টিম ডিরেক্টর রবি শাস্ত্রীকে নিয়ে ধোনি।
গাব্বায় ঢোকার মুখে ডান দিকের কোণে ছোট ক্রিকেট ব্যাটটা রাখা। তার ওপর ছড়ানো ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ। আর ব্যাটে লেখা ‘৬৩ নটআউট’।
ভেতরে নতুন অধিনায়কের অধীনে প্র্যাকটিস করছে অস্ট্রেলিয়া। হঠাত্ করে এত কম বয়সে স্টিভ স্মিথকে অধিনায়ক বানিয়ে দেওয়া সেই মনসুর আলি খান পটৌডিকে বাষট্টিতে ক্যাপ্টেন করে দেওয়ার মতোই চাঞ্চল্যকর। নেটের বাইরে অজি সাংবাদিকদের ভিড়টা ফুটন্ত থাকা উচিত নতুন অধিনায়ক নিয়ে আলোচনায়। তা-ও আবার ট্রেভর হন্স সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অস্ট্রেলীয় নির্বাচক কমিটির অন্যতম সদস্যকে দেখলে মিডিয়ার মুখ আরওই নিশপিশ করা উচিত, এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। আমরা ঘুণাক্ষরেও টের পেলাম না!
তা হন্স এগিয়ে আসতেই সাংবাদিকেরা জিজ্ঞেস করলেন, রাত্তিরে কাল টিভি দেখছিলেন? কী নৃশংস না সিডনির ঘটনাটা? স্টিভ স্মিথ তিনি অজি অধিনায়ক হিসেবে জীবনের প্রথম প্রেস কনফারেন্স শুরুই করলেন এই বলে যে, মার্টিন প্লেসের ঘটনায় মৃত দুই ব্যক্তির পরিবারবর্গকে আমাদের টিমের পক্ষে গভীর সমবেদনা জানাই। ক্যাপ্টেনের বলা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও দেখলাম বিখ্যাত স্থানীয় ক্রিকেট-লিখিয়ে রবার্ট ক্র্যাডক নীচে নতুন অধিনায়কের সঙ্গে দেখা করার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন।
“আরে জানাই হয়নি কাল ওরা কালো আর্মব্যান্ড বেঁধে নামছে তো?”
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি এর পর এলেন মিডিয়ার সামনে। সবাই ধরে নিয়েছে এত দিন পরে তাঁকে পাচ্ছে সাংবাদিকেরা, আজ তো প্রশ্নের তুফান উঠবে। বিশেষ করে ভারতীয় সাংবাদিকেরা যতই অপ্রিয় হতে না চান। এখানকার মিডিয়া জিজ্ঞেস করবেই যে, ভারতের সুপ্রিম কোর্টে আপনার নাম উঠছে। নেটে দেখছি আপনি আদালত নিযুক্ত কমিটির সামনে মিথ্যে বলেছেন। ব্যাপারটা কী?
কেউ জিজ্ঞেসই করল না আজকের দিনে। বিরাট কোহলির নামটা বারবার প্রশংসাসূচক ভাবে উঠল। গাব্বায় আজ পর্যন্ত ভারত কখনও যে অস্ট্রেলিয়াকে হারায়নি। আর অস্ট্রেলিয়াও এখানে গত চব্বিশ বছর অপরাজিত থেকে দুর্ভেদ্য এক দুর্গ। এই সব প্রসঙ্গ উঠল। কিন্তু একেবারেই তেজিয়ান ভাবে নয়। চিন মিউজিকের কোনও ব্যাপারই আজ নেই।
রায়ান হ্যারিস চোট থাকায় খেলবেন না। রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে খেলানো হতে পারে। দুটো সিদ্ধান্তই ম্যাচের ওপর অমিত প্রভাবশালী হওয়ার বারুদ রাখে। কিন্তু টেস্টের মাঝে যদি বা এঁরা জ্বলজ্বলে ভাবে ভেসে ওঠেন, আজ তাঁদের দিন নয়। সকালে সিডনি বিমানবন্দর থেকে বিকেলের গাব্বা দুটো নামই বারবার আলোচিত হচ্ছে।
টোরি জনসন আর ক্যাটেরিনা ডসন। একজন লিন্ড চকোলেট কাফের তরুণ ম্যানেজার। অন্য জন তিন বাচ্চার মা। অত্যন্ত প্রতিশ্রুতিমান আইনজীবী। দু’জনেই গত কাল মধ্যরাতে প্রয়াত।
মার্টিন প্লেসে যেমন ফুলে ফুলে অভূতপূর্ব একটা সমাধিই তৈরি করে দিয়েছে সিডনিবাসীরা। জেফ টমসন, ম্যাথু হেডেনদের শহরে তা নেই। কিন্তু মানুষের মনেও তো ভ্রাম্যমাণ চিতা থাকতে পারে আর সেই শোকের আগুনে খানিকটা ঢাকা পড়ে গিয়েছে গাব্বা টেস্ট ম্যাচ। ফিল হিউজের জন্য অ্যাডিলেড এমনই দুঃখের জলসাঘরের মধ্যে টেস্ট ম্যাচ শুরু করেছিল। কে জানত, বিরাট কোহলির বীরত্বের মাধ্যমে ক্রিকেট আবার মূল মঞ্চে ফেরত আসাটা সাময়িক হবে। আবার ঢেকে দেবে নতুন এক দমকা দুঃখ!
নতুন অধিনায়ক স্মিথের সঙ্গে লেম্যান।
শোকবাসরের ভাইরাস থেকে এক জনই মনে হল খুব সফল ভাবে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ। তিনি মহেন্দ্র সিংহ ধোনি।
বললেনও, “আমি খুব প্র্যাকটিক্যাল মানুষ। আবেগে চট করে ভেসে যাই না।” অ্যাডিলেড টেস্টকে যে ভাবে বিভাজন করে তিনি ব্রিসবেনের ঘুঁটি সাজাচ্ছেন, তার মধ্যে একটা হিসেবি বিচক্ষণতা আছে। যা কোহলির রাজপুতসদৃশ শৌর্যের মতোই তাত্পর্যপূর্ণ। যে ধোনিকে এ দিন সাংবাদিক সম্মেলনে দেখলাম, বিদেশে টেস্ট ক্রিকেট ঘিরে শেষ কবে তাঁকে এত সজাগ দেখেছি, মনে পড়ল না।
ধোনি বললেন, বিপক্ষ অফস্পিনারদের জন্য ফুটমার্ক হতে দেওয়া যাবে না। বোঝা গেল রাউন্ড দ্য উইকেট স্ট্র্যাটেজি একমাত্র বিকল্প হবে না।
বললেন টেলএন্ডারদের তো রান করতে হবে। অশ্বিন থাকলে এই সুবিধেটা হয়। ব্যাটটা করে দিতে পারে। বোঝা গেল অ্যাডিলেডে চা-বিরতি পরবর্তী বিপর্যয়ের ওষুধ খুঁজছেন। ভারতীয় পজিটিভ মনোভাব ঘিরে ধন্য ধন্যতে ভেসে না গিয়ে।
বললেন, উইকেট অনুকুল না থাকলেও আমার স্পিনারকে প্রথম বা দ্বিতীয় দিন কতটা বল করানো হবে সেটা ভাবতে হবে। কারণ ওভারপিছু সাড়ে পাঁচ রান করে দিয়ে দিলে তো মুশকিল। অর্থাত্ কর্ণ শর্মার প্রতিশ্রুতির নামে একগাদা রান দেওয়াকে বিশ্লেষণ করেছেন।
বললেন, “সবাই বলছে ঘাসে মোড়া বাউন্সের উইকেট মানে আমাদের গেল গেল। আমি এবং আমার টিমের কেউ যদিও ব্রিসবেনে একটা টেস্ট ম্যাচেও খেলিনি। তবু এই গেল গেল দুঃখবাদীদের আমি মনে করিয়ে দিতে চাই, বিদেশে ঠিক এই রকম পরিবেশে আমরা বেশ কয়েকটা টেস্ট ম্যাচ জিতেছি। ঘাস আর বাউন্সের মধ্যে আমাদের বোলিংটা আসলে অনেক ভাল হয়ে যায়। আমি যদিও ক্রিকেট স্ট্যাটিস্টিক্সের ভাল ছাত্র নই, হিসেবগুলো কেউ না কেউ দিয়েই দেয়। যে ডারবান, জো’বার্গ, পারথ, লর্ডস।” তার মানে টিমকেও সফরকারী অধিনায়ক এই হিসেবগুলো দিয়ে অনুপ্রাণিত রাখবেন।
কোথাও মনে হচ্ছে কোহলি ভারত অধিনায়কত্বের লেভেলটা এক টেস্টেই তুলে দেওয়ায় সামান্য জং পড়ে যাওয়া এমএসডি গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছেন। টিমের মধ্যে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা হলেও যদি রেশটা থাকে, তা হলে ভাল। ভারত দুঃখকে ব্রিসবেন নদীতে ফেলে দিয়ে তা হলে ক্রিকেটের জলসাঘরকে আবার স্থাপন করতে পারে গাব্বার ভেতরে!
ছবি: গেটি ইমেজেস