ব্রাজিলের হ্যাং হয়ে যাওয়া মেজাজের মধ্যে আজ অন্য মৃত্যুগুহার নৃশংস লড়াই

সাও পাওলো বা রিওর মতো বড় ব্রাজিলিয়ান শহরের বৈশিষ্ট্য হল, ক্রমাগত বদলে যেতে থাকা দেওয়াল লিখন। গুলেরমো ওচোয়া যে রিফ্লেক্সে ঝাঁপিয়ে গোল বাঁচান, মোটামুটি সেই দ্রুততায়ই এখানে পাল্টে যায় গ্রাফিটি। এই কালকে একটা হাতে আঁকা ছবি আর সঙ্গের লেখা দেখে প্লেনে চাপলাম। আবার অন্য শহর থেকে সে দিন রাতেই ফিরে দেখলাম, বদলে গেছে। আপাতত যেমন সাও পাওলোর দেওয়াল লিখনে শোভা পাচ্ছে ক্যুপ দে মুন্দোর পাশে কিছু আরশোলার ছবি।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

সাও পাওলো শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০১৪ ০৪:১৬
Share:

নিথর হলুদ-ব্রিগেড।

সাও পাওলো বা রিওর মতো বড় ব্রাজিলিয়ান শহরের বৈশিষ্ট্য হল, ক্রমাগত বদলে যেতে থাকা দেওয়াল লিখন। গুলেরমো ওচোয়া যে রিফ্লেক্সে ঝাঁপিয়ে গোল বাঁচান, মোটামুটি সেই দ্রুততায়ই এখানে পাল্টে যায় গ্রাফিটি। এই কালকে একটা হাতে আঁকা ছবি আর সঙ্গের লেখা দেখে প্লেনে চাপলাম। আবার অন্য শহর থেকে সে দিন রাতেই ফিরে দেখলাম, বদলে গেছে। আপাতত যেমন সাও পাওলোর দেওয়াল লিখনে শোভা পাচ্ছে ক্যুপ দে মুন্দোর পাশে কিছু আরশোলার ছবি।

Advertisement

আরশোলা মানে তার প্যাঁচানো শুঁড় থাকবে। এ দেশে আরশোলা ছবির অর্থও তাই— প্যাঁচানো ব্যাপারস্যাপার। সোজা কথায়, দুর্নীতি। কিন্তু মেক্সিকোর সঙ্গে পয়েন্ট ভাগ করে নেওয়ার পরেও কাপ দুর্নীতির গল্পটা এই মুহূর্তে খাচ্ছে না। এখনও বিমানবন্দর-হোটেল-ট্যাক্সিচালক-সাধারণ পথচারী সবার গায়ে হলুদ টি-শার্ট। মেক্সিকো ম্যাচ ড্র হয়েও সেটা কেউ গা থেকে খুলেছে বলে তো মনে হল না। যা বুঝছি, বিশ্বকাপ চলাকালীন গোটা দেশের এটাই অঘোষিত ইউনিফর্ম। আরশোলার কী সাধ্য সেটা কামড়ে ফুটো করবে!

কিন্তু ব্রাজিলীয়দের মেজাজটা কালকে রাত্তিরের পর মোবাইল হ্যাং করার মতোই নিস্পৃহ হয়ে গিয়েছে। এক ব্যাঙ্ক কর্মীর সঙ্গে আলাপ হল যে তীব্র অনুতাপ করছে, পৃথিবীর সর্বকালের সেরা সেভগুলো কি ব্রাজিলের বিরুদ্ধে হবে বলেই তোলা থাকে? সত্তরের বিশ্বকাপে পেলের পর এ বার নেইমার আর থিয়াগো সিলভা। ব্রাজিলে এ বার দেখছি দর্শকদের মধ্যে নতুন প্রবণতা সারাক্ষণ ম্যাচটা মোবাইলে ভিডিও করার। ফ্রি-কিক নেওয়ার সময় তো ছেড়েই দিলাম, পেনাল্টি কিকের মতো অতীব রুদ্ধশ্বাস কিছু ঘটার সময়ও মোবাইল ছবি আগে। সেটা দ্রুত আপলোড করে ফেসবুক বা ইউ-টিউবে পাঠিয়ে দেওয়া আগে। তার পর নির্ভেজাল মন দিয়ে খেলাটা দেখা! কিন্তু সারাক্ষণ ক্যামেরা অন করে থাকলেও মনে হয় না ওচোয়ার সেভদুটোর ছবি কেউ তুলতে পেরেছেন বলে। এত দ্রুত সেগুলো ঘটেছে! পেলের হেডটার সময় তিনি গোলপোস্টের দিকে মুখ করে খানিকটা বাঁ দিকে ছিলেন। নেইমারের হেডটা ডান দিক থেকে কোনাকুনি। আরও কঠিন বল। তাই ব্যাঙ্কসের চেয়েও কঠিন সেভ! ব্রিটিশ মিডিয়া নিজেদের গোলকিপার নয় বলে সেটাকে স্বীকৃতি দিতে না চায়, তাতেও কিছু হবে না। বাকি বিশ্ব মাথা ঝুঁকিয়ে বলছে, হ্যাঁ এটাই শতাব্দীসেরা সেভ।

Advertisement

সমস্যা হল, শতাব্দীসেরা সেভ এমনই নিশ্চেষ্ট করে রেখেছে ভুক্তভোগী দেশের চেতনাকে যে, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে একটা শতাব্দীর আক্রোশের উত্তর পাওয়া যেতে পারে জেনেও কেউ কোনও গরজ দেখাচ্ছে না। বৃহস্পতিবার সাও পাওলো মাঠে মৃত্যুগুহার লড়াই। ইংল্যান্ড বা উরুগুয়ে যে-ই হারুক, তাদের ক’দিনের মধ্যেই ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনালে ব্রাজিল কাস্টমসের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।

লুইস সুয়ারেজের দেশের যে এই অবস্থা, তাতে তো আম ব্রাজিলীয়র খুশিতে উদ্বেল থাকা উচিত। ১৯৫০-র বিশ্বকাপ ফাইনালের নিঃশব্দ বদলা নেওয়া যাবে। সেই ব্রাজিলেই এসে প্রথম রাউন্ডেই ছিটকে যাবে উরুগুয়ে। কোন উরুগুয়ে? না, যাদের কাছে কাপ খোয়ানোটা এ দেশের মননে এমন ধাক্কা যে, চৌষট্টি বছর পরেও মানুষ ভুলতে পারে না। ব্রাজিলের একটা টিভি অনুষ্ঠানে সে দিন গ্রাফিক্স সহযোগে বলছিল, ব্রাজিলীয়দের জীবনে গত একশো বছরে প্রথম তিন দুঃখজনক ঘটনার মধ্যে পঞ্চাশ সালের মারাকানা হারটা পড়ে। দুঃখের ঝাঁপিতে আরও দুই হল হিরোশিমায় বোমাবর্ষণ আর ৯/১১!

টুর্নামেন্টের আগে তাই অনেককে বলতে শুনেছিলাম উরুগুয়ে যেন আগে হেরে না যায়। ওদের হারাব আমরা। আজ আর শুনলাম না। ব্রাজিল নিজেকে নিয়ে এতই চিন্তিত যে, ঐতিহাসিক বদলার মধ্যে এখুনি নেই। ব্রাজিলীয় মিডিয়াও নেই।

থাকলে ওয়েন রুনি পত্নীর ১৫ পিস লাগেজ নিয়ে আজ রিও অবতরণকে তারা গুরুত্ব দিত। ব্রিটিশ মিডিয়া যা দিয়েছে। তারা প্রশ্ন করেছে, এত লাগেজ কেন? ঘুরিয়ে বলতে চেয়েছে, ইংল্যান্ড তো আর বেশি দিন থাকবে না। তা হলে? হোটেল পৌঁছেই টু-পিস বিকিনিতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে পড়ে পাপারাৎজির শিকার হয়ে যাওয়া কলিন রুনি বলেছেন, “আমি তো আশা রাখি, ইংল্যান্ড শেষ অবধি থাকবে।”

উরুগুয়ের হয়ে আহত সুয়ারেজ কিক-অফ থেকেই নামতে পারবেন কি না তা নিয়ে যেমন জোর কৌতুহল, তেমনই জল্পনা রুনি নিয়ে। তাঁকে কি খেলানো হবে? কেউ কেউ বলছেন, আগের দিনের মতো বাঁ দিকে না খেলিয়ে রুনিকে মধ্যিখানে পরিচিত জায়গায় খেলানো হবে। আবার কেউ কেউ বলছেন, কোচ ওকে উরুগুয়ে ম্যাচে বাদ দেবেন। এমন চচ্চড়ি চলছে রুনি নিয়ে যে, টিমের সহকারী কোচ গ্যারি নেভিল খুব তিতকুটে ভাবে বলেছেন, “এটা ইংল্যান্ডের মজ্জায় ঢুকে গেছে যে টপ প্লেয়ারকে অন্যায় আক্রমণ করে যাও। পল গাসকোয়েন এর ফল ভোগ করেছে ১৯৯৬-’৯৮। ডেভিড বেকহ্যাম করেছে ২০০০-’০৬। ইদানীং করছে রুনি।”

ম্যাচটা ইংল্যান্ড ডিফেন্স বনাম উরুগুয়ে ফরোয়ার্ড লাইন হওয়ার সম্ভাবনা। যদিও সেরা ইংল্যান্ড ডিফেন্স এই মুহূর্তে পাওয়া যাবে বিবিসি কমেন্ট্রি বক্সে। সেখানে রিও ফার্দিনান্দ আর জন টেরি। ইংরেজ মিডিয়া যে ডিফেন্স খারাপ এবং রুনি নিয়ে ক্রমান্বয়ে বলতে বলতে টিমের ওপর চাপ সৃষ্টি করে রেখেছে। টিম ও মিডিয়া, দু’পক্ষে সম্পর্কের ক্রমশ আরও অবনতি হচ্ছে সেটা চমকপ্রদ কিছু নয়। ব্রাজিলীয় মিডিয়ার সঙ্গে ব্রাজিল টিমটারও তো চলছে। স্কোলারি কালকে প্রেস কনফারেন্সে এক সাংবাদিককে ধমকেই দিয়েছেন, “আপনাদের মধ্যে এত নেগেটিভ মনোভাব কেন?” এমনকী জার্মান মিডিয়ার সঙ্গেও জার্মান প্লেয়ারদের ঝামেলা। উরুগুয়ে এখনও এই সমস্যাক্রান্ত নয়। যদিও দিয়েগো ফোরলান বলে ফেলেছেন, “আমাদের এত কম জনসংখ্যার পুঁচকে দেশ। কিন্তু সীমাহীন তাদের কাপ-প্রত্যাশা।”

উরুগুয়ে কাল হেরে গেলে আরও ভয়াবহ! তখন দু’ম্যাচ হেরে তারা ইতালির সামনে শেষ ম্যাচে পড়বে। ফোরলানরা এই সঙ্কটের মধ্যে পড়ে সাহস সেঁকছেন একটা পুরনো অভিব্যক্তি থেকে। তার নাম লা জেরা।

মানে মৃত্যু অবধি দায়বদ্ধতা রেখে লড়াই করা। মনে রাখা কে কী বলছে, পরিস্থিতি কী, তাতে কিছু আসে যায় না। কোনও কিছুই শেষ হওয়ার আগে শেষ নয়। ক্রিকেটে একেই বলে শেষ বল পর্যন্ত লড়াই করার অস্ট্রেলিয়ান অভ্যেস।

কিন্তু উরুগুয়েনরা তাকে বিজ্ঞান থেকে আধা বিশ্বাস, আধা সংস্কারের স্তরে নিয়ে গেছে। তারা মনে করে, উরুগুয়ে টিম যত ঝড়ঝঞ্ঝাটেই পড়ুক, লা জেরা ঠিকমতো অনুসরণ করলে বিপদ থেকে ঠিক পেরিয়ে যাবে। এ হেন সংস্কারের জন্ম ব্রাজিলেই। চৌষট্টি বছর আগের তীব্র জনবহুল মারাকানায়।

মাঠে যখন খেলার আগেই রিওর মেয়র ব্রাজিলকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে দিয়েছেন, যখন ফিফা প্রেসিডেন্ট জুলে রিমে জয়ের আগাম অভিনন্দন জানিয়ে রাখছেন ব্রাজিলিয়ানদের, যখন মারাকানার দু’লাখ জনতা চিৎকার করছে হোম টিমের সাফল্য আগাম উদযাপনে, তখন উরুগুয়ে অধিনায়ক বোদুলিও ভারেলা নাকি ড্রেসিংরুমে টিমকে জড়ো করে গা গরম করা রোমহর্ষক একটা বক্তৃতা দিয়েছিলেন। যার মর্মার্থ, কে কী বলছে গ্রাহ্য কোরো না। আমরা জানি এখনও কিছুই ঘটেনি। আর সেটা ঘটাব আমরা। মনে রেখো যারা বকবক করছে তারা খেলবে না। মাঠে খেলবে প্লেয়াররা। চলো... ওদের দেখাই!

এমন উদ্দীপ্ত হয়েছিল টিম যে, প্রথমে গোল খেয়েও ২-১ জেতে। সে দিন থেকে লা জেরা মন্ত্রের জন্ম। যা চৌষট্টি বছর পরেও সাও পাওলোর লকার-রুমে প্রয়োগ করবেন বলে ভেবে রেখেছেন ফোরলান-সুয়ারেজরা।

বুধবার ম্যাচের চব্বিশ ঘণ্টা আগে যে উরুগুয়ে কোচকে একহাত দূর থেকে সাংবাদিক সম্মেলন করতে দেখলাম, তিনি যথেষ্ট আতঙ্কিত। আতঙ্কের কারণও আছে। এমনিই টিমে এত চোটে ছোঁয়াচে রোগ ধরেছে। তার ওপর ক্যাপ্টেন দিয়েগো লুগানো চোটের জন্য এমন মরণবাঁচন ম্যাচ খেলতে পারবেন না। সুয়ারেজ যতই খেলুন, অস্কার তাবারেজ তো সাফ বলেই দিলেন, “যে ফিটনেসে খেলবে সেটা তো আর ইপিএলের মতো হবে না।”

তা হলে কি নীরব বশ্যতা স্বীকার? টুর্নামেন্ট থেকে বেরিয়ে যাওয়া? ঠিক এই জায়গাটায় এসেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেল তাবারেজের। “উরুগুয়ের ইতিহাস দেখুন। আমরা মরার আগে মরি না।” শুনে আবার সেই লা জেরা মনে পড়ে গেল।

সাতাশি বছরের এক বৃদ্ধকে কাল উরুগুয়ে চেষ্টা করছে লকাররুমে এক বার নিয়ে যাওয়ার। বয়স আর স্বাস্থ্যজনিত কারণেই নিশ্চিত থাকা যাচ্ছে না। যদিও তিনি সাও পাওলোতেই আছেন, ১৯৫০-র সেই বিশ্বকাপজয়ী দলের একমাত্র জীবিত সদস্য ঘিগিয়া। ফাইনালে ১-১ হয়ে যাওয়ার পর ঘিগিয়ার গোলটাই ছিল জয়সূচক। তাঁর উপস্থিতি উদ্দীপক হতে পারে ভেবে গোটা দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপেও ঘিগিয়াকে টিমের সঙ্গে রাখা হয়েছিল। এ বার ব্রাজিল এনেও তাঁকে বেসক্যাম্প নিয়ে যাওয়া যায়নি অসুস্থতার জন্য। কিন্তু কাল এরিয়া কোরিন্থিয়ান্সে হাজির হতেই পারেন।

মঙ্গলবার বিশ্বকাপের সর্বকালের অন্যতম সেরা সেভ। হয়তো বা সর্বকাল সেরাই। আবার বৃহস্পতিবার চৌষট্টি বছরের পুরনো মন্ত্রোচ্চারণ। পঞ্চাশ বিশ্বকাপের জয়ের নায়কের সশরীর উপস্থিতি।

নবীন-প্রবীণ মিলে ব্রাজিল বিশ্বকাপ জমে গেছে। আরশোলা কেন, সাও পাওলোর দেওয়ালে হাতির শুঁড় এঁকেও আর কিছু হবে না!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement