রবিচন্দ্রন অশ্বিনের হয়তো মনে হতে পারে শনিবারের ম্যাচটা অনেকটা সীমান্ত যুদ্ধের মতো অবস্থা। কিন্তু ইডেনে হাজির পাকিস্তানের এক অতিথি সাংবাদিক হিসেবে আমার কাছে আর যা-ই হোক এটা ক্রিকেটই।
অনেক বিতর্ক, প্রচুর টালবাহানার পর একটা চিঠিই যেখানে পাকিস্তান দলের ওয়াঘার ও-পার থেকে এ-পারে আসাকে নিশ্চিত করে তোলে, তখন আমার চোখে আর যা-ই হোক এটা ক্রিকেটই। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই চিঠিতে পাকিস্তান দলের উপর যে ভালবাসা, আবেগ, অনুরাগ স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল, সেই একই অনুভূতি কলকাতায় গত ক’দিনের সফরে শাহিদ আফ্রিদিরা শুধু ইডেনই নয়, হোটেল, রাস্তাঘাট, শপিং মল কোথায় না পাচ্ছেন!
বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচ হেরে ভারত আজ পাকিস্তানের মুখোমুখি হচ্ছে। আর পাকিস্তান প্রথম ম্যাচে জিতে ভারতের চ্যালেঞ্জ নিতে নামছে, সে জন্যই আফ্রিদি-হাফিজদের কিছুটা হালকা দেখাচ্ছে তা কিন্তু ভাবার কোনও কারণ নেই। যদিও আমাদের কোচ ওয়াকার ইউনিস বলেছেন, শনিবারের ম্যাচে বেশি চাপ ভারতের উপর। কিন্তু এই ম্যাচটায় চাপ বেশি-কম বলে কোনও ব্যাপার থাকে না। দু’দলই চাপে থাকে। কিন্তু সেটা তো শনিবার সন্ধে সাড়ে সাতটায় ইডেনের দড়ি পেরিয়ে মাঠে ঢোকার পরের তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টা।
তার আগে অবধি, বিশেষ করে এ ক’দিন কলকাতার মেহমান পাকিস্তান দলের ক্রিকেটাররা সত্যিই শহরটার পরিবেশকে উপভোগ করছেন। স্বাভাবিক ভাবেই সিকিউরিটির কড়া বিধিনিষেধের পাল্লায় পড়ে মধ্য কলকাতার টিম হোটেল থেকে পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের যখনতখন বাইরে বেরিয়ে পড়াটা সম্ভব হচ্ছে না। তবে তার মধ্যেও তো মহম্মদ হাফিজ যথেষ্ট সাহস দেখিয়ে পার্ক স্ট্রিটে গিয়ে ওর বিবির জন্য শাড়ি কিনে নিয়ে এলেন বৃহস্পতিবার। শুনলাম ঝাড়া তিন ঘণ্টার শাড়ি শো! প্রায় একটা গোটা টি-টোয়েন্টি ম্যাচের টাইমের সমান।
ফর্মে থাকা পাকিস্তান ওপেনারের সঙ্গে এ দিন দেখা হতে বলছিলেন, কলকাতায় ওঁর মার্কেটিং অভিজ্ঞতাটা নাকি দারুণ হয়েছে। মিসেস হাফিজ শাড়ি ভীষণ ভালবাসেন। বিশেষ করে সেগুলো কলকাতার হলে নাকি কথাই নেই। আইপিএলে হাফিজ কলকাতা নাইট রাই়ডার্সে আগে খেলেছে। সে জন্য হয়তো ওঁর বউয়ের কলকাতার শাড়ি সম্পর্কে আরও জানা থাকতে পারে। হাফিজ বলছিলেন, পার্ক স্ট্রিটের দোকানদার তাঁকে সেরা ভ্যারাইটির শাড়ি দিয়েছেন। ওই ভদ্রলোকের কাছে হাফিজ তাই আরও বেশি কৃতজ্ঞ।
শাহজাদ আহমেদ, মহম্মদ ইরফান, মহম্মদ সামি আবার বলিউড সিনেমার পোকা। হোটেলে ওঁদের ঘরের টিভিতে এ দেশের হিন্দি মুভি চ্যানেলগুলো প্রায় সারা দিন ধরে চলছে। মানে ম্যাচ, প্র্যাকটিসের সময়টুকু বাদ দিয়ে আর কী। আর যখন সিনেমা দেখেন না? সেই সময়টা সামিরা পাকিস্তানে পরিবারের সঙ্গে স্কাইপ-হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলে কাটাচ্ছেন। তবে এ দিন ওই তিন ক্রিকেটারেরও প্ল্যান ছিল কেনাকাটা করার। হয়তো হাফিজের মার্কেটিং দেখে উৎসাহ পেয়েছেন। তবে এর ভেতর দিয়ে একটা ব্যাপার কিন্তু বেরিয়ে আসছে যে, ভারতের সঙ্গে মেগাম্যাচের চব্বিশ ঘণ্টা আগেও টিম পাকিস্তানের অলিন্দে কী রকম আত্মবিশ্বাস ছড়িয়ে রয়েছে। এমনও হতে পারে, ইডেনে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের চার বার খেলেও অপরাজিত থাকার রেকর্ডটাও আফ্রিদির দলকে সাহস জোগাচ্ছে।
এ দিনটা জুম্মাবার হওয়ায় পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা হোটেলে নিজেদের ঘরে দৈনন্দিন নমাজ পড়ার বদলে স্থানীয় এক মসজিদে গিয়ে দল বেঁধে প্রার্থনা করলেন। তার পর হোটেলে এক বার ঢুঁ মেরেই ইডেন ছুটেছিলেন প্র্যাকটিসে। ইডেনে তো রোজ দিনের মতো শুক্রবারও পাকিস্তানের ক্রিকেটঅনুরাগীদের ভিড়ভাট্টা লেগে ছিলই। কিন্তু অবাক লাগছে, প্রার্থনারত পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের এক সেকেন্ডের জন্য দেখার জন্য মসজিদের আশপাশেও কী বিপুল আকুতি সমর্থকদের। কিন্তু সেই এক মুহূর্তের জন্যও কি তাঁদের প্রিয় ক্রিকেটারদের দেখতে পেলেন ভক্তের দল? মসজিদে নিরাপত্তার বজ্রআঁটুনি এতটাই বেশি ছিল যে, সেটুকু সুযোগও প্রায় জোটেনি ক্রিকেটপ্রেমীদের।
অনেকে জানতে আগ্রহী, কলকাতায় এত পাক ক্রিকেটঅনুরাগী, পাক ক্রিকেটারদের এত বন্ধুবান্ধব, তাদের মধ্যে আফ্রিদি-সামিদের কি কোনও বিশেষ বন্ধুটন্ধু নেই? দেখুন এ ব্যাপারে আমি বিশেষ কিছু আলোকপাত করতে পারব না। বরং এটা জানাতে পারি যে, বিশ্বকাপে পাকিস্তান দল এতটাই ফোকাসড যে, ম্যাচের আগে কোরানের বিশেষ অংশ পড়ে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। শপথ নিচ্ছে ভাল করার। পাকিস্তান হাই কমিশনার বাসিত আলি জাতীয় ক্রিকেট দলের সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী হলে তাঁকেও টিম হোটেলে আসতে হচ্ছে। এ দিনই বিকেলের দিকে তিনি পাকিস্তানের টিম হোটেলে এসে দলের ম্যানেজারের কাছ থেকে কলকাতায় আফ্রিদিদের এ ক’দিন থাকার অভিজ্ঞতা, সিকিউরিটি বন্দোবস্ত নিয়ে খোঁজখবর নেন।
পাকিস্তান টিমের অন্দরমহলের খবর, তাদের হাই কমিশনারের কাছে কলকাতা নিয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ আফ্রিদি থেকে ওয়াকার। ইন্তিখাব থেকে আমের।
আফটার অল ইটস ক্রিকেট!