বলেন, “মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি তোমার? আজ তো সবে ৩০ অক্টোবরে পড়লাম।”

ফোনকারী অবিচলিত, “ঠিক তাই। আমাদের যিশু তো ৩০ অক্টোবরই জন্মেছেন।”

আর্জেন্টাইন জনতার হৃদয়ের এহেন যিশু কাল মেসির গোলটা দেখেছেন কি না, এটা কিছুতেই কনফার্ম করতে পারলাম না। আর্জেন্টাইন সাংবাদিকদের অনেকেই বললেন, ঠিক ওই সময়টাই নাকি ম্যাচ ড্র হচ্ছে ধরে নিয়ে চার দেহরক্ষী ও ব্যক্তিগত ম্যানেজার সমেত মারাদোনা বেরিয়ে যান। কেউ আবার বললেন, সিঁড়ির তলায় যখন তিনি, তখনই গোলটা!

যে ব্যাখ্যাই ঠিক হোক, মাঠের বাইরে টিভি উপস্থাপক হিসেবেও এ ক’দিনে যে তিনি ঝড় তুলে দিয়েছেন, কোনও সন্দেহ নেই। ভেনেজুয়েলান টিভি নেটওয়ার্কের হয়ে ব্রাজিল জুড়ে তিনি শো করে বেড়াচ্ছেন। ভেনেজুয়েলা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মারাদোনার বিশাল দোস্তি। তিনি বামপন্থী এবং পুঁজিবাদ-বিরোধী। আর মারাদোনা তো বরাবরই তথাকথিত ফুটবল-পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে।

এই পর্যন্ত বিশ্বকাপে তিনি যা বলেছেন, সারসংক্ষেপে এ রকম—

ফিফা: কোটি কোটি টাকার ব্যবসায়ী। ফুটবলের উন্নতির মধ্যে শুধু নেই, আর সব করে। আমাকে এ বার ওরা বসনিয়া ম্যাচে মারাকানায় ঢুকতে দেয়নি (ফিফা অভিযোগ অস্বীকার করেছে)। আমাকে টিভি শো-য় দেখলেও বাথরুমে লুকিয়ে পড়া উচিত ব্লাটারের।

পেলে: আমি এ দেশে যে অভ্যর্থনা পেলাম, পেলে তা পায়নি। বেচারা কী করবে নিজের মিউজিয়ামে ঢুকে বসে থাক।

স্কোলারির ব্রাজিল: রেফারি পুষে দিন চলছে। নেইমার ছাড়া বাকিরা আক্রমণ করতেই জানে না।

অমোঘ সম্মোহন। মারাদোনার টিভি শো-র রেটিং তাই লাতিন আমেরিকায় দুরন্ত ভাবে বাড়ছে...।

মাঠের মধ্যে মেসি। মাঠের বাইরে মারাদোনা। আর্জেন্তিনীয়দের এ বার যৌথ ম্যাজিক! হোক না দেশের নাম ব্রাজিল!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement