বাঁচবে কী, ব্রাজিলের ফুসফুসটাই তো জীর্ণ

ব্রাজিলের সাত গোল খাওয়া দেখতে দেখতে নব্বইয়ের বিশ্বকাপ প্রি-কোয়ার্টারে ব্রাজিল ম্যাচটার কথা মনে পড়ছিল। সে বার মারাদোনার আর্জেন্তিনার কাছে কারেকাদের বিশ্বকাপ অভিযান শেষ হওয়ার পর তুরিনের দেলা আলপি স্টেডিয়ামে বসে দেখেছিলাম ব্রাজিলীয় সুন্দরীদের কান্না।

Advertisement

চুনী গোস্বামী

শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৪ ০৪:৩০
Share:

কান্না ও সান্ত্বনা। মঙ্গলবারের বিপর্যয়ের পর। ছবি: এএফপি ও রয়টার্স।

ব্রাজিলের সাত গোল খাওয়া দেখতে দেখতে নব্বইয়ের বিশ্বকাপ প্রি-কোয়ার্টারে ব্রাজিল ম্যাচটার কথা মনে পড়ছিল। সে বার মারাদোনার আর্জেন্তিনার কাছে কারেকাদের বিশ্বকাপ অভিযান শেষ হওয়ার পর তুরিনের দেলা আলপি স্টেডিয়ামে বসে দেখেছিলাম ব্রাজিলীয় সুন্দরীদের কান্না।

Advertisement

এ বার কলকাতায় বসেই বুঝতে পারছি, জার্মানির কাছে ব্রাজিল যে ভাবে পর্যুদস্ত হল তাতে পেলের দেশের ফুটবল-মস্তিষ্কে একটা বড়সড় পক্ষাঘাত হয়ে গেল।

কিছুতেই মেলাতে পারছি না জিকো, সক্রেটিস, ফালকাও, রোমারিও, রোনাল্ডো, রোনাল্ডিনহোর ব্রাজিলের সঙ্গে স্কোলারির এই ব্রাজিলকে। সারা দিন নিজেকেই প্রশ্ন করেছি এ কোন ব্রাজিল? যারা আমাদের চোখ দু’টোকে ব্রিটিশ প্রভাবিত ‘কিক অ্যান্ড রান’ ফুটবল থেকে সরিয়ে এনে মন মাতিয়ে দিয়েছিল সম্পূর্ণ অন্য ঘরানার ফুটবল দিয়ে! ১৯৫৫ থেকে ব্রাজিলীয় ফুটবলের মাহাত্ম্য বুঝতে শিখেছি। পেলে, গ্যারিঞ্চা, ডিডি, ভাভা জাগালো থেকে টোস্টাও, রিভেলিনোসবার খেলা দেখে মনে হত ফুটবল নিয়ে ম্যাজিক হচ্ছে সবুজ গালিচার ওপর। যেমন বল কন্ট্রোল, তেমন পাসিং, তেমন ড্রিবলিং!

Advertisement

এই দলে সেই ব্রাজিলীয় ফুটবলের একমাত্র বংশধর নেইমার। আর কিছুটা অস্কার। বাকিরা অতি সাধারণ। ভাবা যায়, এ বারের বিশ্বকাপে বত্রিশ দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফাউল করেছে ব্রাজিল! যাদের খেলা দু’চোখ জুড়িয়ে দিত, আজ তাঁরা খেলছে গুঁতোগুঁতির ফুটবল। এই গুস্তাভো, পওলিনহো, ফ্রেড, হাল্কদের নিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার আশা না করাই ভাল ছিল, যারা কিনা ডিফেন্স থেকে আসা ডায়াগোনাল বল রিসিভ করতেই হিমশিম খায়। মঙ্গলবার রাত জেগে টিভিতে এই ব্রাজিলের খেলা দেখে এক সময় কান্না পাচ্ছিল! শিউরে উঠছিলাম। কোথায় সেই পাসিং, ড্রিবলিং, অন অ্যান্ড অফ দ্য বল দৌড়! বদলে গুচ্ছের মিস পাস, একটাও ঠিক ফরোয়ার্ড পাস নেই!

এর প্রধান কারণ, আগের ব্রাজিলের মিডফিল্ড যদি হয় তাজমহল, এই ব্রাজিলের মিডফিল্ড তা হলে জীর্ণ প্রাসাদ। ফুটবলে মাঝমাঠই ফুসফুস। মাঝমাঠই হৃৎপিণ্ড। আটান্নর বিশ্বকাপ ফাইনালে পেলেরা চার মিনিটের মধ্যেই পিছিয়ে পড়ার পর ভাভা সেন্টার সার্কলে বল বসিয়ে পেলেকে বলেছিল, “পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমরা গোল শোধ করব।” ভাভা সমতা ফেরাতে সময় নিয়েছিল তার চেয়ে এক মিনিট কম। ম্যাচের ন’মিনিটে ব্রাজিল ১-১ করার পর শেষ পর্যন্ত ৫-২ জেতে। সেই মস্তানি কিংবা নেতৃত্বটাই এই ব্রাজিলের নেই।

রেকর্ডের খেলা। সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

সেমিফাইনালে আমি তাই কখনওই এগিয়ে রাখিনি ব্রাজিলকে। তবে জার্মানরা যে ৭-১ জিতবে তা অতি বড় জার্মান সমর্থকও নিশ্চয়ই ভাবেনি। জার্মানরা মিডল, ডিফেন্সিভ আর অ্যাটাকিং থার্ড, তিনটেতেই সমান শক্তিশালী। একদম ব্যালান্সড দল। যাদের খেলা বিরাট ভাবে চোখে না পড়ুক, সব সময় ভীষণ কার্যকরী। থিয়াগো সিলভা আর নেইমারের না থাকাটা আরও বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিল পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের। কিন্তু স্কিল, মোটিভেশন, রক্ষণ সংগঠন, ট্যাকল সবেতেই তো ক্রুজ, খেদিরারা পিছনে ফেলে দিল ব্রাজিলকে। ডিফেন্সে যেমন মার্সেলোদের কারও ন্যূনতম পজিশন জ্ঞান চোখে পড়ল না, তেমনই আক্রমণে হাল্ক, ফ্রেড, বার্নাডরা না রাখল গোলমুখী ক্রস, না নিল বেশি গোলে শট!

এই ব্রাজিলের ভবিষ্যৎ কী? ১৯৫০-এর ফাইনালে মারাকানায় বিপর্যয়ের আট বছরের মধ্যে ব্রাজিলের হাতে প্রথম বিশ্বকাপ তুলে দিয়েছিল আঠারো বছরের পেলে। ২০১৪-তে মিনেইরোয় এই পক্ষাঘাতের পর নতুন কিছু হবে কি? সাম্বা ফুটবলের ছাই সরিয়ে সেই চেনা ব্রাজিল ফিনিক্স পাখির মতো ফুটবল-আকাশে আবার পাখা মেলবে কি?

উত্তরটা হয়তো লুকিয়ে রয়েছে বাইশ বছরের নেইমারের পায়ে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement