কুর্তোয়ার সামনে মেসি এই নিয়ে টানা ৮ ম্যাচে আটকে গেলেন। ছবি: এএফপি
খেলা শুরুর এক ঘণ্টা আগে যখন এস্তাদিও ন্যাশিওনাল মানে গ্যারিঞ্চায় ঢুকছি, মিডিয়া সেন্টারের মুখে ছোট একটা জটলা। শোকগ্রস্ত সেই জটলার বিষয়বস্তু হল, আজই কি?
চিনের সাংবাদিক যাঁর সঙ্গে মিডিয়া শাটলে এলাম, তিনি ওই জটলায় ঢুকে পড়লেন আর দ্রুতই জানিয়ে দিলেন, আজই ঘটলে তিনি দেশে ফেরার টিকিটটা আগিয়ে নেবেন। তা হলে আর বিশ্বকাপের কিছুই পড়ে থাকল না!
নেইমারের নাটকীয় ভাবে বিশ্বকাপের বাইরে চলে যাওয়া ব্রাসিলিয়া-সহ ব্রাজিলের সর্বত্র একটা স্থবির ভাব নিয়ে এসেছে। বেলজিয়াম শুধু চমৎকার গোছানো দল বলেই নয়। মানে গ্যারিঞ্চা মাঠই তো ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে বিশ্বকাপ অভিযান শেষ করতে দেখেছে। তাই অসীম দুর্ভাবনার মধ্যে তারা ছিল। প্রথমে রোনাল্ডো। গতকাল নেইমার। আজকে কি তা হলে মেসি?
যাবতীয় দুর্ভাবনায় নতুন জ্বালানি না দিয়ে লিওনেল মেসি অক্ষত থেকে গেলেন বিশ্বকাপে। আর আগামী বুধবার ব্রাজিলের বৃহত্তম শহরে সেমিফাইনাল খেলবেন বিশ্বকাপে তাঁর বৃহত্তম অভিযানে! এই প্রথম তিনি শেষ চারে। আগের বার কেপটাউনের এক অশুভ বিকেল যা দিতে পারেনি, ব্রাসিলিয়ার চড়চড়ে রোদ্দুর তাই দিয়ে গেল। বুয়েনস আইরেসের রাস্তায় দলে দলে লোক বেরিয়ে যে নাচছে-গাইছে, সেটা সহাস্য সাবেয়াকে সাংবাদিক সম্মেলনে ঢোকামাত্র জানিয়ে দিলেন আর্জেন্তিনীয় সাংবাদিকেরা। চব্বিশ বছর পর আর্জেন্তিনা আবার বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে।
কিন্তু মেসি তাঁর যে ব্যক্তিগত কোয়ার্টার ফাইনাল, সেখানে এই প্রথম স্বমহিমায় ছিলেন না। তিনটে লোক ঘাড়ের ওপর তো তাঁর সব ম্যাচেই থাকে। তাকে ঘাড়ে রেখেই তিনি নিজের ফুটবল আর্ট এগজিবিশন বানান। এ দিনও সেন্টার সার্কলের কাছে একটা বল নিজের গোলের দিকে মুখ থাকার সময় শূন্যে যে ভাবে বুকে রিসিভ করলেন, অবিশ্বাস্য! মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল টেন্টে কোচিং ম্যানুয়্যাল হিসেবে মুহূর্তটার ছবি টাঙিয়ে রাখা উচিত! ফরোয়ার্ডদের কিছু ডিফেন্স চেরা বলও বাড়ালেন আর্জেন্তিনীয় অধিনায়ক। তাঁকে নিয়ে বেলজিয়াম সব সময় সশব্যস্ত থাকায় উইংয়ে ফাঁকা জায়গা তৈরি হল একাধিক বার।
কিন্তু যে শিল্পের জন্য মেসি, মেসি সেটা ছিল না। দারুণ জায়গা থেকে ফ্রি-কিক বাইরে মারলেন। একা গোলকিপার কুর্তোয়াকে পেয়ে তাঁর গায়ে মারলেন। এত দিন টিমকে তিনি টেনেছেন। এ দিন গঞ্জালো ইগুয়াইন, মাসচেরানোরা যেন তাঁকে দেখলেন। সেমিফাইনালে এ বার টিম আর্জেন্তিনা উঠল। তার মহানায়ক একা নন!
২৪ বছরের অপেক্ষা শেষ। ’৯০ বিশ্বকাপের পরে ফের সেমিফাইনালে আর্জেন্তিনা। ছবি: রয়টার্স
বেলজিয়াম এ বারের বিশ্বকাপে এত প্রসিদ্ধি কুড়িয়ে বড় নকআউট ম্যাচে যেন চোক করে গেল। জার্মানির যা আছে, ঠিক সেটাই যেন তাদের নেই। অথচ খেলা শুরুর আগে সাইডলাইনের ধারে তেইশ জন বেলজিয়ান ফুটবলারকে হাডল করতে দেখা গেল। হাডল সাধারণত করে থাকে যে এগারো জন মাঠে খেলে, তারা। এই দৃশ্যকল্প মনে হয় তৈরি করা হল আর্জেন্তিনীয়দের ভড়কাতে যে, আজ আমরা এক জাত, এক দেশ, এক টিম। ন’মিনিটের মধ্যে ইগুয়াইনের গোল হয়ে যাওয়ার পরেও গোটা মাঝমাঠ বলতে গেলে বেলজিয়ানদেরই দখলে ছিল। নিজেদের মধ্যে পাস খেলল অনেক বেশি। খেলা ছড়াল দু’দিকে। কিন্তু পেনিট্রেটিভ জোনে শেষ টোকা বা শেষ হেড বা শেষ পাসটা আর করতে পারল না। আক্রমণও তুলল মন্থর ভাবে। যেন নেইমারের ঘটনায় শোকার্ত হয়ে আজ স্পিড কমিয়ে দিয়েছে। লুকাকুকে নিয়ে এত জল্পনা। এত রোমাঞ্চ। তা তিনি গোলে শট করা দূরে থাক, এত খারাপ খেললেন যে কোচ তুলে নিতে বাধ্য হলেন।
অবাক লাগছে দুটো রিজার্ভকে নামানো হল। মারুয়ান ফেলাইনিকে কেন তোলা হল না। সিংহের কেশরের মতো চুল বল নিয়ে এত কারুকার্য করলেন। কিন্তু ফল মোটেও সিংহসদৃশ নয়। আর্জেন্তিনা ম্যাচের কয়েক ঘণ্টা পরেই কোয়ার্টার ফাইনাল খেলতে নামছে নেদারল্যান্ডস। এই ম্যাচটা তাই ম্যান ইউ-এর ডাচ কোচ ফান গল টিভিতে দেখলেন কি না, বলা মুশকিল। যদি দেখে থাকেন, সবচেয়ে খুশি হবেন। সাধে কী তিনি ক্লাবকে বলেছেন ফেলাইনিকে আমার চাই না। ওকে বিক্রি করে দেওয়া হোক।
মেসি অবশ্য ম্যাচ জিতেও বিষণ্ণতার চাদরটা সরাতে পারলেন না। এটাও একটা প্রশ্ন ছিল খেলার আগে যে, খারাপ হয়ে যাওয়া সার্বজনীন মন আর্জেন্টাইন জিনিয়াসের জন্য ভাল হবে কি না?
অবশ্য কে-ই বলতে পারে, নেইমার বিদায়ে ছোট বন্ধুর জন্য লিওনেল মেসি তিনি নিজেই ঘোর বিষণ্ণ ছিলেন না। অন্যের বিষণ্ণতা দূর করবেন কী!
• একই বিশ্বকাপে এই প্রথম ব্রাজিল আর আর্জেন্তিনা উঠল সেমিফাইনালে ।
• ’৯০ বিশ্বকাপের পর এক ম্যাচে সবচেয়ে কম গোলে শট। মাত্র ৩।
• কুর্তোয়া দেশের জার্সিতে প্রথম ম্যাচ হারলেন। ম্যাচ ২২, জয় ১৫, ড্র ৬, হার ১, ক্লিন শিট ১২।
লিও মেসি
সঠিক পাস: ৮২% (১৯/২২)
গোলের সুযোগ তৈরি ১
গঞ্জালো ইগুয়াইন
অগস্ট ২০১৩-র পর দেশের জার্সিতে প্রথম গোল। শট ৩, গোলে শট ১, গোল ১
কোচের নতুন রক্ষণই ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট
কোয়ার্টার ফাইনালেই সবচেয়ে ছন্দময় দেখাল
আর্জেন্তিনাকে। কেন? জানাচ্ছেন সুব্রত পাল।
১) দেমিসেলিসকে স্টপার খেলানোয় সাবেয়ার দলের ডিফেন্সে প্রতিদ্বন্দ্বী বেলজিয়ামের বড় চেহারার অ্যাটাকারদের সামলানো সহজ হয়েছে।
২) লেফট ব্যাকে কার্ড সমস্যায় থাকা রোজার জায়গায় বাসান্তাও খুব ভাল খেলেছে। বেলজিয়ানদের গড় উচ্চতা ১৮৬ সেন্টিমিটারের সঙ্গে টক্কর নিতে পেরেছে মেসিদের ডিফেন্স।
৩) শুরুর দিকেই গোল পেয়ে যাওয়ায় গোটা দল বাড়তি আত্মবিশ্বাস পেয়ে গিয়েছিল। যে জন্য এই ম্যাচেই আর্জেন্তিনার খেলায় সবচেয়ে বেশি ছন্দ দেখা গিয়েছে। মেসি শেষ দিকে একটা গোল প্রায় করেই ফেলেছিল।
৪) মেসি শেষ দু’ম্যাচে গোল না পেলেও ওর দলের দু’জন অপরিহার্য প্লেয়ার গোল পেয়েছে এই দু’ম্যাচে। সেই দি’মারিয়া আর ইগুয়াইনকে সে জন্য টুর্নামেন্টের গোড়ার দিকের চেয়ে এখন অনেক বিপজ্জনক দেখাচ্ছে।
৫) দ্বিতীয়ার্ধে দেমিসেলিস, বাসান্তারা আরও জমাট বেঁধে লুকাকু, ফেলাইনিদের মতো ছ’ফুটের বেশি ফরোয়ার্ডদের আটকেছে। শেষ চারে যা সাবেয়াকে সাহস জোগাবে।