মধ্যরাতের উৎসব। ছবি: গৌতম ভট্টাচার্য
ওরা কেউ হামেস রদ্রিগেজ নামটা শুনেছে বলে মনে হয় না! ঘণ্টাখানেক আগের মারাকানায় বিশ্বকাপের সেরা গোলটাও নির্ঘাত টিভিতে দেখে বাড়ি থেকে বেরোয়নি!
নইলে বন্যার মতো বাঁধ ভেঙে যাওয়া আনন্দ, উচ্ছ্বাসের প্রগলভতা আর মস্তির এমন জৌলুস থাকে কী করে! বেলো স্টেডিয়াম থেকে আমাদের শহরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া মিডিয়া বাসটা আটকে পড়ল সেই আবেগের ট্র্যাফিক জ্যামে!
কোচ সুপারভাইজার গোছের যিনি, তিনি বিব্রত ভাবে বললেন, আজ এটুকু আটকাতে হবে। স্ট্রিট পার্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। সল্টলেক স্টেডিয়ামে ডার্বি ম্যাচ থাকলেও তো আবেগের মুহূর্মুহূ ট্র্যাফিক জ্যাম ঘটে থাকে। অহরহ গাড়ি আটকে যায়। কিন্তু এখন তো রাত সাড়ে ন’টা। চিলির শেষ পেনাল্টি বারে লাগার পর পাঁচ ঘণ্টারও বেশি হয়ে গিয়েছে। এখন পার্টি? তা-ও বেলো হরাইজন্তের মোটামুটি যেটা সানি পার্ক বা আলিপুর। সেই সাভাসিতে!
অবিশ্বাস্য সব দৃশ্য এর পর চোখের সামনে ঘটে যেতে দেখলাম। ট্র্যাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে, সিগন্যালে লাল জ্বলছে। পথচারীদের জন্য সবুজ নয়। সেখানে হলুদ জার্সির দুই তরুণ-তরুণী ঠিক মধ্যিখানে এসে চুমু খেতে শুরু করল। হলিউড ছবিতে যেমন হয়। দেখাদেখি চলে এল আরও কিছু যুগল। মুহূর্তে ব্রাজিলীয় জার্সি আর চুমুর চারণক্ষেত্র হয়ে গেল সাভাসির অভিজাত চারমাথার মোড়! পুলিশ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এই লায়লা-মজনুরা যেন পরিষ্কার বলছে, আমাদের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দাও। গ্রাহ্য করি না। ব্রাজিল জিতেছে, এ বার মরে যেতেও রাজি আছি।
বাধ্য হয়ে কোচ থেকে নেমে পড়তে হল। একটু এগিয়ে দেখি বিশাল পার্টির আয়োজন। একটা স্টেজের ওপর ব্যান্ড গাইছে আর তার তলায় হাজারখানেক মানুষ অবিরাম নাচছে, গাইছে, জাপটাচ্ছে, চুমু খাচ্ছে। যেন অস্থায়ী নজরুল মঞ্চে কোনও জনপ্রিয় রকব্যান্ডের কনসার্ট হচ্ছে আর দর্শক সেখানে গো অ্যাজ ইউ লাইক। বড় অনুষ্ঠান হলে যেমন ভ্রাম্যমান পাবলিক ইউরিনাল রাখা হয়, তেমন চার-পাঁচটাও রয়েছে। কাতারে কাতারে মানুষ আর ড্রেস কোড খুব ফর্ম্যাল।
হলুদ, একমাত্র হলুদ!
ফিফার কার্ডটা দেখিয়ে তবে সেই ফুটবল-আবেগের সমুদ্রে প্রবেশাধিকার পেলাম। একটু আগে মাঠ থেকে শুনে বেরিয়েছি, টাইব্রেকার নিষ্পত্তির পরেও অশান্তির কী ভয়ঙ্কর চোরাস্রোত চলছে ব্রাজিল-চিলিতে। ব্রাজিল প্রচণ্ড উত্তেজিত নেইমারকে ও ভাবে জখম করে দিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে অনিশ্চিত করে দেওয়ায়।
এর পর লকাররুমের দিকে দুটো টিম ফেরত যাওয়ার সময় চিলি কিছু টিটকিরি দিয়েছিল ব্রাজিলকে রেফারি তুলে। তাতে ব্রাজিলীয় মিডিয়া ম্যানেজার রডরিগো নাকি সটান ঘুষি মেরেছেন চিলির স্ট্রাইকার পিনিয়াকে। চিলি প্রেস অফিসার তা নিয়ে অভিযোগও জানিয়ে গিয়েছেন যে, ফিফার ভিডিওয় সব আছে। আমরা দেখে নেব ব্রাজিলকে। রডরিগো জবাবে বলেছেন, ধাক্কাধাক্কি হয়েছে। ঘুষোঘুষি নয়। এর পর বাসে ওঠার আগে যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে প্লেয়ারদের সঙ্গে একমাত্র কথা বলার সুযোগ, সেই মিক্সড জোনে এসে দাভিদ লুইজের মতো ঠান্ডা মাথার মানুষ বলে গিয়েছেন, “চিলি চাইছিল প্ররোচনা। ম্যাচ হেরেও সেই ফন্দি করে গেল “বা..র্ডরা।”
কিন্তু সাভাসির এই উৎসবখানা একই শহরে এমনই বৈপরীত্যের পৃথিবী যে, কারও হুঁশই নেই। কেউ চেঁচাচ্ছে নেইমার। কেউ বলছে থিয়াগো। এমনকী ফ্রেডের ন’নম্বর জার্সিরও ঢল সেখানে। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, মাঠ থেকে সরাসরি? বলল, “না, টিকিট ছিল না। কিন্তু টিম জিতেছে, এটাই আমাদের মাঠ।” কলম্বিয়া বলে এই গ্রহে কোনও দেশ আছে বলে এদের শনিবার রাতের চেতনায় নিশ্চয়ই ছিল না। হামেস রদ্রিগেজ নামক বিশ্ব ফুটবলের নবতম তারাকে যিনি সবচেয়ে ভাল মার্ক করতে পারতেন, সেই লুইস গুস্তাভো দুটো হলুদ কার্ড খেয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে নেই। তা নিয়ে স্কোলারির চুলটা যতই আরও অনুপম খেরের মতো হয়ে আসুক, এদের কোনও দুর্ভাবনা নেই। বরং যত রাত গড়াচ্ছে, এরা তত পোশাক নিয়ে অ্যাডভেঞ্চারে চলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, ব্রাজিলের বুঝি এটা রজনীশ আশ্রম।
ফোর্তালেজায় আগামী শুক্রবার ব্রাজিলীয় সমর্থকদের যে সরবিট্রেটের ব্রাজিলীয় সংস্করণ নিয়ে বসা উচিত, এটা বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই মনে হচ্ছে। ব্র্যাঙ্কো একমাত্র দেখছি যাঁর কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলকে ফেভারিট লাগছে। নইলে জিকো পরিষ্কার বলছেন, ওহে ব্রাজিল, হয় উন্নতি করো নইলে অঘটনের জন্য বুক বাঁধো। রিও ফার্দিনান্দ সোজাসাপ্টা লিখছেন, ‘ব্রাজিলের তিনটে ডিফেন্ডার অ্যাটাকে চলে যাচ্ছে। পেছনে বল এলেই গেল-গেল। ডিফেন্স তো পুরো লিক করছে।’ চিলির সেই বিখ্যাত অভিনেত্রী কাম মডেল ঝান্দেলিন নুনেজের সঙ্গে বেরোবার আগে প্রেস সেন্টারে দেখা হয়েছিল। সাঞ্চেজ গোল শোধ করার পর ঝান্দেলিন মাঠের মধ্যেই শার্ট খুলে তাঁর অন্তর্বাস দেখিয়েছিলেন, যার উপর চিলির জাতীয় পতাকার ছবি। আজ সেই ছবি বিলেতের কাগজেও বেরিয়েছে। তা ঝান্দেলিন বলে গেলেন, “গর্বিত আমার দেশের জন্য। আর এই ব্রাজিলের জন্য চিলির সমস্ত অভিশাপ তোলা থাকল। ভাগ্য ওদের রোজ দেখবে না।”
নাচগানের এই মেহফিল এ সব শুনতেই রাজি নয়। তারা বিভিন্ন রকম নেচেই চলেছে অবিরাম। কখনও সাম্বা, কখনও বলিউডি, কখনও শরীরে শরীর ঠেকিয়ে বল কাম চুমু ডান্স। এক মধ্যবয়সী পুরুষ সাময়িক জিরোচ্ছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, চিলির ১১৮ মিনিটের ওই শটটা ক্রসবারে লেগে না ফিরলে?
ইনি ইংরেজি জানেন না। ডেকে নিলেন পাশের সুন্দরী তরুণীকে। যাঁর সঙ্গে এতক্ষণ নাচছিলেন। মহিলা আমেরিকায় চাকরি করতেন বলে কাজ চালিয়ে দেওয়ার মতো ইংলিশ বলতে পারেন। ওই উৎসবের রামধনুই যেন ছিটিয়ে দিলেন তাঁর উত্তরে। “ক্রসবারে বল লাগার মুহূর্তটাই আমরা আরও সেলিব্রেট করছি। ওটাই আমাদের পথনির্দেশ যে, ঈশ্বর টুর্নামেন্টে ব্রাজিলের সঙ্গে আছেন। কাপটা আমরাই জিতব।” প্রেস কার্ড বুকে ঝুলছে। গায়ে হলুদ জার্সি নেই। বিজাতীয় কী ইন্টারভিউ নিচ্ছে দেখে এগিয়ে এল আরও কিছু কৌতুহলী মুখ। তাদের একজন বলল, “ফাইনাল আমরা আর আর্জেন্তিনা। আর ওই কথাটা শুনেছেন যেটা এখানে খুব চালু? পোপ একজন আর্জেন্তিনীয়। ঈশ্বর হলেন ব্রাজিলিয়ান।”
সাভাসির পার্টি চলল রাত্তির দুটো অবধি। হোটেলের চোদ্দো তলার ঘরে অবধি ঘুমনোর উপায় নেই। সকালে বেলো মাঠের মিডিয়া সেন্টারে ঢুকে যে নিশ্চুপ, একেবারে ফাঁকা পেলাম যে ভলান্টিয়াররা অবধি আসেনি, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। বেলোয় কাল ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছেয় প্রত্যেককে ভোররাত্তির অবধি জাগতে হয়েছে। রাত দুটোয় নাচগান বন্ধ হয়ে শুরু হল আতসবাজি। সকালে যে ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে মাঠে এলাম, সে ভারত ফুটবল খেলে না জানলেও তীব্রতম ফুটবল ভক্ত। নেইমার শুক্রবার খেলতে পারবেন কি না, তার কোনও দুশ্চিন্তা নেই। বরং বলল, “ফিলিপাও টিমকে সোমবার প্র্যাক্টিস শুরুতেই বলবেন, দেখেছ তো ঈশ্বর তোমাদের সাথে। আর ভয় কী?”
ব্রাজিল কাপ জেতার পার্টিই যেন করে নিল কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছে। এটাই এমন আরব্য উপন্যাসের রাতের মতো স্বচক্ষে ঘটতে দেখলাম যে জানি না আরও এগোলে এর চেয়ে বেশি কী হতে পারে! হলুদ সমুদ্র থেকে হলুদের মহাসাগর? ভাবতে পারছি না। এত কম ঘুমোলে মাথা কাজ করে বুঝি?