কোপাকাবানা তটে: দিন ১ • ব্রাজিলে ব্রাজিল • এরিনা কোরিন্থিয়ান্স

ফুটবলের মক্কার ধর্মরক্ষায় আজ থেকে স্বয়ং ফুটবলই নামছে

এখন দুপুর একটা। এরিনা কোরিন্থিয়ান্সের বাইরে বেশ কিছু জটলা। অন্তত ছয়-সাতটা শাখা উপশাখা গেটের মুখে দাঁড়িয়ে। কিন্তু কেউ জানে না তাদের নিয়ে কী করতে হবে। মিডিয়া সেন্টার খুলেছে সকাল ন’টায়। এখনও সেখানে হেল্প ডেস্কে জনপ্রাণীর দেখা নেই। ইন-চার্জ বললেন, মনে হচ্ছে সবাই আটকে গিয়েছে। কিন্তু কেন আটকাবে? বুধবার তো ধর্মঘটীরা মেট্রোকে ছাড় দিয়েছে। অন্তত আজ তো স্টেডিয়ামে পৌঁছনোটা সমস্যা হওয়া উচিত নয়! এ বার ভদ্রলোকের কোনও উত্তর নেই।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

সাও পাওলো শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৪ ০৩:৫২
Share:

ঝড় তোলার মহড়া। ছবি: রয়টার্স।

এখন দুপুর একটা। এরিনা কোরিন্থিয়ান্সের বাইরে বেশ কিছু জটলা। অন্তত ছয়-সাতটা শাখা উপশাখা গেটের মুখে দাঁড়িয়ে। কিন্তু কেউ জানে না তাদের নিয়ে কী করতে হবে।

Advertisement

মিডিয়া সেন্টার খুলেছে সকাল ন’টায়। এখনও সেখানে হেল্প ডেস্কে জনপ্রাণীর দেখা নেই। ইন-চার্জ বললেন, মনে হচ্ছে সবাই আটকে গিয়েছে। কিন্তু কেন আটকাবে? বুধবার তো ধর্মঘটীরা মেট্রোকে ছাড় দিয়েছে। অন্তত আজ তো স্টেডিয়ামে পৌঁছনোটা সমস্যা হওয়া উচিত নয়! এ বার ভদ্রলোকের কোনও উত্তর নেই।

গায়ক পিটবুলের সাংবাদিক সম্মেলন শুরু হওয়ার কথা ছিল সকাল সাড়ে দশটায়। তিনি, ক্লডিয়া লিটেই আর জেনিফার লোপেজ কাল লাইভ গাইবেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। জে লো নিজেকে প্রথমে সরিয়ে নিয়েছিলেন উদ্বোধন থেকে। শর্ত নিয়ে বনিবনা হচ্ছিল না। ফিফা শেষ পর্যন্ত তাঁকে নাকি রাজি করিয়েছে। পিটবুলের সম্মেলনে তাই লেখার উপাদান পাওয়া যেতেই পারে। কিন্তু কোথায় কী! পঁয়তাল্লিশ মিনিট অপেক্ষার পর বেরিয়ে এলাম। বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্টে সব কিছু সেকেন্ড মেপে চলে। আর সেখানে কিনা দিনের প্রথম প্রেস ইন্টার্যাকশন পৌনে এক ঘণ্টা দেরিতে রান করছে!

Advertisement

স্টেডিয়ামে এখনও ঠুকঠাক আর শেষ মুহূর্তের রঙের টাচ চলছে। ব্রিটিশ মিডিয়া মানাউস মাঠ নিয়ে এত বিচলিত হয়ে পড়েছে যে, এক দিকের গোলপোস্টের চাপড়া হয়ে থাকা জায়গাটার ছবি ছাপিয়েছে বড় করে। বলেছে এ কী শুকনো, বালি ভরা মাঠ। স্টেডিয়ামে খোলা কেবল এখনও ঝুলছে। কে বলবে দেখে মাত্র তিন দিন বাদে ইংল্যান্ড-ইতালির মতো বড় ম্যাচ?

ব্রিটিশ প্রেস আমাজনের দিকটায় না থেকে সাও পাওলোয় আপাতত বসবাসকারী হলে আতঙ্কের এত কারণ খুঁজে পেত না। মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা দূরে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ। তার জন্যই এখনও যথেষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হল না তো ১৮ জুনের মানাউস আগামী জন্মের ব্যাপার!

বিশ্বকাপের মতো একটা ইভেন্ট, যাকে বলা হয়ে থাকে গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ, তার হিরের ঝলক কোথায় ব্রাজিল-ক্রোয়েশিয়া ম্যাচ প্রাক্কালে? ভলান্টিয়াররাই এখনও যথেষ্ট গোছগাছ করতে পারেনি তো অতিথিদের কথা ভেবে কী লাভ? ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফ যদিও গতকাল আক্রমণাত্মক ভাষণে গোটা বিশ্বকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন, সব ঠিকঠাক হবে। বলেছেন, “নেতিমূলক সব ভাবনাকে আমরা ইতিমধ্যে হারিয়ে দিয়েছি। আর দেশবাসীদের মধ্যে যারা বিভ্রান্ত, তাদের বলি বিদেশিরা এসে ওদের স্যুটকেস করে আমাদের পরিকাঠামো নিয়ে চলে যাবে না। ওগুলো বিশ্বকাপের জন্য তৈরি হয়েছে আর আমাদের দেশেই থাকবে।”

চুরাশি বছরের বিশ্বকাপে এ বারটা কুড়িতম। বিতর্ক কমবেশি অনেক বিশ্বকাপ বা অলিম্পিক ঘিরেই ঘটে। আথেন্স অলিম্পিক শুরুর আগেও তো কত কাণ্ড হয়েছিল। কিন্তু তার জেরে কোথাও ইভেন্ট শুরুর চব্বিশ ঘণ্টা আগে এ ভাবে দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে নেমে পড়তে হয়নি।

ফিফা ঝাঁপিয়ে পড়ে উদ্যোক্তা দেশকে বাঁচাবে কী, তার নিজের গোলপোস্টেই তো মুহূর্মুহূ আক্রমণ হচ্ছে। ম্যাচ তো শুধু এরিনা কোরিন্থিয়ান্সেই হচ্ছে না। সাও পাওলো হিলটন হোটেলেও ঘটছে ফিফা কংগ্রেসে। ব্রিটিশ প্রেসকে গতকাল বর্ণবৈষম্যবাদী বলে ফিফা মহাকর্তা সেপ ব্লাটার এমন নজিরবিহীন বিতর্কে নিজেকে ডুবিয়েছেন যে, তার আগুন এখন বহু দিন চলবে। ব্লাটারের বিরুদ্ধে কাতারকে ২০২২-এর বিশ্বকাপ দেওয়া নিয়ে যা কলঙ্কিত অভিযোগ, তার পাশে শ্রীনি-কাহিনি কিশোর সাহিত্য সিরিজ! ইউরোপীয় দেশগুলো এখন একজোট হয়ে গিয়েছে। কিছুতেই ব্লাটারকে আবার প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়াতে দেবে না। ব্লাটার ঝানু রাজনীতিবিদ। তিনি এত সহজে গদি ছাড়ার পাত্রই নন। দু’চারটে হার্ড ট্যাকল হচ্ছে, হোক।

সব মিলিয়ে ব্রাজিলের গৃহযুদ্ধই একটা কাঁটার মতো টুর্নামেন্টটাকে গত এক বছর ক্রমাগত কামড়াচ্ছিল। তার সঙ্গে যোগ হল ফিফার গৃহযুদ্ধ। বিশ্বকাপ ফুটবল শুরুর আগে কখনও এমন সাঁড়াশি আক্রমণের সামনে পড়েনি। ফিফা প্রাণপণ চেষ্টা করছে জমকালো উদ্বোধন করে ব্রাজিলীয় জনতার মন ফিরিয়ে নিতে। উদ্বোধনী পারফরম্যান্সের থিম হল ব্রাজিলের প্রকৃতি, মানুষ আর ফুটবল। অবশ্যই এঁরা গাইবেন বিশ্বকাপের থিম সং— উই আর ওয়ান।

কিন্তু এ তো অলিম্পিক উদ্বোধন নয় যে, একটা দিনে পৃথিবীজোড়া কয়েকটা বিভিন্ন প্রজন্মের মন ভাল করে দিতে পারে। সাও পাওলোর উদ্বোধন পেলে সমন্বিত যত জৌলুস ভরাই হোক, চলবে তো মাত্র আধ ঘণ্টা। কত আর রেশ থাকতে পারে! জনতার মনটাই তো কিছুটা নেগেটিভ দিকে চলে গিয়েছে। ফুটবলের বাইরে। নইলে বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে লুই ফিলিপ স্কোলারির ভাগ্নে পথ দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন জেনেও মিডিয়ায় তীব্র চাঞ্চল্য নেই কেন?

আসলে এমন একটা অচিন্তনীয় পরিস্থিতি যে, ফুটবলের মক্কায় স্বয়ং ফুটবলই কিক-অফের আগে আন্ডারডগ!

সান্তোস বিচের ঠিক উল্টো দিকের দোকানগুলো নেইমার দ্য সিলভার ছবি আর ব্রাজিলের ফ্ল্যাগে ছয়লাপ।

সাও পাওলোর রাজপথে একটু পরপর থিয়াগো সিলভার মুখ দেখাচ্ছে চৌকো আইল্যান্ড বিলবোর্ডে। হাতে একটা কিছু। হতে পারে কনফেডারেশনস কাপ। কিন্তু লোকে বিশ্বকাপই বুঝছে।

জার্ডিনস নামক এখানকার আলিপুরে শপিং মলের বাইরে তৈরি করা বিশাল ফুটবলের সামনে চুমু খাচ্ছে পুরুষ-নারী। ওটা এখন শহরে ফটো তোলার একটা জনপ্রিয় জায়গা।

গোটা সাও পাওলো ছেয়ে গিয়েছে বড় বড় লেখায়: কোপা দ্য মুন্ডো। বম ভিন্দো। অর্থাৎ, বিশ্বকাপে আপনাকে স্বাগত।

সবই আছে কিন্তু কোথাও কিছু যেন একটা নেই। প্রতিমার প্রাণপ্রতিষ্ঠা কিছুতেই হচ্ছে না।

সাও পাওলোয় এখন মাঝে মাঝেই ঠান্ডা। সকাল সাতটায় জ্যাকেট ছাড়া বেরোলে আর একটা বর্গীয় ‘জ’-কে বেছে নিতে হবে—জ্বর! কিন্তু শহরের জলহাওয়ায় ঠান্ডা থাকবে বলে টুর্নামেন্ট এত কাছে এসেও গরমাগরম আকার নেবে না কেন! মাঠের বাষট্টি হাজার সিট কানায়-কানায় ভরে যাবে। কিন্তু ব্রাজিলে কবে সিট ভরে যাওয়াটা প্রথম ও শেষ কথা হয়েছে!

সিআর সেভেন সহ পর্তুগাল অবশ্য এসে গিয়েছে বুধবার সকালে। তাঁদের ঘাঁটি সাও পাওলো থেকে একশো কিলোমিটার দূরের ক্যাম্পিনাসে। সকালে এফএমে বারবার করে রোনাল্ডো-রোনাল্ডো শুনে অন্তত এটুকু বুঝলাম, এফএম চ্যানেলের আর জে নতুন অতিথি আগমনে যথেষ্ট উত্তেজিত। মেসিরাও সদলবলে এসে গিয়েছেন। কোপা দ্য মুন্ডো জমজমাটের জন্য কি ডিফেন্ডারের বুটের ওপর দিয়ে মেসির ড্রিবল করে যাওয়া বা রোনাল্ডোর সশব্দ দাদাগিরির অপেক্ষা?

নাকি বিশ্বকাপ জীবন্ত করে দেবেন হিসেবের মধ্যে না ধরা ওয়েন রুনির মতো কেউ। রুনি সম্পর্কে নাগাড়ে চলতে থাকা সমালোচনায় এ দিন বেশ ক্ষিপ্ত মনোভাব দেখিয়েছেন ম্যান ইউ সহকারী কোচ ফিল নেভিল। ক্লাব কোচেরা চট করে বিশ্বকাপ বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন না। কিন্তু নেভিল থাকতে না পেরে বলেছেন, “ওয়েনকে নিয়ে হচ্ছেটা কী! ও যে টিমের বেস্ট প্লেয়ার তা নিয়ে কারও কোনও সন্দেহ আছে নাকি?”

কে বলতে পারে রুনির ডান পা কোনও স্ফুলিঙ্গ তৈরি করে দেবে না কুড়িতম বিশ্বকাপে। বা সের্জিও আগেরো...বা টমাস মুলার...দিয়েগো গোডিন...চোট কাটিয়ে উঠে সুয়ারেজ...বা ম্যান সিটি খ্যাত ইয়াইয়া তোরে!

গোটা কয়েক মুহূর্ত চাই যা শিল্প, পুরুষ আর পারফেকশনের টানে টুর্নামেন্টটার প্রকৃত কিক-অফ করিয়ে দেবে! একটা ফুলকি চাই...একটা র এনার্জি চাই...একটা অসামান্য বল নিয়ে প্যাশন চাই...বত্রিশটা দেশের সাড়ে সাতশোর কাছাকাছি ফুটবলার। একত্রিশ দিন হাতে। একাধিক স্ফুলিঙ্গ তৈরি হবে না বারোটা অনুষ্ঠান কেন্দ্রের কোথাও না কোথাও, হতে পারে কখনও! তখন কে ব্লাটার। কে বিক্ষোভকারী। কে ব্রাজিলের মহিলা প্রেসিডেন্ট!

যৌথ গৃহযুদ্ধে ফুটবল বিপন্ন তো কী, বিষ্যুদবার ভারতীয় সময়ে রাত দেড়টা থেকে স্বয়ং ফুটবলই তো নিজস্ব ধর্মউদ্ধারে নামছে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement