বিতর্কিত সেই সিদ্ধান্ত
ভিভিআইপি বক্সে বসে যখন ফ্রেডের পক্ষে দেওয়া পেনাল্টি সিদ্ধান্তে মাথা ঝাঁকিয়ে নিজস্ব প্রকাশ্য অনুমোদন জানাচ্ছেন সেপ ব্লাটার, তখন তিনি নিশ্চয়ই ভাবেননি জল এত দূর গড়াবে!
বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচের পর একটা মহাযুদ্ধই বলতে গেলে জেতার উপক্রম করে ফেলেছেন ফিফা মহাপ্রধান। ব্রাজিলীয় জনতার এমন একটা কামব্যাক ম্যাচ জিতে এত দিনকার বিশ্বকাপ বৈরি গনগনে মেজাজ গলে জল। কিন্তু ও দিকে যে নতুন শত্রু-সীমান্ত খুলে গেল। ফিফার বিরুদ্ধে একজোট হয়ে গেছে বাকি বিশ্ব। তাদের মতে, উদ্যোক্তা দেশকে মাঠে অসঙ্গত সুবিধে দিয়েছেন জাপানি রেফারি। এই ইউচি নিশিমুরাকে অবিলম্বে বিশ্বকাপ থেকে তাড়ানো হোক।
রিখটার স্কেলে এমনই সেই অভিযোগের তীব্রতা যে, সকালে গোল-লাইন প্রযুক্তির ওপর আগাম ঠিক করা একটা ফিফা সাংবাদিক সম্মেলন ছিল। সেখানে অধিকাংশ সময় গেল রেফারিং নিয়ে ক্ষোভের উত্তর খুঁজে বের করতে। আর ফিফা কর্তাদের চাপের মুখে বেশ অস্বস্তিতেই দেখাল। তখনও তাঁরা জানেন না, একটু পর তুলনামূলক ভাবে নিরামিষ মেক্সিকো-ক্যামেরুন ম্যাচে দুটো গোল নাকচ নিয়েও তীব্র অসন্তোষ দেখা দেবে! টুর্নামেন্টের প্রথম দুটো ম্যাচ আর দুটোতেই কিনা রেফারি খলনায়ক।
ফিফা কর্তাদের অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন গ্যারি লিনেকার। আন্তর্জাতিক ফুটবল সার্কিটে লিনেকারের বক্তব্যের একটা ওজন আছে। তা সেই লিনেকার টুইট করেছেন, “কালকের ম্যান অব দ্য ম্যাচ কে ছিল, রেফারি না নেইমার, এটা প্রায় সরু চুলের মতো তফাত।” এ দিন রিও মিডিয়া সেন্টারে রাশিয়ান সাংবাদিক তাঁদের দেশ থেকে আসা পেনাল্টি সংক্রান্ত প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছিলেন। সবই রেফারির বিরুদ্ধে। খোদ নিশিমুরার দেশ জাপানেই রেফারির বিরুদ্ধে উত্তেজিত প্রতিক্রিয়ায় দেশবাসী ফেটে পড়েছে। লুই ফিলিপ স্কোলারি কাল মিডিয়া কনফারেন্সে এসে বারবার বলার চেষ্টা করলেন, “ওটা পেনাল্টি। দশ বারে দশ বার পেনাল্টি।” কিন্তু বাকি বিশ্ব সেই কণ্ঠস্বরকে প্রবল ভাবেই কোরাস হতে দিতে চায় না।
বিতর্কিত সেই সিদ্ধান্তের পরিণতি। ক্রোট কন্যার কান্না। উদ্দাম ব্রাজিলীয় সুন্দরী।
জাপানের সোশ্যাল মিডিয়া এ দিন তীব্র কটাক্ষে বলেছে, রেফারি ব্রাজিলীয় জার্সি পরেছিলেন... কেউ কেউ লিখেছে ব্রাজিল যদি বিশ্বকাপ জেতে তা হলে নিশিমুরাকে বলা হবে এমভিপি, মোস্ট ভ্যালুয়েবল প্লেয়ার।
বৃহস্পতিবার মাঠে বসে মনে হচ্ছিল, নিশিমুরা শুরুতে কিন্তু খেলা নিয়ন্ত্রণেই রেখেছিলেন। তাঁর সমস্যা শুরু হয় ঠিক কলকাতার রেফারিদের বিপজ্জনক সরণিতেই! বড় টিম গোল খেয়ে যাওয়ার পর!
ঘরের মাঠে অবিসংবাদী ফেভারিট হারছে এবং দুর্দান্ত প্রতিআক্রমণ শানাচ্ছে অনামী বিপক্ষ— এই জায়গাতেই সম্ভবত নিশিমুরা খেই হারিয়ে ফেলেন। নইলে গোটা ম্যাচে তিনি বলের একেবারে কাছেই ছিলেন। হঠাৎই তাঁর সিদ্ধান্তে ব্যক্তিত্বের তীব্র অভাব শুরু হয়। ফ্রেডেরটা যদি পেনাল্টি হয়, তা হলে ক্রোয়েশিয়ার গোলটাই বা বাতিল হবে কেন?
রেফারিং নিয়ে ক্রোয়েশিয়া মাঠে যত অসন্তোষই প্রকাশ করে থাক, খেলার পর বিশ্ব ফুটবলের সুপার-পাওয়ার ব্রাজিলের বিরুদ্ধে এ ভাবে মুখ খুলবে, ভাবা যায়নি। ম্যাচের পর দু’তরফে যথেষ্ট সৌহার্দ্যপূর্ণ ভাবে জার্সি বদলও হয়। এর পর হঠাৎ আচমকা প্রতিআক্রমণে যাওয়ার মতো ফেটে পড়ে ক্রোটরা। তারা যে ভাবে গরল উগরে দিয়েছে, আইসিসি হলে এতক্ষণে সাসপেনশনের চিঠি ধরিয়ে দিত। বা বড়সড় কোনও জরিমানার। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ক্রোটদের প্রতিবাদী আওয়াজ এমন আন্তর্জাতিক অনুদান পেয়ে গিয়েছে যে, ইংল্যান্ড থেকে জার্মানি, রাশিয়া থেকে জাপান যে দুম করে কড়া শাস্তি ঘোষণা করলে না পরিস্থিতি আরওই বিপক্ষে চলে যায়।
মিডিয়া সেন্টারে ম্যাচ শেষ হওয়ার পরেও কেউ ভাবেনি যে, ক্রোয়েশিয়ান ডিফেন্ডার দুজোঁ লোভরেন সরাসরি বলবেন, “পেনাল্টির সিদ্ধান্তটা একটা কেলেঙ্কারি। আমরা গোটা ম্যাচ বারো জনের বিরুদ্ধে খেললাম।” তাঁর এক সহ-খেলোয়াড় বলেছেন, “এর জন্য যদি পেনাল্টি দিতে হয় তো গোটা টুর্নামেন্টে একশোখানা পেনাল্টি দিতে হবে।” ক্রোয়েশিয়ান প্লেয়াররা এমন কথাও বলেছেন যে, ফিফা চাইলে বিশ্বকাপটা ব্রাজিলকে আগাম দিয়ে দিক না। প্রহসন করার কী দরকার আছে?
অভিযোগ হিসেবে এগুলো সাংঘাতিক। কোরিয়া-জাপানে ২০০২ বিশ্বকাপেও রেফারিং নিয়ে নিয়মিত তীব্র অশান্তি হয়েছে। সেখানেও অভিযোগ উঠেছিল, রেফারি উদ্যোক্তা দেশকে টেনে খেলাচ্ছেন। কিন্তু প্লেয়াররা তাতে এত সরব হয়নি। আর মিডিয়াও তাকে আন্তর্জাতিক ইস্যু করেনি। এ বার ব্লাটারের ওপর পশ্চিমি প্রেস, বিশেষ করে ব্রিটিশ মিডিয়া এমনিতেই ক্ষিপ্ত। তাদের তিনি বর্ণবৈষম্যকারী— এত বড় গালাগাল দিয়েছেন। প্রথম সুযোগে অন্তত ব্রিটিশ প্রেসের তো প্রত্যাঘাত করারই কথা।
কিন্তু সে সবেরও আগে সাবেক প্রশ্ন, নিশিমুরার রেকর্ড এমন অসামান্য কিছু নয় যে বিশ্বকাপের এমন হাই ভোল্টেজ ম্যাচ পেতে পারেন। অতীতে বরঞ্চ খারাপ রেকর্ডই রয়েছে এক-আধ বার। তিনি ইংরেজি জানেন না। জানেন না স্প্যানিশও। এ ধরনের ম্যাচে রেফারির অন্তত ন্যূনতম ইংরেজি জ্ঞানটা খুব জরুরি। ক্রোয়েশিয়া যেমন ইংরেজিতে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেখেছে, রেফারি জাপানিতে উত্তর দিচ্ছেন। “একটা ভাষা সমস্যায় কণ্টকিত লোক কী করে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ পেতে পারে,” প্রশ্ন তুলেছে ক্রোয়েশিয়া। দাবি করেছে, এখনই বাড়ি পাঠানো হোক নিশিমুরাকে।
ফিফা যদি দাবি না-ও মানে, এই রেফারিকে আবার বড় ম্যাচ দেবে বলে মনে হয় না। আর এত সব দক্ষ ইউরোপীয় রেফারি থাকতে কেন এশিয়া? ব্লাটারের এশিয়া-আফ্রিকাকে খুশি রাখতেই হবে। ইউরোপীয় ভোট ব্যাঙ্ক তাঁর থেকে সরে গিয়েছে। তাদের খুশি করে ভোট বাজারে লাভ কী?
তবে আরও একটা এই মাত্রার বিতর্কিত সিদ্ধান্ত শুরু হলে টুর্নামেন্টের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন এসে যাবে। তখন আর রাজনৈতিক নির্বাচনে রেফারি মনোনয়ন চলবে না।
দুই মেরুতে চার বিশেষজ্ঞ
• সুব্রত সরকার, প্রাক্তন ফিফা রেফারি: ফ্রেড যে ভাবে পড়ে গেল সেটা দেখে প্রাথমিক ভাবে মনে হয়েছিল, ওটা পেনাল্টি নয়। রেফারি হয়তো প্লে অ্যাক্টিংটা বুঝতে পারেননি। জাপানের যে রেফারি ইউচি নিশিমুরা বৃহস্পতিবার রাতে ব্রাজিল-ক্রোয়েশিয়া ম্যাচ খেলালেন এবং পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দিলেন, ওঁকে আমি অনেক দিন চিনি। খুব দক্ষ রেফারি। ২০০৬ এএফসি কাপের সময় ওর সঙ্গে প্যানেলে ছিলাম। খুব কাছ থেকে নিশিমুরাকে দেখেছি। সে জন্যই রিপ্লেটা বার বার দেখলাম। আর রিপ্লে দেখার পরই আমি একশো শতাংশ নিশ্চিত হয়ে যাই, ওটা পেনাল্টি ছিল। বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত সব সময় সঠিক হয় না। মারাত্মক চাপে থাকেন রেফারিরা। মাঠের মধ্যে ফুটবলারদের চাপ। আর গ্যালারিতে সমর্থকদের। আসলে ঘটনাটি ঘটেছে পেনাল্টি এরিয়ার মধ্যে। ফ্রেডকে যে ভাবে লোভরেন টেনে ধরেছিল তাতে ফ্রেড শরীরের ব্যালান্স হারিয়ে ফেলে। সে জন্য হলুদ কার্ড দেখতে হয় ক্রোয়েশিয়ার ডিফেন্ডারকে। পেনাল্টি না দেওয়ার কোনও কারণই দেখতে পারছি না।
• এলকো সাতোরি, ইউনাইটেড স্পোর্টসের প্রাক্তন কোচ: আমি দশ হাজার ডলারের বাজি ধরছি, ওটা পেনাল্টি কোনও ভাবে ছিল না। বিশ্বকাপে এ ধরনের রেফারিং প্রত্যাশা করিনি। দেখবেন, এ রকম ঘটনা আবারও ঘটবে। কারণ ব্রাজিলকে চ্যাম্পিয়ন করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে প্রথম ম্যাচ থেকেই। ব্রাজিল ম্যাচ জিতুক, বিশ্বকাপ জিতুক, সেটা নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। কিন্তু এ ভাবে ম্যাচ জেতার কোনও কৃতিত্ব নেই।
• মার্কোস ফালোপা, ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্তন কোচ: আমি মাঠে ছিলাম। পুরো খেলা দেখেছি। পেনাল্টির সিদ্ধান্ত একেবারে ঠিক। যারা পেনাল্টি নয় বলছে, তাদের ফুটবল জ্ঞান সম্পর্কে আমার সন্দেহ রয়েছে। ফ্রেডকে পরিষ্কার ফেলে দেওয়া হয়েছে। তাও পেনাল্টি বক্সের মধ্যে। এটা পেনাল্টি হবে না তো, কোনটা হবে?
• গ্যারি লিনেকার, ইংল্যান্ডের প্রাক্তন ফুটবলার (টুইটারে): আয়োজক দেশ সব সময়ই এ ধরনের একটা সুবিধে পেয়ে থাকে! আর ব্রাজিল সেটা খুব তাড়াতাড়ি ব্যবহার করে ফেলল। কালকের ম্যান অব দ্য ম্যাচ কে ছিল, রেফারি না নেইমার, এটা প্রায় সরু চুলের মতো তফাত।