বিস্ফোরক ‘ডেভিডদের’ নিয়ে তোলপাড়

আন্ডারডগদের চমকের দৌরাত্মে কি এ বার ক্লাব ফুটবলের ছায়া

কোস্টারিকা। কলম্বিয়া। ক্রোয়েশিয়া। চিলি। প্রত্যেকটা দেশের নাম ‘সি’ দিয়ে শুরু হওয়া ছাড়াও আরও একটা মিল এরা মাত্র দশ দিনে পড়া ব্রাজিল বিশ্বকাপকে ইতিমধ্যেই শিহরিত করে দিয়েছে। আরও একটা মিল টুর্নামেন্ট শুরুর আগে এদের সম্ভাবনা গড়পড়তা ছিল ১৫০০-১। যে টিমটা সবচেয়ে বেশি সাড়া ফেলেছে সেই কোস্টারিকার দর ছিল ২৫০০-১। মানে এদের সম্ভাবনার পিছনে এক টাকা লাগালে আড়াই হাজার টাকা পাওয়া যাবে। একেবারেই আশ্চর্য নয় যে মাত্র ন’দিন খেলা হতে না হতেই জুয়ার দর আবার রিভিশন হচ্ছে।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

বেলো হরাইজন্তে শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৪ ০৩:৪৪
Share:

যেন কাপ জেতাই হয়ে গিয়েছে। ব্রাজিল বিশ্বকাপে ‘ছোট’ দেশের ভক্ত।

কোস্টারিকা।

Advertisement

কলম্বিয়া।

ক্রোয়েশিয়া।

Advertisement

চিলি।

প্রত্যেকটা দেশের নাম ‘সি’ দিয়ে শুরু হওয়া ছাড়াও আরও একটা মিল এরা মাত্র দশ দিনে পড়া ব্রাজিল বিশ্বকাপকে ইতিমধ্যেই শিহরিত করে দিয়েছে। আরও একটা মিল টুর্নামেন্ট শুরুর আগে এদের সম্ভাবনা গড়পড়তা ছিল ১৫০০-১। যে টিমটা সবচেয়ে বেশি সাড়া ফেলেছে সেই কোস্টারিকার দর ছিল ২৫০০-১। মানে এদের সম্ভাবনার পিছনে এক টাকা লাগালে আড়াই হাজার টাকা পাওয়া যাবে। একেবারেই আশ্চর্য নয় যে মাত্র ন’দিন খেলা হতে না হতেই জুয়ার দর আবার রিভিশন হচ্ছে।

ইরানের নাম ‘সি’ দিয়ে শুরু না হলেও তারা একই আন্ডারডগ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে যেন খেলল। এমনকী ষোলো নম্বর জার্সিধারী রেজা, যাঁকে গুচ্চি নামেই দেশের ফুটবলমহল ডাকে, তিনি আর একটু হলে ইরানকে এগিয়েই দিচ্ছিলেন! একটু পরেই আশকানের চমৎকার হেডার দু’বার বাঁচালেন সের্জিও রোমেরো। দু’টোই অব্যর্থ গোল! অর্থাৎ, আন্ডারডগ ইরান কি না তিন গোল করার অবস্থা তৈরি করে ফেলেছিল। লাতিন আমেরিকান শেষ প্রহরীর নৈপুণ্যে সেগুলো ঘটেনি এই যা!

শনিবার বেলো গ্যালারিতে বসে ম্যাচ দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, প্লেয়াররা ক্লাবের খেলা শেষে জাতীয় দলে ফেরার পর বিশ্বকাপ-পূর্ব সময়টা এমনিই কম। কোচেরা বোধহয় সুযোগই পান না, বোঝাপড়া আর কম্বিনেশনকে ক্লাব পর্যায়ের মতো নিখুঁত স্তরে নিয়ে যেতে। ইরান ডিফেন্স শক্তি বিচারে ফুটবলের সুপার পাওয়ারের চেয়ে যত ঠুনকোই হোক, তারা একসঙ্গে অনুশীলন আর কম্বিনেশন তৈরির বাড়তি সময় পেয়েছে। সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর শারীরিক দিক দিয়ে একেবারে তাগড়াই রয়েছে। কোনও লা লিগাও ছিল না তাদের। কোনও বুন্দেশলিগাও না!

শনিবারের ইরান বোধহয় আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল, ব্রাজিলের দশ দিনে আন্ডারডগদের সাফল্যের একটা বুনোট আছেই। একটা মডেল আছে। একেবারেই ফ্লুক নয়। সেটা ভাঙতে হলে লিওনেল মেসির জিনিয়াস দরকার! যাদের মেসি নেই তারা আটকে যাবে। আটকাচ্ছেও।

অঘটন তো পুরনো সব বিশ্বকাপেও হয়েছে। কোনওটায় ক্যামেরুন। কোনটায় সেনেগল। কোনওটায় আলজিরিয়া। কিন্তু এতগুলো আন্ডারডগ একই সঙ্গে প্রাক টুর্নামেন্ট হিসেব তছনছ করে দিচ্ছে এমনটা চুরাশি বছরের বিশ্বকাপ কখনও দেখেনি।

শনিবার বেলো হরাইজন্তে মিডিয়া সেন্টারে এটা নিয়ে বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকদের মধ্যে একটা অঘোষিত আলোচনা সভা হতে দেখলাম। কেউ ইংরেজ। কেউ উরুগুয়ের। কেউ ব্রাজিলের, বেশির ভাগই আর্জেন্তিনার। এদের কারও কারও মনে হচ্ছে, ব্রাজিলের আবহাওয়ার সঙ্গে পূর্ব বা দক্ষিণ আমেরিকান দেশগুলো মানিয়ে নিতে পারছে বলে এটা ঘটছে। ঠান্ডার দেশগুলো মোটেও এত আপসেট ঘটাচ্ছে না। প্রেস ক্যান্টিন লাগোয়ায় দ্রুত লাঞ্চ সারতে সারতে সেই আড্ডায় কেউ কেউ এমনও বললেন, “দু’তিনটে ঘটনা দেখে একটা প্যাটার্ন আন্দাজ করা ঠিক হবে না। আরও খেলা চলুক, তার পর না হয়।” শুধু ব্রিটিশ মিডিয়ার কেউ কেউ বলছিলেন, মনে হচ্ছে টপ প্লেয়ারদের ক্লাব ফুটবলের ক্লান্তি এখনও যায়নি, টুর্নামেন্টের সেকেন্ড হাফে ওরা মেজাজে ফিরবে। কিন্তু তত দিনে দেরি না হয়ে যায়।”

বিশ্বের শীর্ষ স্থানীয় কোচেদের গোটা চারেক সাংবাদিক সম্মেলন এখানে কভার করা এবং নিজের চোখে দেখার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হচ্ছে, ব্রিটিশ সাংবাদিকই ঠিক। দেশজ ফুটবলের মঞ্চে একটা বিশাল প্রভাব ফেলছে ইউরোপের ক্লাবগুলো! প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষে। আর সেটাই অলক্ষ্যে ঠিক করে দিচ্ছে বিশ্বকাপের প্যাটার্ন। অন্তত প্রাথমিক পর্বের তো বটেই।

ব্রাজিলে বত্রিশ দেশের যে ৭৩৬ ফুটবলার বিশ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ, তার শতকরা পঁচাশি ভাগই কোনও না কোনও ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত। এখানে খেলার আগে যখন দু’দেশের টিম লিস্ট দেওয়া হয়, সেখানে কোন প্লেয়ার কোন ক্লাবের হয়ে খেলেন সেটাও লেখা থাকে। এটা বেশ অবিশ্বাস্যই লাগে যে, আর্জেন্তিনা অধিনায়ক আর্জেন্তিনার হয়ে খেলছেন সেটাই তো টিম লিস্টে তাঁর প্রথম ও শেষ পরিচয়। দেশজ মঞ্চে আর কিছু গ্রাহ্য হবে কেন? কিন্তু হয়। মেসির নামের পাশে লেখা থাকে বার্সেলোনা এফসি। রোনাল্ডোর পাশে রিয়াল মাদ্রিদ। সুয়ারেজের পাশে লিভারপুল।

উরুগুয়ে কোচ সে দিন প্রকাশ্যেই বলেছেন, দেশের ক্যাম্পে কোচেরা যখন ফুটবলারদের পাচ্ছেন, তখন তারকা প্লেয়াররা হয় চোট পেয়ে বসে আছে। বা খেলে খেলে ক্লান্ত। বলেছেন, ক্লাব টুর্নামেন্ট শেষ আর বিশ্বকাপ শুরু এর মধ্যে দিনের মেয়াদটা বাড়ানো উচিত। শুনলাম আর্জেন্টাইন ফিজিও বিরক্তি প্রকাশ করে বলেছেন, যাকে হাত দিচ্ছি বেসক্যাম্পে তারই কোনও না কোনও চোট। সারা বছর শ্রেষ্ঠ ফিজিওরা তা হলে ক্লাবে কী করে?

বিশ্বকাপ শুরুর আগে চোটের তালিকায় প্রচুর তারকা ছিলেন। এখনও আছেন। সুয়ারেজ। রোনাল্ডো। ফালকাও। সোয়াইনস্টাইগার। জাভি। আর শুধু তো শারীরিক চোট নয়, তুমুল মানসিক অ্যাডজাস্টমেন্টেরও তো ব্যাপার থাকে। ক্লাব থেকে দেশ! আর সেটা রাতারাতি হয় না। এক ব্রাজিল ফুটবলারের ভাষায়, “দুটো সিম কার্ড রাখতে হয় আধুনিক ফুটবলারকে। একটা ক্লাবের। একটা দেশের। কিন্তু প্রতি বার যখন ক্লাব থেকে দেশে আসি, দেশের সিমে নেটওয়ার্ক ধরতে একটু সময় লাগে। পরিস্থিতিটাই পুরো আলাদা।”

কালকের জয়সূচক গোলে যিনি সান হোসেতে রাস্তার নাচানাচিতে কোস্টারিকান প্রেসিডেন্টকে অবধি নামিয়ে দিয়েছেন, সেই ব্রায়ান রুইজ ইংল্যান্ডের অন্যতম ওঁচা দল ফুলহ্যামেও পুরো জায়গা পাননি। তাঁকে তারা ধার দেয় পিএসভি আইন্দোভেনকে। সেখানেও খুব বেশি ম্যাচ খেলানো হয়নি তাঁকে। মেক্সিকান গোলকিপার বিশ্বকাপের সর্বকালের সেরা যুগল সেভ করে থাকতে পারেন কিন্তু তাঁকে তো এ বছর ক্লাব ফুটবলের ধকল নিতেই হয়নি। তিনি ফ্রি প্লেয়ার এবং অবশ্যই ক্লাব প্রত্যাখ্যাত হয়ে।

কলম্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, চিলি বা মেক্সিকোয় অনেক অনামী প্লেয়ার আছেন যাঁরা ক্লাবে খেললেও তাঁদের হয় সব ম্যাচ খেলানো হয় না। বা ট্রফি জেতার পাগলের মতো চাপ নেই। বিশ্বকাপে তাঁরা যখন আসেন, শারীরিক ভাবে টগবগে হয়ে তো আসেনই। প্লাস একটা খিদে কাজ করে, এখানে চমক দিয়ে ইউরোপের বড় প্লেয়ার এজেন্টের নজরে পড়ব!

এই বেলো হরাইজন্তেতেই গত বছর একটা ম্যাচে ব্রাজিল ২-২ ড্র করে চিলির সঙ্গে। তার পর গ্যালারি থেকে নেইমারকে এত গালাগাল দেওয়া হতে থাকে যে, থিয়াগো সিলভা সমর্থকদের কাছে পরের দিন আবেদন করতে বাধ্য হন, এ ভাবে ওর মনোবল নষ্ট করে দেবেন না। নেইমার নাকি ঘনিষ্ঠ মহলে ক্ষোভ দেখিয়েছিলেন, ক্লাব ফুটবল ক্ষমাহীন, পরের দিন দেশের হয়ে খেলতে হলে সেখানকার দর্শকও ক্ষমাহীন। তা হলে একটা প্লেয়ার পারফর্ম করবে কী করে?

চিলির অবশ্যই সেই ড্র-য়ে কিচ্ছু আসে যায়নি। আন্ডারডগ সুপারপাওয়ারের সঙ্গে ড্র করেছে এটাই তো সাফল্য। তা ছাড়া চিলির ক’জন প্লেয়ারকে আর লোকে চেনে! যাঁদের চেনে তাঁদের ওপরও তো সিআর সেভেনের মতো এমন মারাত্মক স্পটলাইট নেই যে, কেউ সাবধান করে দেবে, ওহে দেশের হয়ে এত ঝুঁকি নিয়ে চললে কিন্তু রিয়ালে তোমার ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর একবার ভেবে দ্যাখো।

যেটা দাঁড়াচ্ছে, যে টিমে যত বেশি ক্লাব লিগের চ্যাম্পিয়ন প্লেয়ার, তারা বিশ্বকাপের প্রাথমিক পর্বে তত বিপন্ন। কারণ সেই মরসুমে যৌবনের সেরাটা ক্লাবে দিয়ে তার পনেরো দিনের মধ্যেই যখন হুড়ুমদুড়ুম করে দেশের হয়ে খেলতে চলে আসছে, সেটাকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও করে ফেলছে বৃদ্ধাশ্রম!

নমুনা? কেন স্পেন!

নমুনা? হতে পারেন লিওনেল মেসি। বার্সা ফাইনাল-টাইনাল যেতে না পারায় কম খেলেছেন। আর্জেন্তিনা ক্যাম্পে তাই যৌবন থাকার কথা। বৃদ্ধাশ্রম নয়!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement