না, বিশ্বকাপ শুরুর মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টা আগেও এরিনা করিন্থিয়ানসের ভিতরটায় ঢোকা গেল না। ওয়র্ল্ড মিডিয়াকে ঢুকতে দেওয়াই হল না!
অথচ মিডিয়া সেন্টারে যেতে মাঠের পাশ দিয়ে গিয়েই একপ্রস্ত নীচে নামতে হয়। সেটা আপাতত টিনের ফেন্সিং দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। পাশ দিয়ে সাংবাদিকদের অন্য অস্থায়ী রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। যেখান দিয়ে হেঁটে গেলে মাঠের ভিতর কী চলছে দেখতে পাওয়া বা ছবি তোলার কোনও সুযোগ নেই।
চোখ বা ক্যামেরার শাটার না-হয় বন্ধ করা গেল। কিন্তু কান? সারাক্ষণ ঠুকঠাক, ধুপধাপ, শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা এ সব তো বোঝাই যাচ্ছে। বারবার মনে পড়ছে দিল্লির কমনওয়েলথ গেমস। শুরুর দু’দিন আগে গেমস ভিলেজে গিয়ে অবিকল এক অবস্থা দেখেছিলাম। তফাতের মধ্যে কলমডী কলঙ্কিত গেমসের সঙ্গে ভারতীয় জনগণের এমন উত্তেজিত আইডেন্টিফিকেশন ছিল না। তীব্র ঘৃণাই করুক বা রোমান্সে জড়িয়ে ধরুক, দেশের মাঠে বিশ্বকাপের সঙ্গে ব্রাজিলের নাড়ির টান।
স্টেডিয়ামের উত্তর দিকের কোনায় অনেক উঁচুতে কোনও বিক্ষোভকারী লিখে গিয়েছে, ফ... ওয়র্ল্ড কাপ। ইংরেজি চার বর্ণের সেই শব্দ, যা ব্যবহার করলে আজও অন্তত হাইস্কুল থেকে বিতাড়ন অবশ্যম্ভাবী। পরে জানলাম, সাও পাওলোর মোনোরেল প্রোজেক্টের এক কর্মীও এ দিন মারা গিয়েছেন। বিমানবন্দরের ঠিক কাছে ঘটনাটা ঘটে। যা নিয়ে ধর্মঘট থেকে শুরু করে গণ-উত্তেজনা সবই ঘটে গেল ফুটবল-মহাযজ্ঞ শুরুর ঠিক আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে। রটে যায়, রং করতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে। আসলে ব্রাজিলে বিশ্বকাপ নিয়ে প্রতিক্রিয়া এতটাই বিরূপ যে, যে কোনও নেগেটিভ খবরই এখন মুচমুচে পাবলিসিটি নিয়ে যাচ্ছে।
আবার এরিনা করিন্থিয়ান্সের খুব কাছে পরপর বাড়িগুলোতে সযত্নে ঝুলছে হলুদ জার্সি। কোনও কোনও বাড়ি হলুদ টুকরো কাপড় দিয়ে লম্বা করে সাজিয়েছে। ধনী-দরিদ্র সেখানে মিলেমিশে একাকার। একটু পরপর পেট্রোল পাম্প। সেখানে উপর থেকে বল ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার উপর আলো পড়ে মনে হচ্ছে, গোটা সাও পাওলো শহর বুঝি হাসছে। এই যেন পার্টি আর সাম্বা শুরু হবে!
পরক্ষণেই ছন্দপতনের মতো দ্রুত হাজির হয়ে যাচ্ছে দেওয়াল লিখন। সাও পাওলোর বৈশিষ্ট্যই হল, শহর জুড়ে গ্রাফিত্তি। সামনের দেওয়াল জুড়ে এই যে রোনাল্ডোর ছবি কালো করে দেওয়া, নিশ্চয়ই নিন্দাসূচক কিছু। ঠিক তাই স্থানীয় ভলান্টিয়ার লজ্জিত ভাবে বোঝালেন, “এটা রোনাল্ডোরই দোষ। ফুটবল মাঠেই ভাল। তার বাইরে মুখ্যু। সেটা তো নিজের বোঝা উচিত। নইলে কেউ বলে জাতির জন্য হাসপাতালের চেয়ে বেশি দরকার স্টেডিয়াম? তার পর থেকেই না ওর পিছনে সবাই এত লেগেছে!”
প্রেস পাস তুলতে গিয়ে মঙ্গলবার দাঁড়িয়েছিলাম দেড় ঘণ্টা। সভ্য ইভেন্টে লাগা উচিত পাঁচ থেকে সাত মিনিট। কিন্তু কিছু করার নেই। সবার এক অবস্থা। দেশ-বিদেশের তাবড় তাবড় সাংবাদিক লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে সেই এক ব্যাখ্যা শুনে গেলেন, “সরি, আজ মেট্রো স্ট্রাইকের জন্য আমাদের অর্ধেক ভলান্টিয়ার কাজে আসেনি।” আর যারা এসেছে, তাদের অর্ধেকই ইংরেজি জানে না। মূকাভিনয় ছাড়া এদের সঙ্গে কোনও রাস্তা নেই। খেতে যাবেন, দরজা খুলবেন, বেরোবেন, খাবার অর্ডার দেবেনসর্বত্র ভাষা সমস্যা। ‘প্লেন ওয়াটার’ বলাতে কাল রাত্তিরে বড় রেস্তোঁরায় কাপে করে গরম জল এনে দিল। না, না এটা নয়। রুম টেম্পারেচার ওয়াটার। কর্মীটি একগাল হেসে মাথা নাড়াল। ফিরে এল বিয়ারের বোতল নিয়ে।
মাসখানেক আগে কলকাতা থেকে ফুটবল মার্কেটিংয়ের সঙ্গে যুক্ত একটা ছোট দল সাও পাওলো এসেছিল। যেহেতু এখানে সর্বত্র পর্তুগিজে মেনু লেখা, তাঁরা ‘চিকেন’ বলে ছেড়ে দিয়েছিলেন। খেয়ে কেমন অন্য রকম লাগল। পরের দিন ঠিক করলেন, আর কোনও ঝুঁকি নয়। মুরগির ছবি এঁকে দেবেন, যাতে কোনও সংশয় না থাকে। ছবি দেখে ওয়েটার মাথা ঝাঁকিয়ে চিকেন নিয়ে এল। সন্দিগ্ধ হয়ে কলকাতাবাসীরা ওয়েটারকে ডেকে বললেন, “কাল যা খাইয়েছিলে, তার ছবি আঁকো তো ভাই।” ওয়েটারটি সাপের ছবি এঁকে দিল, যা দেখা মাত্র বাঙালিরা কেউ কেউ আতঙ্কে-ঘেন্নায় বমি করে ফেললেন।
প্রশ্ন হল, এমন কোনও আতঙ্কের হাওয়া উদ্বোধনী ম্যাচ ঘিরে আছে কি? এমনিতে বিশ্বকাপের ব্রাজুকা বল মাঠে পড়ছে ভারতীয় সময় রাত দেড়টায়, টেকনিক্যালি ১৩ জুন শুরু হয়ে যাচ্ছে। এখানকার সময় তখন বিকেল পাঁচটা। যে ম্যাচটা আবার জাপানের রেফারি ইউচি নিশিমুরা খেলাবেন। তার আগে থাকছে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। যেখানে ঠিক কী হবে মিডিয়ার কাছ থেকে এখনও আড়াল করে রাখা হয়েছে। ঠারেঠোরে শুধু বলা হচ্ছে, দুর্ধর্ষ রকমের চোখ ধাঁধানো কিছু হবে। ছ’শো নৃত্যশিল্পী নাকি রোজ অনুশীলন করছেন। আজ-কালের ভিতর তাঁদের ড্রেস রিহার্সাল।
কিন্তু ব্রাজিলীয় জনগণের এই মুহূর্তের যা মুড মিটার, চোখ ঝলসে দেওয়া উদ্বোধন অনুষ্ঠানেও রক্ষা পাওয়া যাবে না। ব্রাজিলকে জবরদস্ত জিততে হবে। সেই সত্তর সাল থেকে আজ পর্যন্ত বিশ্বকাপের তাদের প্রথম ম্যাচে দুইয়ের বেশি ব্যবধানে জেতেনি সেলেকাও-রা। ক্রোয়েশিয়া তাদের জন্য কী বাণী নিয়ে আসবে, কেউ জানে না।
হরেক রকম পূর্বাভাস চলছে ম্যাচ নিয়ে। কেউ বলছে ২-০। কেউ বলছে ব্রাজিল আরও বেশি। কেউ আবার বলছে ১-১ না হয়। জনপ্রিয় চাহিদা হল নেইমারের প্রথম গোল।
গত বছর কনফেডারেশনস কাপ উদ্বোধনীতেও প্রথম গোল করেছিলেন নেইমার। খেলার মাত্র তিন মিনিটে। জাপানকে স্তম্ভিত করে তাঁর পঁচিশ গজের অতর্কিত ভলি জালে জড়িয়ে যায়। নেইমারের গোল দিয়ে শুরু করতে চাওয়াটা আসলে একটা সংস্কার। ব্রাজিল যে সে বার অমন পরাক্রান্ত স্পেনকে ফাইনালে ৩-০ গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। নেইমার দ্য সিলভা-র প্রতিটি মুভমেন্ট তাই বিষ্যুদবার ম্যাচের প্রথম মিনিট থেকেই সবাই চোখে চোখে রাখবে।
ভাল ভাবে জিতলে নিশ্চয়ই বারুদের এই স্তূপের উপর দিয়ে ফুর্তির তুফান বইবে। কিন্তু খারাপ কিছু ঘটলে? বিদেশ বিভুঁইয়ে বাঙালির সাপ খেয়ে ফেলার আতঙ্ককেও না তখন ছেলেখেলা মনে হয়!
সাও পাওলোর মেয়র কে জানি না। বিশ্বকাপ সংক্রান্ত অনুষ্ঠানে সব সময় ব্রাজিলের ক্রীড়ামন্ত্রীকেই দেখা যায়। কিন্তু মেয়র যিনিই হোন না কেন, বিশ্বকাপ প্রোমোশনে দুর্দান্ত কাজ করেছেন। সাও পাওলো শহরটা এমনিতে ব্রাজিলের ফ্যাশন, আর্ট, কবিতা সব কিছুরই লীলাভূমি। আকাশ ছোঁয়া সব বাড়ি আছে। পাহাড় আছে। দু’টো নদী আছে। নিজস্ব কোনও বিচ নেই বা লস অ্যাঞ্জেলেসের মতো পামগাছও নেই। কিন্তু রাস্তায় রাস্তায় আর্টিস্টরা বসে ছবি আঁকছেন। বিশাল সব আর্ট গ্যালারি। পৃথিবীর তাবড় সব ব্র্যান্ডের দোকানে লোকে হেসেখেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখলে অবাক লাগবে, তা হলে ক্রাইম রেট এত বেশি কী করে হয় এখানে? সবই তো স্বাভাবিক লাগছে।
আধুনিক ব্রাজিলের বোধ হয় এটাই সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। তার অন্তরঙ্গ আর বহিরঙ্গের স্ববিরোধ।
নাকি এই বিশ্বকাপেরও?
কালকেই টিভিতে দেখছিলাম, স্কোলারি বলছেন, ব্রাজিল খেলা শুরু করবে ঘণ্টায় একশো মাইল গতিতে। কোনও কোচের মুখে কখনও একটা নির্দিষ্ট গতিতে প্রথম মিনিট থেকে খেলা শুরুর কথা শুনিনি। চোখের সামনে যেন দেখছিলাম, ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম পনেরো মিনিট হয়ে গিয়েছে। দেখে মনে পড়ে যাচ্ছে রবীন্দ্রসঙ্গীত নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল, বসন্তে সৌরভের শিখা জাগল... ব্রাজিলের ফুটবল মানেই তো কবিতা আর গান।
অথচ মঙ্গলবার সকালে ওঠা মাত্র হোটেলের রিসেপশনিস্ট বললেন, “তাড়াতাড়ি বেরোবেন না আজ। শুনছি আজও মেট্রো স্ট্রাইক আর জায়গায় জায়গায় অবরোধ।”
হায়, ব্রাজিলেও পৃথিবী এমন গদ্যময় হয়ে গেল যে তার এত বছরের পূর্ণিমার চাঁদকে ঝলসানো রুটি দেখছে!