আটলেটিকো কলকাতার কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাস চূড়ান্ত পেশাদার মানসিকতার। হার-জিত, আবেগ, উচ্ছ্বাস, দুঃখ— কিছুই স্পর্শ করে না।
দু’টো আইএসএলে এই স্প্যানিশ কোচকে দেখার পর এটাই আমার প্রথম উপলব্ধি।
মার্কি ফুটবলারকে কার্যত গোটা টুর্নামেন্টে না পেলেও কী! বরং তারকা প্রথায় গা না ভাসিয়ে পুরো টিমকে তাতিয়ে কঠিন যুদ্ধে নামানোর ওযুধ হাবাস জানেন। লিগের মোক্ষম সময় টানা চার ম্যাচ অপরাজিত (যার তিনটেতে জয়) থাকার পর তাঁকে নিয়ে শহরের ফুটবলমহলে এখন যে রকম প্রশংসার বন্যা বইছে তার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
দু’মরসুমই দেখে আসছি তিনি তারকার চেয়েও দলকে বেশি গুরুত্ব দেন। সে জন্য গত বার গার্সিয়া কিংবা এ বার পস্টিগা এটিকেতে আলাদা গুরুত্ব পায়নি। শেষ হাসি হাবাসই হেসেছেন। আমি নিজে একটা বড় দলকে কোচিং করানোর সুবাদে বুঝি, কোচের এ রকম মস্তানি সম্ভব নিজের উপর অগাধ আস্থা আর দলের প্রতিটা ফুটবলারের প্রতি গভীর বিশ্বাস থাকলে। এতে সেই কোচের ছেলেরা সব সময় বাড়তি অনুপ্রেরণা পায়। মোটিভেটেড থাকে। হাবাসের এটাই আস্তিনের তলায় লুকোনো তাস। যেটা ফেলে তিনি বাজিমাত করছেন।
আটলেটিকো কলকাতার ডিফেন্স নিয়ে এ বার একটা সময় প্রচুর সমালোচনা হয়েছে। তা সত্ত্বেও হাবাস টিমের মধ্যে সেই আতঙ্কের ভাইরাস ঢুকতে দেননি। টুর্নামেন্টে এ পর্যন্ত সবচেয়ে কম গোল খেয়েছে কিন্তু তাঁর টিমই। চোটের ধাক্কায় জোসেমি দেশে ফিরে গিয়েছে। হাবাস কিন্তু ঠিক তিরিকে সেন্ট্রাল ডিফেন্সে এনে সমস্যা সামাল দিয়েছেন। এটাই ওঁর ইউএসপি। সমস্যায় পড়লে এতটুকু ঘাবড়ে না গিয়ে ঠান্ডা মাথায় সেটার মোকাবিলা করা।
যে আট বিদেশি এ বারের আইএসএলে কোচিং করাচ্ছেন, আমার মতে পারফরম্যান্সের বিচারে তাঁদের মধ্যে হাবাস এক নম্বর।
হিউমের কথাটাই এক বার ভাবুন! এ বার এটিকের প্রথম পাঁচ ম্যাচে একটাও গোল পায়নি গতবারের টুর্নামেন্টের সেরা ফুটবলার। প্রচুর সমালোচনা হচ্ছিল ওর ফর্ম নিয়ে। হাবাস কিন্তু তার পরেও সেই ছাত্রের উপর পূর্ণ আস্থা দেখিয়ে প্রত্যেকটা ম্যাচে তাকে খেলিয়েছেন। নিট ফল— ছয় নম্বর ম্যাচেই হ্যাটট্রিক করে হিউম। তার পর থেকেই গোলের মধ্যে। আইএসএল টু-তে ছেলেটা এখন ছয় গোল করে বসে রয়েছে। দুঃসময়ে এই যে হিউমের পাশে থাকা, এখন তারই ডিভিডেন্ড পাচ্ছেন কলকাতা দলের কোচ।
আবার প্রয়োজনে দলের তারকা ফুটবলারকে একটা-দুটো ম্যাচ বসিয়ে দিয়ে তার ভেতরের ভাল খেলার খিদে বাড়িয়ে তুলতেও হাবাসের জুড়ি মেলা ভার। এই যে সমিগ দ্যুতি এখন দুরন্ত ফর্মে, ওর ক্ষেত্রে কিন্তু হাবাসের এই ফর্মুলাটাই কাজ করেছে। সেই সঙ্গে দ্যুতিকে কখনও ডান দিকে, কখনও বাঁ দিকে খেলিয়ে দলকেও ঠিক সময় পিক ফর্মে নিয়ে গিয়েছেন।
হাবাসের আর একটা বড় গুণ প্রতিদ্বন্দ্বী দল নিয়ে চমৎকার হোমওয়ার্ক। বক্সের বাইরে থেকে শট নিলে এফসি গোয়ার গোলকিপার কাট্টিমণি যে নড়বড় করে সেটা মোক্ষম ধরে ফেলেছিলেন হাবাস। সল্ট লেক স্টেডিয়ামে আগের ম্যাচে তাই গোয়া বক্সের কাছাকাছি পৌঁছলেই হিউমরা এই কাজটা কোচের নির্দেশ মেনে নিয়মিত করেছিল। যার সুফল সে দিন বোরহার গোলটা। আবার হাবাসের আল্ট্রা ডিফেন্সিভ স্ট্র্যাটেজি নিয়ে কেউ পাল্টা ছক বানানোর প্ল্যান করলে তখন এটিকে কোচ তাঁর দলকে আক্রমণাত্মক, ডাইরেক্ট ফুটবল খেলিয়ে দেন। যেটা গোয়া বা মুম্বই ম্যাচে করেছেন হাবাস।
এত সবের পরেও অবশ্য আটলেটিকো কলকাতা সেমিফাইনাল যাবে কি না, তার উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে কঠিন। এখনও।
অনেক অঘটন ঘটতে পারে রাউন্ড রবিন লিগের শেষ পর্যায়ে। পুণে আর মুম্বই শেষ কামড় দেওয়ার চেষ্টা করবেই। আমার মন বলছে, হাবাস শেষ দু’ম্যাচে কাউন্টার অ্যাটাক স্ট্র্যাটেজিতে বেশি জোর দেবেন। যেহেতু এ বার আচমকা দ্রুত আক্রমণে গিয়ে গোল তুলে নেওয়ার ব্যাপারে কলকাতা সফল হচ্ছে। আনন্দবাজারে আমার আগের একটা কলামে লিখেছিলাম, হাবাসকে লিগ টেবলের উপরের দিকে উঠতে গেলে ওর দলকে আক্রমণাত্মক খেলাতে হবে। যত দূর মনে পড়ছে, সেই সময় কলকাতার ৮ ম্যাচে ১০ পয়েন্ট ছিল। পরিস্থিতি বুঝে আক্রমণাত্মক হওয়ার পরে আজ হাবাসের কলকাতার কিন্তু ১২ ম্যাচে ২০ পয়েন্ট। এটাই ওঁর কৃতিত্ব। নিজের দল নিয়ে কখন কী পরিকল্পনা নেবেন, তা প্রতিপক্ষকে আগাম বুঝতেই দেন না।
তবে এর সঙ্গে একটা কথা বলব— অবনমন না থাকায় আইএসএলে সব কোচই যেন বাড়তি সাহসী। হাবাসও সেই দলের বাইরে নন। আরাতা একটা ম্যাচে দু’গোল করার পরেও তাকে পরের ম্যাচে দলেই না রাখার সাহস দেখিয়েছেন হাবাস। এমন পরিকল্পনা নেওয়ার সুযোগ পান কি বিদেশি কোচ বলেই? কোনও ভারতীয় কোচ এ রকম করলে পরের দিন তার চাকরি থাকত তো? ভাবার বিষয়!