বদলে দিলাম ইতিহাস

এলেন, দেখলেন, এমসিজি উদ্বেল করে বিদায় নিলেন

ইদানীং ওয়ান ডে-তে ভারতের প্রথম উইকেট পড়লে এমন চিল-চিৎকার হয় যে বোঝাই যায় না, চেঁচাচ্ছে কি বিপক্ষ সমর্থক? নাকি প্যাভিলিয়নের ছায়া থেকে বিরাট কোহলির বহু প্রতীক্ষিত কায়া এ বার দেখতে পাওয়ার আশায় ভারতীয় ফ্যান? রবিবাসরীয় এমসিজি নীল জার্সির এমন অভূতপূর্ব মহাবৃত্তে সজ্জিত যে চিৎকারটা ব্যাখ্যায় সমস্যার কারণ নেই। ওটা বিরাট কোহলির জন্য! সে যত কম রানেই ভারতের প্রথম উইকেট খসুক না কেন!

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

মেলবোর্ন শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:৩৫
Share:

একটু কি নস্ট্যালজিক? এমসিজিতে সচিন। ছবি: গৌতম ভট্টাচার্য।

ইদানীং ওয়ান ডে-তে ভারতের প্রথম উইকেট পড়লে এমন চিল-চিৎকার হয় যে বোঝাই যায় না, চেঁচাচ্ছে কি বিপক্ষ সমর্থক? নাকি প্যাভিলিয়নের ছায়া থেকে বিরাট কোহলির বহু প্রতীক্ষিত কায়া এ বার দেখতে পাওয়ার আশায় ভারতীয় ফ্যান?

Advertisement

রবিবাসরীয় এমসিজি নীল জার্সির এমন অভূতপূর্ব মহাবৃত্তে সজ্জিত যে চিৎকারটা ব্যাখ্যায় সমস্যার কারণ নেই। ওটা বিরাট কোহলির জন্য! সে যত কম রানেই ভারতের প্রথম উইকেট খসুক না কেন!

আবার কোহলি যখন ব্যাট করে ইনিংসকে ক্রমশ গুছিয়ে আনছেন, হঠাৎ গোটা এমসিজি ভাসিয়ে সেই আদিম আওয়াজটা উঠল। ক্রিকেটের করোটি গুহার সেই আওয়াজ— স্যা-চি-ন, স্যা-চি-ন। কে বলবে মাঝে সাড়ে পনেরো মাস চলে গিয়েছে! কে বলবে তিনি সচিন তেন্ডুলকর অবসর নেওয়ার পর এই প্রথম মাঠে বসে তাঁর দলের খেলা দেখতে এসেছেন।

Advertisement

বিদেশি গ্যালারির অভ্যর্থনা দেখে তো মনে হচ্ছে পনেরো মিনিট পরেই তারা যেন ব্যাট হাতে বাইশ গজে দেখবে! গ্যালারির নীচে একটু আগেও বিশাল সাইজের একটা ব্যানার দোলানো ফক্স স্পোর্টস থ্রি-তে দেখাচ্ছিল—

কিছুই বদলায়নি

ক্রিকেট এখনও আমাদের ধর্ম

সচিন এখনও ঈশ্বর

এই সচিন খেলা ছেড়ে দেওয়া সচিন! কৌতূহলের সঙ্গে যিনি দেখতে চান, ব্যানারটা কোথায় দোলাচ্ছিল? কিন্তু দেখবেন কী করে! তাঁর ওপর তো ততক্ষণে হুড়মুড়িয়ে অস্ট্রেলীয় মিডিয়া। গায়ে আমেরিকা থেকে কেনা মেরুন শার্ট, হাতে কালো ব্যান্ডের কয়েক লক্ষ টাকার অডমার্স পিগে ঘড়ি। ফরসা ঝকঝকে চেহারা, ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল। এই সচিন যত না ক্রিকেটার— তার চেয়ে অনেক বেশি প্রাক্তন মহাতারকা।

কিন্তু তাঁর জন্য আবেগ এমনই যে প্রাক্তনকেও দিব্যি বর্তমানে রেখে দিয়েছে। এমসিজি ওই রকম ধবন-কোহলি মজবুত পার্টনারশিপের সময়ও অনবরত সচিন-সচিন চেঁচাতে থাকল। কাচের বক্স থেকে বেরিয়ে এসে বারবার হাত নেড়ে তার প্রত্যুত্তর দিচ্ছিলেন সচিন!

অ্যাডিলেডের পাকিস্তান ম্যাচটা আগাগোড়া বাড়িতে বসে টিভিতে দেখেছেন। ম্যাচ শেষে পশ্চিম বান্দ্রায় তাঁর জগার্স কোর্টের বাড়ির বাইরে হাজারখানেক লোকের জমায়েতও হয়ে গেছিল। অ্যাডিলেডে যারা পাকিস্তানের দর্পচূর্ণ করেছিল এবং আজ এমসিজিতে এত বড় ব্যবধানে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারাল— দুটোই এক প্রজন্ম।

সচিন পরবর্তী। কিন্তু সমর্থকেরা তাঁকে প্রাক্তন প্রজন্ম হতেই দেবে না।

সচিন নিজে যদিও খেলা দেখতে দেখতে বারবার নস্ট্যালজিয়াক্রান্ত হচ্ছিলেন। আমরা গুনছিলাম অবসরের সাড়ে পনেরো মাস বাদে আবার টিম ইন্ডিয়াকে দেখতে তিনি। অথচ তিনি নিজে সাড়ে পনেরোর হিসেবটা দুমড়ে-মুচড়ে ঘোষণা করে দিলেন, ওটা হবে সাড়ে সাতাশ বছর!

সাতাশির বিশ্বকাপে বল বয় হয়েছিলেন। তখন বয়স মাত্র তেরো। তার পর আবার দু’হাজার পনেরোয় আজ খেলা দেখতে বসা। “কোনও চাপ নেই। টেনশন নেই। প্রমাণ করার নেই। প্ল্যানিং নেই। কেমন যেন লাগছে,” বললেন এবিপি-কে। অবশ্য এসআরটি বলে কথা। দ্রুতই তিনি অনিবার্য ভাবে স্টান্স নিয়ে নেবেন মাঠের মতো। আর সব কিছুর খুঁটিনাটি বিশ্লেষণে ঢুকে পড়বেন!

মর্কেলের হাত দেখে এর পর বলতে শুরু করে দিলেন কোন বলটা কী হবে? দুশো গজ দূর থেকে বোলারের গ্রিপ দেখে বলে দিচ্ছেন, এটা একশো চল্লিশের বেশি আসবে না। এটায় গতি কমে গেল— একশো পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি। কোনটা সিম আপ। কোনটা সিম ভেতরে। কমেন্ট্রির মতো বলে যাচ্ছেন।

বড় ব্যাটসম্যান মাত্রেই বোলারের হাত দেখে। কিন্তু ফাস্ট উইকেটে অনেক বড় ব্যাটসম্যানও পেসারের হাত সব সময় দেখে না। সময় পাবে না আশঙ্কায় অফ দ্য উইকেট খেলে।

আপনি কি তা হলে অস্ট্রেলিয়াতেও হাত দেখতেন? “প্রতিটা বল দেখেছি,” চমৎকৃত করে জবাব দেন সচিন। আর খেলা দেখতে দেখতে মন্তব্য করতে থাকেন, “বিরাটের প্যাশনটা এত বেশি না, ওই প্যাশনটাই অনেক কিছু সামলে দেয়।”

মেলবোর্নে এত বছর খেলেছেন অথচ প্রেস বক্স কোথায় জানতেন না। টেলিভিশন বক্সে তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এ বার ডাক এল। আইসিসির জন্য ইন্টারভিউ দিতে হবে। আবার গুগল হ্যাংআউটে ফ্যানদেরও প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। নীচ থেকে গোটা মিডিয়াকুল ততক্ষণে উঠে এসে সচিনের বক্সের বাইরে উঁকিঝুঁকি মারছে। কিন্তু আজকের সচিন ইন্টারভিউ দেওয়ার মেজাজে নেই। আজ নিছক ভারতীয় ক্রিকেট অনুরাগী। চুটিয়ে আনন্দ করতে চান তাঁদের মতোই।

তাঁকে দেখে মনে হল যেন এত বছর সিস্টেমের মধ্যে থেকেও হুঁশ ছিল না চার পাশে তাকিয়ে দেখার। তাই কোথাও গিয়ে যেন অপুর প্রথম রেলগাড়ি দেখার সঙ্গে বড় হয়ে তাঁর প্রথম মাঠে বসে আজ ক্রিকেট দেখার কোনও তফাত নেই! এমসিজিতে আজ তাঁর অচেনা আনন্দ উপভোগ করার দিন।

শুনলাম আরও কয়েক দিন অস্ট্রেলিয়ায় কাটাবেন। পারথে ভারতের পরের ম্যাচে থাকছেন না। তবে নিজস্ব স্পনসরের কিছু কাজ রয়েছে। সিডনিতে আছে নিজের বই সই করার অনুষ্ঠান।

এই বই-ই তো তাঁকে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট সমাজের একটা অংশের কাছে চূড়ান্ত অপ্রিয় করেছে। মাঙ্কিগেটে হরভজনের হয়ে সাক্ষ্য দান। আর বইয়ে চ্যাপেল ভাই-সহ পন্টিংদের আক্রমণ। আজ কি সচিন অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটমহলের শৈত্য টের পাবেন?

তাঁকে যখন টিভি বক্সের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, ভাবছিলাম নতুন কোনও ঘটনা অপেক্ষায় নেই তো? যা এমসিজি জনতার ভালবাসার জোয়ারের সমান্তরাল দাঁড়িয়ে যাবে?

তবে তার লেখচিত্র দেখা গেল কোথায়? বরং উল্টোটাই। টিভি বক্সে ঢোকার মুখে এমন জটলা যে, নিরাপত্তারক্ষী নিয়ে ঢুকে মিডিয়ার সামনে দরজা বন্ধ করে দিতে হল। ইয়ান চ্যাপেলের আজ কমেন্ট্রি থাকলে মুখোমুখি দেখাও হয়ে যেত। কিন্তু বাকিরা তো ছিলেন। শেন ওয়ার্ন ছিলেন। ছিলেন মাইক হাসি। চ্যাপেল ভাইরা থাকলেও পরিস্থিতি কিছু বদলাত বলে মনে হয় না।

সচিন অবসর নেওয়ার দেড় বছর বাদেও এ দেশে তাঁকে নিয়ে এমন হিস্টিরিয়া যে, বিপক্ষে কিছু দাঁড়ানোই বোধহয় সম্ভব নয়। নর্ম্যান কোচানেক এত বছর সাংবাদিকতা করছেন অজি মিডিয়ায়। রোববার সচিনের বসা আইসিসির অন্যতম স্পনসর ‘এএনজেড’ বক্স থেকে বেরিয়ে আসার পর লজ্জিত ভাবে বললেন, “কিছু মনে করবেন না। একটু এক্সাইটেড হয়ে গেছিলাম। সচিনকে দেখলে বাচ্চা হয়ে যাই। একমাত্র স্যর ডনের জন্য এ রকম করতাম।” এর পর নর্ম্যান বললেন, “মোবাইলটা একটু চেক করুন না। আমার সঙ্গে ছবিটা ঠিকঠাক পেয়েছেন তো?”

সচিন অবশ্য তাঁর বক্সে ভক্তকুলের নিয়মিত আমদানি সত্ত্বেও মন দিয়ে ম্যাচটাই দেখে গেলেন। বেরিয়ে গেলেন ভারত জেতার আধ ঘণ্টা আগে। দুপুর থেকে বলে যাচ্ছিলেন, “২৮০ লাগবে। ২৮০ হলে সেফ।” গত দু’মাস অস্ট্রেলিয়ায় যখন টিম খারাপ খেলছিল তখনও বলছিলেন, “ধবনকে বাদ দেওয়াটা ঠিক হবে না। ও যে কোনও দিন খেলে দেবে।”

পূর্বাভাস মিলে যাওয়ায় প্রচণ্ড খুশি। ধবনের সেঞ্চুরির পর এমন লাফিয়ে উঠলেন যেন নিজেরই ১০১তম হল। কিন্তু ধবনের চেয়েও তিনি যেন বেশি উচ্ছ্বসিত অজিঙ্ক রাহানের ইনিংস নিয়ে! “রাহানে— আমার কথা খেয়াল রাখবেন, ও-ই বিশ্বকাপে ইন্ডিয়ার এক্স ফ্যাক্টর হতে যাচ্ছে।”

গত বার আপনার সেঞ্চুরির পরেও দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ হারতে হয়েছিল মনে পড়ে?

“হ্যাঁ ওই যন্ত্রণার রাত কী করে ভুলি? নাগপুরের সেই রাত,” বললেন সচিন। ডে’ভিলিয়ার্সের টিমের আট উইকেট পড়ার সময় মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন এটা জেনে যে, ক্রিকেটার জীবনে পাওয়া সেই যন্ত্রণার রাতকে আজ বিদেশের মাঠে সমর্থক জীবনে পাল্টা দিতে পারলেন!

বিকেলের দিকে গ্যালারির উত্তাপ ক্রমশ বাড়ছে। সারা মাঠে বৃত্তাকার দুলছে জাতীয় পতাকা। ঢাক বাজছে। মানুষ নাচছে-গাইছে। ততই কি একটু অন্যমনস্ক দেখছিলাম সচিনকে?

কোথাও পারফর্মার সত্ত্বাটা কি ফিরে আসতে চাইছিল যে, এ সবেই তো আমার চিরকালীন অধিকার! তা হলে আজ আমি দর্শকের আসনে কেন? কেন এই যন্ত্রণা আমি নেব?

ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার বিদায়ী টেস্টেও যা ব্যাটিং দেখেছি এ বারের বিশ্বকাপটা অনায়াসে টেনে দিতে পারতেন।

“ব্যাটিংটা ইজি পারতাম। এখনও কোনও সমস্যা হত না। শরীর আর দিচ্ছিল না। তাই ছাড়তে বাধ্য হলাম,” বলে হাঁটুর দিকে তাকালেন সচিন।

তা হলে কি হাত নয়, হাঁটুই তাঁর অন্তিম সমস্যা করছিল? কে জানে? যেটা আসল জানতে চাইছিলাম তার উত্তর তো পাওয়া হয়ে গিয়েছে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement