টুসি দাস ও ছন্দা গায়েন
উচ্চতার নিরিখে বিশ্বে তৃতীয় হলেও বিপদসঙ্কুলতায় সে হার মানায় এভারেস্টকেও। বাঙালির প্রিয় কাঞ্চনজঙ্ঘা। সেই শৃঙ্গেই রবিবার প্রথম পা রাখলেন দুই বাঙালি কন্যা। ছন্দা গায়েন ও টুসি দাস। তাঁরা কাঞ্চনজঙ্ঘা জয়ী প্রথম ভারতীয় কন্যাও বটে।
লেপচা ভাষায় ‘কাং’ মানে পর্বত, ‘চেন’ অর্থে বড়, ‘জো’ অর্থাৎ সম্পদ আর ‘গা’ মানে পাঁচ। সব মিলিয়ে পাঁচ ধরনের সম্পদের এক বৃহৎ ভাণ্ডার। কাঞ্চনজঙ্ঘার শৃঙ্গও পাঁচটি। তার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে স্থানীয়দের ধর্মবিশ্বাস। যে কারণে শৃঙ্গের ঠিক মাথায় পা রাখে না অভিযাত্রী দলগুলো। ‘সামিট’ চিহ্নিত হয় শৃঙ্গের কয়েক ফুট নীচে। মঙ্গলবার বেস ক্যাম্প থেকে সেই ‘সামিট’ ছোঁয়ার খবর স্যাটেলাইট ফোনে জানান ছন্দাদের সঙ্গী রাজীব ভট্টাচার্য। বলেন, “রবিবার সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ ছন্দা, টুসি, আমি আর দীপঙ্কর (ঘোষ) সামিট করেছি।” ছন্দার অভিযানের ব্যবস্থাকারী মিংমা শেরপা জানালেন, মূল পথে শৃঙ্গ জয় করে সামিট ক্যাম্পে ফেরার পরেই ফের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের ইয়াংলু কাং-এর পথ ধরেছেন ছন্দা। ওই পথে আরও এক বার কাঞ্চনজঙ্ঘা ছুঁয়ে আসা তাঁর লক্ষ্য।
গত বছর এভারেস্ট জয় করেছিলেন ছন্দা-টুসি। কিন্তু পর্বতারোহী মহলের মতে, কাঞ্চনজঙ্ঘা আরোহণের কৃতিত্ব অন্য যে কোনও শৃঙ্গ জয়ের চেয়ে, এমনকী এভারেস্টের চেয়েও অনেক গুণ বেশি।
কেন? আসলে, বিশ্বের কঠিনতম ও সব চেয়ে বিপজ্জনক শৃঙ্গগুলির মধ্যে কাঞ্চনজঙ্ঘার নাম প্রথমেই আসে। এভারেস্ট এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা-জয়ী বসন্ত সিংহরায়ের মতে, “এভারেস্টে অনেক কিছুই ‘রেডি মেড’। তাঁবু লাগানো থেকে শুরু করে খাওয়াদাওয়া, বেস ক্যাম্প পর্যন্ত মালপত্র পৌঁছনোর ব্যবস্থা এমনকী কঠিন অংশগুলো পার করার জন্য দড়ি লাগানো আগাম পরিকল্পনা করে সবটাই ছকে ফেলা থাকে।”
কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘার ক্ষেত্রে এই সব সুবিধের প্রায় কিছুই মেলে না। বসন্ত জানালেন, কাঞ্চনজঙ্ঘার বেস ক্যাম্প পর্যন্ত পৌঁছনোই বেশ কঠিন। দড়ি লাগিয়ে হিমবাহের উপর দিয়ে হাঁটতে হয় লম্বা পথ। তার ওপর সহজে মেলে না ‘পোর্টার’ বা মালবাহক। চূড়ান্ত আরোহণের দিন, অর্থাৎ সামিট ক্যাম্প থেকে শৃঙ্গ জয়ের দিন ১৫ থেকে ১৬ ঘণ্টা টানা চড়তে হয় বিপদসঙ্কুল পথে। মাঝে নেই বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা। আর সব চেয়ে বড় কথা, আবহাওয়া সম্পর্কে আগাম পাওয়া তথ্যের উপরে কোনও ভরসা করা যায় না। বসন্তরাই খারাপ আবহাওয়ার জন্য সামিট ক্যাম্পে চার দিন আটকে ছিলেন।
১৯৭৭ সালে সেনাবাহিনীর হয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা জয় করা প্রাক্তন মেজর প্রেম চন্দ্র বলছিলেন তাঁর অভিযানের কথা। জানালেন, ধকল সহ্য করতে না পেরে তাঁর দলের এক অভিযাত্রী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন। তাঁর দেহ শেষ ক্যাম্পে নামিয়ে এনে ফের শুরু হয়েছিল অভিযান। প্রেম-এর কথায়, “কাঞ্চনজঙ্ঘা শীর্ষে ভারতের পতাকা ওড়ানোর জন্য জান লড়িয়ে দিয়েছিলাম আমরা।”
দুই বাঙালিনীর শৃঙ্গজয়ের গল্পটাও আক্ষরিক অর্থে জান লড়ানোর।
দমদম পার্কের হরিজন নগরের বস্তিতে টুসিদের ছোট্ট এক কামরার টালির বাড়িতে বসে ছিলেন মা সবিতাদেবী। খাটে ছড়ানো মেয়ের ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, “মেয়ে আগে বাড়ি ফিরুক, তার পর নিশ্চিন্ত হতে পারব। যা খেতে চাইবে রান্না করে দেব।” পরিবারের খরচ চালানোর সম্বল বলতে দমদম পার্কে ডিমের দোকান। বাবা মারা যান টুসি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়। সকালে রাজারহাটের ডিরোজিও কলেজে যাওয়ার আগে নিয়মিত দোকানে বসত টুসি। চোখে কিন্তু লেগে থাকত পাহাড় জয়ের স্বপ্ন।
টুসির দিদি সুপর্ণা বললেন, “আমরা তো বোনকে সে ভাবে পুষ্টিকর খাবারও দিতে পারিনি। ডিম খেতে ভালবাসে বলে দোকান থেকে বিক্রি না হওয়া একটু ভাঙা ডিমগুলো নিয়ে আসত।” দিদি বলেই ফেললেন, টুসি পাহাড়ে চড়ুন বাড়ির কেউ চাননি। কিন্তু তাঁর জেদের কাছে হার মেনেছেন সবাই। যে ভাবে গত বার হার মেনেছে এভারেস্ট, এ বছর কাঞ্চনজঙ্ঘা।
খুশির জোয়ার দমদম পার্ক থেকে হাওড়ার কোনা বাগপাড়ায়। যেখানে বাস সাহসিনি ছন্দার। মা জয়াদেবী জানালেন, মেয়ের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল মাসখানেক আগে। বেস ক্যাম্প থেকে ছন্দা জানিয়েছিলেন, এর পরে পথ আরও কঠিন। বাড়ির সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখা যাবে না। যোগাযোগ ছিলও না। আশায় বুক বেঁধে মেয়ের ফোনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন জয়াদেবী। অবশেষে মঙ্গলবার সকালে পেলেন সুখবর।
জয়াদেবী জানান, সরকারি তরফে কোনও টাকাপয়সা পাওয়ার উপায় না দেখে ছন্দা নিজেই বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। কয়েক জনকে পেয়েও যান। জয়াদেবীর কথায়, “প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকা খরচ হবে শুনে বারণ করেছিলাম। মেয়ে শোনেনি। ১৮ লক্ষ টাকা ধার করে ও কাঞ্চনজঙ্ঘা গিয়েছিল। সফল হয়েছে, এটাই আনন্দের।”