ব্রাজিলের কাছে পেলে আজ নয়া নিরো

নাহ্! এমিরেটস এই বিশ্বকাপের অফিসিয়াল এয়ারলাইন হলে কী হবে, মেনুতে সেই আইটেমটা কোথাও খুঁজে পেলাম না! ব্রাজিলের কোনও কোনও শহরে যা নাকি এখন ঢালাও বিক্রি হচ্ছে! ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো স্যান্ডউইচ। এক কালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ পর্যটন বিভাগ বার্বেডোজগামী যে কোনও বিমানে লাইভ নাচের ব্যবস্থা রেখে যাত্রীদের তাক লাগিয়ে দিত। এখানে তেমন কোনও সাম্বা-বিলাসের ব্যবস্থা দেখা গেল না।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

সাও পাওলো শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৪ ০৩:১৭
Share:

কোপাকাবানার সৈকতে। সোমবার। ছবি: উৎপল সরকার।

নাহ্! এমিরেটস এই বিশ্বকাপের অফিসিয়াল এয়ারলাইন হলে কী হবে, মেনুতে সেই আইটেমটা কোথাও খুঁজে পেলাম না! ব্রাজিলের কোনও কোনও শহরে যা নাকি এখন ঢালাও বিক্রি হচ্ছে!

Advertisement

ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো স্যান্ডউইচ।

এক কালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ পর্যটন বিভাগ বার্বেডোজগামী যে কোনও বিমানে লাইভ নাচের ব্যবস্থা রেখে যাত্রীদের তাক লাগিয়ে দিত। এখানে তেমন কোনও সাম্বা-বিলাসের ব্যবস্থা দেখা গেল না। দুবাই থেকে ‘মাত্র’ ষোলো ঘণ্টার যে ফ্লাইটটা আদ্দিস আবাবা, দার-এস-সালাম, চাঁদের পাহাড় সব পিছনে ফেলে আটলান্টিক অতিক্রম করে সাও পাওলো এসে নামল— তা বলতে গেলে বিশ্বকাপ চার্টার্ড-ই। অথচ কোথাও উপচে পড়া প্যাশন নেই। আছে প্রযুক্তি, প্রচার আর অনবরত কাপের খবর সম্পর্কে লাইভ স্ট্রিমিং।

Advertisement

সারা দিনটা প্লেনে কাটিয়েও আপনি দিব্যি জেনে যাবেন, ক্যামেরুন ফুটবলারদের সঙ্গে তাঁদের ফেডারেশনের বোনাস নিয়ে শেষ মুহূর্তে কী ঝামেলাটাই না লেগেছিল। বা দেল পিয়েরো যে বলেছেন, রুনিকে এত বেপাত্তা করে দেবেন না। আমার তো মনে হচ্ছে ওর হাতেই ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ লুকিয়ে আছে।

বিমানযাত্রার দীর্ঘ সময়টা বহু দিন পর ‘ধুম-২’ বা ‘ডে অব দ্য জ্যাকল’ দেখে কাটাবেন যদি ভেবে রেখে থাকেন, সেই ভাবনাকে হারিয়ে দিতে টাচস্ক্রিনে বারবার ভেসে উঠছে বিশ্বকাপ। ভেসে উঠছে পেলে আর রোনাল্ডোর মুখ।

পাশে বসা যাত্রী ব্রাসিলিয়া-য় থাকেন। পেশায় আর্কিটেক্ট। টিভিতে পিটবুলদের অফিশিয়াল গানটা দেখাচ্ছে। মুখ কুঁচকে বললেন, “কোনও গানই হয়নি। ব্রাজিলিয়ান মিউজিকের সেই হট-হট ব্যাপারটা কোথায়? এর চেয়ে আগের বার শাকিরার ওয়াকা ওয়াকা অনেক ভাল হয়েছিল।” তরুণ আর্কিটেক্টের নেশা হল ইউটিউব থেকে সারা পৃথিবীর দোলা দেওয়া সব গান সংগ্রহ করা। এ ভাবেই প্রথম শোনেন ‘কাজরা রে’। আজও তাতে মুগ্ধ। বললেন, “ফিফা যা তা করছে। বরং ঐ ভুলভাল গানটা তৈরির পর আনঅফিসিয়াল কিছু কাপ-সং হয়েছে। শুনে দেখতে পারেন।”

ডান দিকের আইল সিটটায় এক প্রৌঢ় নিজের থেকেই পরিচয় দিলেন। ইনি মনোবিদ। সাও পাওলো শহরতলিতে প্র্যাকটিস করেন। পেলের চেয়ে ঠিক দু’বছরের ছোট। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে এর পর তিনি বিশ্বকাপের আসর বসানোর জন্য ফিফার মুণ্ডপাত শুরু করলেন। যোগ দিলেন তাঁর স্ত্রী। চার পাশে আরও কিছু মুখ। মাঝ আকাশেই মনে হতে লাগল, পেলের দেশে এখন গণভোট নেওয়া হলে ফিফা-র অবস্থা রাজ্য নির্বাচনে বুদ্ধ-বিমানদের মতো হবে!

পরে বুঝলাম, তখনও আসলে কিছুই শোনা হয়নি। পর্দায় পেলের অলৌকিক সব ড্রিবলগুলো দেখাচ্ছে। প্রৌঢ় ডাক্তার বলতে লাগলেন, “আমরা একই সঙ্গে বেড়ে উঠেছি। তুমি আমায় পেশেন্ট অবধি পাঠিয়েছো। আমাদের দেশকে কোথায় নিয়ে গ্যাছো। তিয়াত্তর বছর বয়সে এটা কী করলে! সমস্ত সম্মান বিকিয়ে দিলে ফিফা থেকে কিছু ডলার পাবে আর এই সরকারের পা চাটবে বলে?”

ব্রাজিলীয়রা এর পর বলা শুরু করলেন, “সর্বনাশ হয়ে যাবে টিমটা চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেলে। নভেম্বরে ভোট আসছে। আমাদের মহিলা প্রেসিডেন্ট স্রেফ ওই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার তোড়ে আবার ক্ষমতায় এসে যাবেন। ধ্বংস হয়ে যাবে ব্রাজিল!”

আলোচনায় বিস্ফারিত লাগলেও মনে হচ্ছিল, এটা কখনও সমগ্র ব্রাজিলবাসীর মনোভাব হতে পারে না। মনে হচ্ছিল, সহযাত্রীরা নির্ঘাৎ সমাজের উপরতলার লোক! ব্রাজিলের যে জনতা খেলাটাকে এত বছর মহাকাব্যিক স্তরে তুলে রেখেছে, এটা সেই জনগণের আওয়াজ হতেই পারে না।

জাম্পকাট।

সাও পাওলোর ব্র্যান্ড নিউ গুয়ারালৌজ এয়ারপোর্ট টার্মিনালে বরাবরের মতোই অব্যবস্থা। মালের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষায় পশ্চিমিরা উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন। ভারতীয়রা মনে মনে এয়ার ইন্ডিয়ার সাবেক যুগে ফেরত। ফিফার গেঞ্জি গায়ে কিছু লোক ঘুরছে ঠিকই। কিন্তু ফিফার হেল্প-ডেস্ক যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। মনে হল, ব্রাজিলে তো এই সব হওয়ারই কথা। ব্রাজিলে আবার কবে অঙ্ক কাজ করেছে! এটা তো প্যাশনের দেশ।

সেই দেশের রাস্তার দু’ধারে শপিং মলগুলোয় চল্লিশ-পঞ্চাশ ফুট উঁচু উঁচু ব্রাজিলীয় জার্সি। চার দিক হলুদ রংয়ে ভরা। রাজপথে গাড়ির উপর হলুদ পতাকা।

কিন্তু মানুষের মনে হলুদ রং কোথায়? সেখানে তো ফেটে বেরোচ্ছে তীব্র বিদ্বেষ।

সাও পাওলোর অন্যতম অভিজাত এলাকা জার্দিনসের পর্তুগিজ রেস্তোরাঁয় যে ছেলেটি পরিবেশন করছিল, তাকে দেখলেই মনে হয় কখনও ফুটবল খেলত! এ আদ্যন্ত ‘মাস’ না হয়ে যায় না। কিন্তু তার মুখেও তো একই কথা। “ফুটবল আমাদের এত ভালবাসার জিনিস। তা বলে আমাদের জীবনের চেয়ে বড় নয়।” দেশে চাকরি নেই। টাকা নেই। ছাঁটাই চলছে। তার মধ্যে কোটি কোটি ডলার খরচা করে স্টেডিয়াম! “স্টেডিয়াম কি খাওয়া যায়?” ছেলেটি ‘আনন্দের’ খবর দিল, সোমবার সপ্তাহের প্রথম দিনেও নাকি বিশ্বকাপ প্রতিবাদের অংশ হিসেবে মেট্রো স্ট্রাইক। মানে মানুষের দুর্ভোগ চরমে।

বোঝাই যাচ্ছে, বিরোধী রাজনৈতিক দল সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে এটা করাচ্ছে। কিন্তু ফুটবলপ্রেমী মানুষেরই তো উচিত এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো! তা হলেই তো রোমান্স আবার রোমান্সের জায়গায় ফেরত আসতে পারে! বাকি বিশ্বের কাছে ব্রাজিলের ভাবমূর্তিও বিপন্ন হয় না!

শুনেই খেঁকিয়ে উঠলেন চার তারা হোটেলের ফ্রন্ট ডেস্ক কর্মী। সাধারণত হোটেলে যারা কাজটাজ করেন, তাঁদের সম্পর্কে বলা হয়, চাকরিতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে দু’টো জিনিস তাঁদের ছাড়তে হয়। উত্তেজিত হওয়া আর তীব্র ব্যক্তিগত মতামত দেওয়ার অধিকার। হোটেল কর্মীর রাগ থাকলে চলবে না। মতামতও নয়। এইচ বি হোটেলস নাইন্টিতে যার সঙ্গে কথা বলছি, তার হয় সেই ট্রেনিং হয়নি! বা মনে রাখা এখন প্রয়োজন মনে করছে না।

টিভিতে পর্তুগিজ কিছু লেখা দেখাচ্ছে। তার তলায় ফুটবল। নিজেই তর্জমা করে দিল— ওয়েলকাম। আবার সেই ছবি—পেলে ড্রিবল করে যাচ্ছেন সত্তরের বিশ্বকাপে। তরুণ বলল, “এই রকম খারাপ সময়ে কেউ বিশ্বকাপ আয়োজন করে? আমাদের প্রেসিডেন্ট মহিলা না-হয় উন্মাদ! কিন্তু পেলে? তিনি কী করে সায় দিচ্ছেন? নাকি রোম পুড়ছে আর সম্রাট নিরোর মতো উনিও বেহালা বাজানোটা উপভোগ করছেন!”

হোটেল থেকে চেক আউট করে বার হচ্ছেন ব্রাজিলীয় মহিলা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন থাকার সুবাদে ইংরেজিটা গড়গড় করে বলতে পারেন। পেলে নিয়ে আলোচনা শুনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তার পর বললেন, “ফুটবলার পেলে হিসেবে পেলের সর্বত্র মূর্তি গড়া উচিত। আর গড়ার পর মানুষ হিসেবে ওঁর কাজকর্মের জন্য সেগুলো ভেঙে ফেলা উচিত।” এখানেই থামছে না ক্ষোভ, “দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। শিক্ষাখাতে টাকা নেই। মহিলারা রাতে রাস্তায় বের হতে নিরাপদ বোধ করে না। আর তুমি, দেশবরেণ্য পেলে, বিশ্বকাপের বিজ্ঞাপন করছ!”

শুনে ফের স্তম্ভিত লাগল। পেলে যত না ব্রাজিলের, তার চেয়েও বেশি তো সাও পাওলোর। সাও পাওলো যদি কলকাতা হয়, পেলের স্যান্টোস হল শক্তিগড়। পৌনে দু’ঘণ্টার রাস্তা। সেখানে দাড়িয়ে কী শুনছি? ব্রাজিলীয়রা এ সব কী বলছে! আইটি-র যে লোকটিকে এর পর পাওয়া গেল, সে দু’টো ম্যাচের টিকিট জোগাড় করে বন্ধুমহলে তীব্র বিক্ষোভের সামনে পড়েছে। বন্ধুরা মনে করে, নীতিগত কারণে টিকিট দু’টো তার ছেড়ে দেওয়া উচিত। দেশ সবার আগে। এমনকী ফুটবলেরও।

পেলের দেশে গোটা একটা দিন কাটিয়ে ফেলার এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় মন সায় দিতে চাইছে না। নিশ্চয়ই এর ও-পিঠে বরাবরের মতো উদ্দাম সমর্থক বাহিনী হলুদ ঝড় নিয়ে অপেক্ষায় থাকবে। র্যানডম স্যাম্পলিংয়ে শেষমেশ নিশ্চয়ই দেখা যাবে— দেশ দ্রুত হেরে যাক, এমন উচ্চাভিলাষীদের সংখ্যা অনেক কম ছিল!

কিন্তু বিদ্বেষের যে সব মুখ দেখলাম, তাকেই বা অগ্রাহ্য করি কী করে? স্যাম্পল হিসেবে যত ছোটই হোক, এটুকু তো দেখা যাচ্ছে যে, পালস্ রেটে অশান্তি আছে ব্যাপক। এক-এক সময় মনে হচ্ছে ফ্রেড, নেইমার বা অস্কারদের তা হলে বিপক্ষ ডিফেন্সের সঙ্গে ধারাবাহিক ভাবে আরও একটা ম্যাচ জিততে হবে। এমন দুর্ধর্ষ খেলে দেশবাসীর মন ভরিয়ে দিতে হবে, যাতে বিদ্বেষে বদলে যাওয়া পুরনো প্রেমকে আবার ফেরত আসে!

অর্থাৎ শুধু মেসি-রোনাল্ডোদের হারালেই চলবে না, আরও বড় ম্যাচে জয় চাই। ব্রাজিলীয় ফুটবল রোমান্সকে ফিরিয়ে দিতে হবে তার পুরনো বেদীতে।

১২ জুন থেকে তার মানে ব্রাজিলে দু’টো বিশ্বকাপ শুরু হচ্ছে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement