হিসেব ওলটপালট করে রেখে দিলেন তখত

জোড়া ‘এম’-এর বিরুদ্ধে শ্রীনির নিরঙ্কুশ জয়

ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডে একাধিপত্য কায়েম থেকে গেল নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসনের! আরব সাগরের তীরে রবিবাসরীয় মহাবৈঠকে ব্যর্থ হয়ে গেল বিরোধীদের উচ্চাকাঙ্খী বিপ্লব। অথচ কাগজকলমে তাঁরাই ছিলেন ফেভারিট। নিজে অনুপস্থিত থেকেও বিরোধী জোটকে হারিয়ে দিয়ে শ্রীনিবাসন অশনিসঙ্কেত দিলেন তাঁদের— সেপ্টেম্বরে পরের বোর্ড নির্বাচনেও আমি আছি!

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য ও রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৩৩
Share:

‘ভাল খেলিয়াও পরাজিত’। মুম্বইয়ে বোর্ড মিটিংয়ে শিবলাল যাদবের সঙ্গে শ্রীনি-প্রতিদ্বন্দ্বী শশাঙ্ক মনোহর। ছবি: পিটিআই

ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডে একাধিপত্য কায়েম থেকে গেল নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসনের! আরব সাগরের তীরে রবিবাসরীয় মহাবৈঠকে ব্যর্থ হয়ে গেল বিরোধীদের উচ্চাকাঙ্খী বিপ্লব। অথচ কাগজকলমে তাঁরাই ছিলেন ফেভারিট। নিজে অনুপস্থিত থেকেও বিরোধী জোটকে হারিয়ে দিয়ে শ্রীনিবাসন অশনিসঙ্কেত দিলেন তাঁদের— সেপ্টেম্বরে পরের বোর্ড নির্বাচনেও আমি আছি!

Advertisement

মুম্বইয়ের ক্রিকেট সেন্টারে সভা শেষ হয়ে যাওয়ার ঘণ্টা তিনেক বাদেও বিস্ময় কাটছিল না অনেকের। ভারতীয় ক্রিকেটমহল ধরে নিয়েছিল আজ পালাবদল ঘটতে যাচ্ছে। তারা বেশি বিস্মিত, কী করে ফের পাশার ঘুঁটি ঘুরিয়ে দিলেন শ্রীনিবাসন। ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে জড়িত লোকেরা অবশ্য বিস্মিত হওয়ার কোনও কারণ দেখছেন না। পশ্চিমাঞ্চলের এক কর্তা বললেন, “সাধারণত এ সব বৈঠক পনেরো থেকে পঁচিশ মিনিট চলে। আজ যে দু’ঘণ্টা ধরে এ সব চেল্লামেল্লি হল, সেটাই তো বিস্ময়।”

তাঁর তীব্র অপছন্দের দুই ‘এম’-কে হারিয়ে (মনোহর এবং মিডিয়া) মর্যাদার যুদ্ধ জিতলেন শ্রীনিবাসন। রোববার চেন্নাইয়ে অন্য দিনের তুলনায় গরম কম ছিল। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শ্রীনির হয়তো বাইরে বেরোলে মনে হত, এয়ারকন্ডিশন্ড ঘরে ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বসে আছেন! এতই স্বাচ্ছন্দ্যের তাঁর কাছে এই জয়। বিরোধীদের সম্মুখসমরে শুধু হারানইনি, মনোহর-ডালমিয়া-বিন্দ্রা সমেত প্রাক্তন বোর্ড সভাপতিদেরও বার্তা দিয়েছেন— এটা এখনও আমারই সাম্রাজ্য।

Advertisement

ক্লিক করুন

মনোহর আদৌ সভায় আসবেন কি না, তা নিয়ে ব্যাপক জল্পনা ছিল। আনন্দবাজারে যদিও লেখা হয়েছিল, তিনি আসছেন। রোববার সকালে তাঁকে নাগপুর থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিন দফার বিমানের ব্যবস্থা ছিল। একটা চার্টার্ড ফ্লাইট। একটা গো এয়ার-এর বিমান। তার কিছুক্ষণ পর একটা ইন্ডিগোর ফ্লাইট। অর্থাৎ চান্স ফ্যাক্টর যতটা পারা যায় নির্মূল করে রাখা। বিরোধী শিবির তখন আহ্লাদে আটখানা। দাবি করতে শুরু করেছে, এই তিনটে বিমান কিনে নিলেই একমাত্র শ্রীনি মুম্বই নামা বন্ধ করতে পারবেন মনোহরের! বিরোধী শিবিরের পরিষ্কার ধারণা ছিল মনোহর নামবেন এবং জিতবেন। বোর্ড অফিসে বসে প্রাক্-বৈঠক জগমোহন ডালমিয়ার সঙ্গে তাঁর একান্ত আলোচনা পরিস্থিতি আরও উত্তেজক করে দেয়। শশাঙ্ক সভা জুড়ে দাপটের সঙ্গে সওয়ালও করলেন। কিন্তু প্রত্যাশামতো সভাকে নিজের দিকে টানতে পারলেন না। বরঞ্চ আবিষ্কার করলেন, তিন বছর আগে যে ক্রিকেট বোর্ডকে তিনি রেখে গিয়েছিলেন সেটা আর এটা সম্পূর্ণ দুই পৃথিবী।

তিন দফা লক্ষ্য ছিল মনোহর-ডালমিয়াদের। তিনটের একটা হলই না। একটা আংশিক হল। আর একটা ঝুলে থাকল ভবিষ্যতের গর্ভে।

সভার তাপমাত্রা সবচেয়ে চরমে ওঠার কথা ছিল শ্রীনির আইসিসি যাত্রা নিয়ে। ঘটনাচক্রে যেটা উঠল রবি শাস্ত্রীর তদন্ত কমিটিতে ঢোকা নিয়ে। রবিবার রাতে আবু ধাবি থেকে শাস্ত্রী আনন্দবাজারকে বললেন, “আমি তো শুনলাম আমার নাম সর্বসম্মতিক্রমেই হয়েছে।” শুনে মনে হল সভার খবর যার কাছ থেকেই শুনে থাকুন, সে ঠিক বলেনি। কারণ রবি শাস্ত্রী নিয়ে ওয়াকআউট করার মতো পরিস্থিতি হয়। মনোহরের তীব্র আপত্তি শুনে বোর্ড সচিব সঞ্জয় পটেল প্রায় বেরিয়েই যাচ্ছিলেন। শশাঙ্কের বক্তব্য ছিল, শাস্ত্রীর নিরপেক্ষতা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। তিনি বোর্ডের পে-রোলে আছেন। তিনি কী ভাবে কমিটিতে থাকতে পারেন? মনোহরদের আসল আপত্তি অবশ্যই শাস্ত্রীর শ্রীনি-ঘনিষ্ঠতা। এই সময় সদস্যদের হাত তুলে বলতে বলা হয় তাদের অভিমত কী? বেশির ভাগই শাস্ত্রীর পক্ষে রায় দেন। শ্রীনি-ঘনিষ্ঠ বলে বোর্ডের সভায় তাঁর নাম নিয়ে বাগবিতন্ডাকে কী ভাবে নিচ্ছেন? জবাবে শাস্ত্রী বললেন, “আমার মনে হয় মনোহরদের কাছেও আমি গ্রহণযোগ্য। আর হ্যাঁ, ঘনিষ্ঠতার কথা বলছেন? তদন্ত কমিটিতেও আমি একটা পার্টির প্রতি ঘনিষ্ঠ থাকব। যার নাম ক্রিকেট।”

শাস্ত্রী ছাড়া তিন সদস্যের কমিটিতে নেওয়া হয়েছে প্রাক্তন সিবিআই কর্তা আর কে রাঘবন এবং অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জয়নারায়ণ পটেলকে। পটেলের নাম প্রস্তাব করেন মনোহররা। রাজিও করান শাসকগোষ্ঠীকে। অর্থাৎ কমিটিতে তাঁদের লোক একজন। বিরোধীদের দু’জন। মুম্বই বৈঠকের অলিখিত স্কোরকার্ডও যেন তাই।

শ্রীনি-২ : মনোহর-১।

রবিবার গভীর রাত অবধি ভারতীয় ক্রিকেটমহলে আলোচনা চলল শ্রীনি কী ভাবে লড়াই এতটা একপেশে করে দিলেন? উত্তর উঠে এসেছে দু’টো। এক, মনোহররা ওয়ার্কিং কমিটির মোট আঠারো ভোট নিয়ে হিসেব করেছিলেন। তাঁরা হিসেবে রাখেননি শ্রীনি যে আট-ন’জন বোর্ড সদস্যকে বাড়তি নিয়ে এসেছিলেন। ওয়ার্কিং কমিটিতে এই বাড়তি সদস্য নিয়ে আসার সংস্কৃতিটা শ্রীনির আমলেই চালু হয়েছে, যার লক্ষ্য যারা কমিটিতে নেই তাদেরও টিএ-ডিএ পাইয়ে দেওয়া। তা বলে ওয়ার্কিং কমিটির জরুরি সভায় বিশেষ আমন্ত্রিতদের তিনি নিয়ে আসবেন, কেউ ভাবেনি। মনোহরের যাবতীয় আক্রমণের বিরুদ্ধে এঁরা সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে দেওয়াল হয়ে গিয়েছিলেন। জগমোহন ডালমিয়া কমিটিতে প্রস্তাব করেছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের নাম। কিন্তু সেটাও খারিজ হয়ে যায়। মনোহরের মতো লড়াইয়ের এই গুরুত্বপূর্ণ রাউন্ডে ডালমিয়ারও হার হল। ক্রিকেটকে দুগ্ধস্নাত করার তাঁর পরিকল্পনা শাসকগোষ্ঠী মেনে নিয়েছে, এমন ছিটেফোঁটা নমুনাও নেই।

বিরোধীদের লক্ষ্য ছিল মুকুল মুদগলকে কমিটিতে ঢোকানো। সেটা সফল হওয়া দূরে থাক, শাসকগোষ্ঠীর কেউ কেউ বলতে থাকেন সুপ্রিম কোর্টে পেশ করা ভিডিও আর বন্ধ খাম নিয়ে আমাদের খুব জোরালো বক্তব্য রয়েছে। যথাসময় তা জানানো হবে। মুদগলের নাম সেখানেই কেটে যায়। এমনকী আইসিসি যাত্রা থেকে শ্রীনিকে বিরত করা হোক, এই প্রস্তাব তুলেও মনোহর সাড়া পাননি। সদস্যরা বলতে থাকেন, সুপ্রিম কোর্ট যখন ওঁকে আটকায়নি তখন আমরা বাধা দিতে যাব কেন?

শ্রীনির রণকৌশল আন্দাজ করতে না পারা ছাড়াও মনোহররা আরও একটা কারণে রবিবাসরীয় লড়াইয়ে হারলেন। আধুনিক বোর্ড সদস্যদের মানসিকতা বুঝতে না পারা। শ্রীনির সংসারে এরা এত পূজ্য এবং খাতির পেয়ে থাকেন যা কস্মিনকালে ভারতীয় ক্রিকেটমহল দেখেনি। মনোহর বোর্ড প্রধানের পদ ছেড়েছিলেন ভারতের বিশ্বকাপ জেতার বছরে। তিন বছর বাদে প্রত্যাবর্তনের নাটকীয় দুপুরে আবিষ্কার করলেন, বোর্ড সদস্যদের মানসিকতা আমূল বদলে গিয়েছে। তারা তাঁকে আগের মতোই শ্রদ্ধা করে। কিন্তু জীবনপাত করবে শ্রীনির জন্য।

কী করবেন এখন মনোহররা? নাকি রবিবাসরীয় মহাযুদ্ধ জিতে নিষ্কণ্টক হয়ে গেল শ্রীনির রাস্তা? ভগ্নহৃদয়ে বিরোধীরা কেউ কেউ ললিত মোদীর মতো একে ‘কোটি কোটি টাকার প্রহসন’ অ্যাখ্যা দিয়েছেন। কেউ কেউ আদিত্য বর্মার মতো গর্জে উঠে বলেছেন, “মঙ্গলবার আদালতে আবার দেখব।”

ঘটনা হল, শুধু তো বিরোধী নয়, শ্রীনি ভারতীয় ক্রিকেট-মিডিয়ার বিরুদ্ধেও সম্মানযুদ্ধে এগিয়ে থাকলেন। শনিবার গোটা দিন তিনি বোর্ড সদস্যদের বারবার বুঝিয়েছেন, মনোহরের কথা শুনলে শুধু ভারতীয় ক্রিকেটই ধ্বংস হয়ে যাবে না, মিডিয়ার কাছে মস্ত হার হবে। ওই ব্যাটাচ্ছেলেগুলোই আমাদের আসল বিরোধী!

ডাবল এম-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ জিতে উঠে এখন অ্যাডভান্টেজ শ্রীনিবাসন। যদি না মঙ্গলবারের সুপ্রিম কোর্ট অপ্রত্যাশিত ডিউস করে দেয়!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement