‘পুরো নয়, এখনও তো অর্ধেক এলএম টেন’

ভাঙচুরের মধ্যেও স্কিলের ঐতিহ্য বেঁচে মেসির বাঁ পায়ে

ব্রাজিলের দু’টো জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল রয়েছে। তারই একটা স্পোর্ট টিভি টু এবং তারা মঙ্গলবার রাত্তিরে বিশ্বকাপ নিয়ে জমজমাট একটা শো করল। আর সেটা গিয়ে দাঁড়াল লিওনেল মেসি চর্চায়।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

সাও পাওলো শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৪ ০৩:৩১
Share:

ব্রাজিলের দু’টো জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল রয়েছে। তারই একটা স্পোর্ট টিভি টু এবং তারা মঙ্গলবার রাত্তিরে বিশ্বকাপ নিয়ে জমজমাট একটা শো করল। আর সেটা গিয়ে দাঁড়াল লিওনেল মেসি চর্চায়।

Advertisement

পুরোটাই পর্তুগিজে। হোটেলের রিসেপশনিস্টকে দিয়ে গুগল অ্যাপসে গিয়ে গিয়ে সেটার কাছাকাছি তর্জমা করা হল। প্যানেলে অংশগ্রহণকারী চার জন— বিশ্বকাপজয়ী চার প্রাক্তন অধিনায়ক। লোথার ম্যাথেউজ, ড্যানিয়েল পাসারেল্লা, কার্লোস আলবার্তো এবং ফাবিও কানাভারো।

মেসির আলোচনা শোনার সুযোগ নিশ্চয়ই হয়নি। তাঁদের টিম বাসের ততক্ষণে বেলো ফিরে যাওয়ার জন্য সাও পাওলো বিমানবন্দরের দিকে রওনা হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু শুনলে অবশ্যই বিগলিত হয়ে পড়তেন। তাঁর একটা শেষ মুহূর্তের ডিফেন্স তছনছ করে যাওয়া দৌড় আর বিশ্বকাপের এ বারের পারফরম্যান্সটা বিশেষজ্ঞদেরও কেমন দুলিয়ে দিয়েছে!

Advertisement

পাসারেল্লা আটাত্তরের সেই আর্জেন্তিনার সোনাজয়ী টিমের ক্যাপ্টেন। বললেন, “মারাদোনার টিমে তবু একটা বুরুচাগা ছিল, একটা ভালদানো ছিল, একটা ক্যানিজিয়া ছিল। এ তো একা টেনে নিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। এই নিয়ে চারটে ম্যাচ হয়ে গেল। ভাবাই যায় না!” পাসারেল্লার সঙ্গে মারাদোনার বহু দিনের ঝগড়া সেই আটাত্তরের দল থেকে তাঁকে বাদ দেওয়ায়। তাই বরাবরই তাঁর মারাদোনার আগে মেসিকে বসানো নিয়ে সূক্ষ্ম সন্দেহ থাকতে পারে।

কিন্তু নব্বইয়ের মারাদোনাকে হারিয়ে যিনি ট্রফি জিতেছিলেন সেই ম্যাথেউজও একই রকম উচ্ছ্বসিত। ম্যাথেউজ শুধু মনে করেন, এই ব্যক্তির দিনের পর দিন জিতিয়ে দেওয়া ধারাবাহিক চলতে পারে না। কোথাও না কোথাও সিস্টেম তাঁকে আটকে দেবেই। ম্যাথেউজ ঘুরিয়ে বোধহয় ইউরোপীয় দেশগুলোর টিম প্লে-র কথাই বলতে চাইলেন। মেসিয়ানা যদি থেমে যায় ফাইনালের আগেই, মনে হল না খুব আশ্চর্য হবেন। কিন্তু একক ভাবে মেসির নৈপুণ্যে তিনি একটাই টার্ম অব রেফারেন্স পাচ্ছেন— তাঁর সময়ের খুদে ওস্তাদকে। মারাদোনা এবং একমাত্র মারাদোনা।

কানাভারো বললেন, স্টেডিয়ামে এমনি যা আলো থাকে থাকছে, তার ওপর মেসি যেন নিজস্ব আলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে। আর্জেন্তিনাকে ও ফাইনাল অবধি নিয়ে গেলে আমি একটুও অবাক হব না।

এঁদের আলোচনা এবং ব্রাজিল ফুটবলমহলের সঙ্গে কথা বলেও মনে হচ্ছে, ২০১৪ বিশ্বকাপে রাজ করতে এসেছিলেন লিওনেল মেসি। টিম ফাইনালে যাক বা না, সেই রাজত্বটা স্বীকৃত হয়ে গিয়েছে। কানাভারো যেটা বলছিলেন সেটা অনেকেরই মনের কথা— “এখনও তো পুরো ফর্মের অর্ধেক খেলাই খেলেনি। সেটা খেললে কী হবে।”

এ বারে বিশ্বকাপের সব কিছু বদলে ভাঙচুর হওয়ার আওয়াজের জন্য যেন আরও বন্দিত হচ্ছে মেসি-রাজ। বলা হচ্ছে ফিটনেস এবং গতির তুঙ্গে পৌঁছে গিয়েছে এখন গড়পড়তা আন্তর্জাতিক ফুটবলার। স্কিলে আগে যে মার খেত অপেক্ষাকৃত বড় প্লেয়ারের কাছে, সেটা ঢেকে গিয়েছে গতি আর শক্তিতে। মোটামুটি সবারই শরীরে তিন-চারটে করে ট্যাটুর চেয়েও অনেক তাৎপর্যপূর্ণ, প্রত্যেকে নিয়মিত জিম করে। ওয়েট তোলে। ভিডিওয় কোচ বিপক্ষের খেলা কেটে কেটে বিশ্লেষণ করিয়ে দেওয়ার সেই আইটি বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে কোচের তার জন্য তৈরি করে দেওয়া পেনড্রাইভটা নেয়। এর পর নিজের ল্যাপটপে চালিয়ে দেখে নেয় ঠিক কী করতে হবে। এমন অফুরন্ত এক-এক জনের এখন দম যে, ওপরে গেলে আর নীচে নামতে পারছি না জাতীয় কলকাতা ময়দানের ভাবধারা আমলই পায় না।

পেলের সত্তরের বিশ্বকাপে একটা বিখ্যাত গোল করানো রয়েছে আলবার্তোকে দিয়ে। ভদ্রতাবশতই হয়তো কেউ আলবার্তোকে জিজ্ঞেস করল না, আচ্ছা এখন হলে গোলটা করতে পারতেন? এখনও ইউ-টিউবে গোলটা রক্ষিত। পেলে ফাঁকায় বলটা ধরলেন। ডান দিক থেকে আলবার্তো ওভারল্যাপে উঠছেন। তাঁর জন্য অপেক্ষা করলেন। বলটা তার পর ডাইনে ঠেলে দিলেন। আধুনিক ফুটবলার ওই লোকের জন্য অপেক্ষা করাটা স্বপ্নেও দেখবে না। পেলের আমলে চিরশ্রেষ্ঠ প্লেয়ার ফাঁকা জমি করতে স্কিল বাবদ যে সুবিধেটা পেত, সেটা এখন অদৃশ্য। চলতি বিশ্বকাপে তো বারবার দেখা যাচ্ছে নামী-অনামী কেউই ফাঁকা জমি পাচ্ছে না। এত দ্রুত প্লেয়ার নীচে নামছে যে অ্যাটাকিং জোনে সব সময় বিপক্ষের কমপক্ষে ছয় থেকে সাত জন।

মেসির জিনিয়াস তা-ও সেই জনারণ্যের ভুলভুলাইয়া থেকে ছিটকে বার করে দিচ্ছে। কিন্তু এই পরীক্ষাই তো তাঁর বা নেইমারের অনেক বিখ্যাত পূর্বপুরুষকে দিতে হয়নি। আরও সমস্যা করছে দেশের টিমের যথেষ্ট কম্বিনেশন তৈরির সুযোগ না পাওয়া। বার্সা টিমটা যদি ব্রাসিলিয়ায় নীল জার্সিতে খেলতে পারত তা হলে আর বেলজিয়াম ম্যাচ নিয়ে আর্জেন্তিনীয় অধিনায়কের কাঁপুনি উঠত না। কিন্তু এই আর্জেন্তিনায় তো অর্ধেক সময় ওয়ান টু খেলতে গিয়ে তিনি ছয় গজের বক্সে শেষ বারের মতো ফেরতই পাচ্ছেন না। রিয়াল এখানে খেললেও কোস্টারিকা বা চিলির এত বাড়-বাড়ন্ত থাকত না।

কিন্তু টিম কম্বিনেশন যদি চূড়ান্ত তৈরি না থাকে, ফুটবল ঐতিহ্যে অজ্ঞাতকুলশীল দেশও সমস্যায় ফেলতে পারে। বেশির ভাগের মনে হচ্ছে পরবর্তী বিশ্বকাপেও একই ধারা চলবে। ব্রাজিল একটা ট্রেন্ড শুরু করল যেটা বেশ বিপজ্জনক যে, ফুটবল স্কিলকে হারিয়ে দিতে যাচ্ছে ফিটনেস আর স্পিড।

শোয়ের কথায় ফিরি। শোয়ের মধ্যে পাসারেল্লা এক বার বললেন, মেসি এখনকার যুগে জমি না পেয়েই এই খেলা খেলছে, ও কুড়ি-তিরিশ বছর আগে জন্মালে কী হত!

তখনই মনে হল পেলের তো সাও পাওলোতেও একটা বড় বাড়ি আছে। এই শো-টা দৈবাৎ যদি চালিয়ে থাকেন, তাঁর ভাল লাগার কথা নয়!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement