মুদগল। তদন্তে তাঁর সম্ভাব্য সৈনিকদের নিয়ে জল্পনা চলছে।
গত কুড়ি-পঁচিশ বছর এই দিনটাতে ভারতীয় ক্রিকেট মহল এবং জাতীয় সব দৈনিকের খেলার পাতা নিয়ম করে একটা ব্যাপারে আলোড়িত থাকে। চব্বিশ ঘন্টা পর সচিন তেন্ডুলকরের জন্মদিন!
২০১৪-র ২৩ এপ্রিল সেটা একেবারেই যে ঘটল না তার একমাত্র কারণ অবশ্যই তেন্ডুলকরের অবসর নিয়ে ফেলা নয়। ক্রিকেট জগতের সর্বাঙ্গীন মনোযোগ যে আপাতত আগামী মঙ্গলবারের সুপ্রিম কোর্টের দিকে। বিচারপতি মুদগলের দিকে। শ্রীনিবাসনের পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে। সেই নিবিষ্ট জল্পনা আমিরশাহিতে হতে থাকা আইপিএল তো বটেই। সচিনের একচল্লিশতম জন্মদিনেরও গ্রহণ লাগিয়ে দিয়েছে!
বুধবার সকাল থেকে যেমন বোর্ডের এক শ্রেণির লোকজন নিজেদের আলোচনায় তীব্র নিন্দামন্দ শুরু করেন মুকুল মুদগলকে। বোর্ডের সঙ্গে মাত্র কিছু দিন আগেও জড়িত থাকা বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের শিবির বলতে থাকে, মুদগলের বিশ্বাসযোগ্যতাও মাননীয় আদালতকে খতিয়ে দেখতে হবে। কেউ কেউ এমনও বলেন, দরকারে ওঁর সম্পর্কে একটা সিডি তৈরির কথাও ভাবা হোক।
দিনভর জল্পনা চলতে থাকে সুপ্রিম কোর্টের কাছে প্রস্তাবিত কমিটিতে মুদগল কার কার নাম নেবেন? তিনি কি কোনও ক্রিকেটারকে নেবেন? নিতে চাইলে কাকে নেবেন?
বিরোধী শিবিরে আবার জল্পনা চলে, বোর্ডে মুদগলকে নিয়ে এত ঠকঠকানি কীসের? যদি কেউ দোষীই না হয়, তা হলে এত কী বিচারের ভয়? নাকি মুদগল তদন্ত করলে শুধু শ্রীনি নন, বোর্ডে অনেকেরই কঙ্কাল বেরিয়ে পড়বে। বিরোধী শিবিরের কোনও কোনও প্রভাবশালী মুখের বিশ্বাস, ক্রিকেট প্রশাসনে সামগ্রিক পচন এখনও ধরেনি। তাঁরা তুলে ধরছেন যে, সে দিনের বৈঠকে শশাঙ্ক মনোহরের পাশাপাশি জগমোহন ডালমিয়াও জোরালো বক্তব্য রেখেছিলেন। রেখেছিলেন পঞ্জাবের পাণ্ডব। এমনকী দিল্লির প্রতিনিধিও।
বিরোধীদের দাবি, শশাঙ্ক সে দিন মোটেও ১৪-১ হারেননি। মিডিয়ায় ক্রমাগত ভুল লেখা হচ্ছে। হেরেছিলেন ১১-৬। বিরোধীদের হয়ে ভোট দেয় বিদর্ভ, সিএবি, এনসিসি, পঞ্জাব, দিল্লি এবং গোয়া। এদের বিশ্বাস, মঙ্গলবার আদালতের চূড়ান্ত অর্ডার যদি কঠোর হয়, বোর্ডের বাকি অংশকেও শ্রীনির বিরুদ্ধে খুব সহজেই ঘোরানো সম্ভব হবে। এঁরা দাবি করছেন, শশাঙ্ক হতাশ হয়ে লড়াই ছেড়ে দিলেন বলে যে খবর রটছে, তা ঠিক নয়। তিনি লড়াইয়ে পুরো মাত্রায় আছেন। শেষ দেখে ছাড়বেন।
বিরোধীদের আর এক অংশ অবশ্য মনে করে বোর্ডকে সম্পূর্ণ শোধন করতে হবে। শ্রীনি-আমলে নৈতিকতার মাত্রা এত ঢিলেঢালা হয়ে গিয়েছে যে, আগাপাশতলা না বদলালে শুধু প্রধান হঠিয়ে সংষ্কার সম্ভব নয়। শ্রীনির সঙ্গে তাঁর সঙ্গীদেরও হটাতে হবে।
অতীতে বোর্ডের নির্দিষ্ট ট্র্যাভেল এজেন্ট ছিল। তার মাধ্যমে টিকিট করতে হত। সে সরাসরি বিল করত বোর্ডকে। এখন সে প্রথা উঠে গিয়েছে। যে যার মতো বিল করে দিচ্ছে। আর সেটা পাসও হয়ে যাচ্ছে। পূর্বাঞ্চলের কিছু ক্রিকেট কর্তা (সিএবি নয়) হালফিল যে সব বিল করেছেন, দেখে ক্রিকেট কর্তাদের চোখ কপালে উঠে গিয়েছে। এক সদস্য আম্পায়ার্স অ্যাকাডেমির বৈঠকে নাগপুর গিয়েছিলেন। গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেসে নামেন। তাঁকে রেল স্টেশনে রিসিভ করে বিদর্ভ ক্রিকেট সংস্থার গাড়ি। ফেরেনও তিনি ট্রেনে। অথচ বোর্ডের কাছে তিনি বিল করেছেন এক লাখ ৭২ হাজার টাকার। বলেছেন, “রাঁচি থেকে মুম্বই হয়ে নাগপুরে এসেছি। পুরোটাই বিজনেস ক্লাসে।” বিরোধীদের কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন, মুম্বই-নাগপুর বিমানে তো বিজনেস ক্লাসই নেই। কিন্তু সেটা ধোপে টেকেনি। বিল পাস হয়ে যায়। এই টাকার সঙ্গে ভদ্রলোক অবশ্যই ডিএ-ও পেয়েছেন। আগে বোর্ডের সাব কমিটির সদস্যরা বিজনেস ক্লাস পেতেন না। শ্রীনির আমলে সবাইকে ঢালাও বিজনেস ক্লাস করে দেওয়া হয়েছে। আইপিএল উদ্বোধনে শুধু বরোদা থেকেই বোর্ড সচিব নিয়ে গিয়েছিলেন জনা সাতেককে। এঁরা বোর্ডের পয়সায় খায়িং-থাকিং করে ফিরেছেন।
সাধারণ ভাবে বিরোধীদের পর্যবেক্ষণ হল, শ্রীনি-আমলে নৈতিকতার মানদণ্ড অনেক নেমে গিয়েছে। শ্রীনির প্রবল সমর্থক হরিয়ানা সংস্থার প্রধান টিনু চৌধুরী যেমন সে দিন সভাকে বিষ্ফারিত করে দিয়েছেন এই বলে যে, আইপিএল তদন্ত কমিটিতে নাও করিনা, প্রিয়ঙ্কা আর দীপিকাকে। স্থূল রসিকতা বলে বিরক্তিতে যখন সভা তা উড়িয়ে দিয়েছে, তখন টিনু আবার উঠে বলতে থাকেন, “কী হল, ওদের উপর ভোট নেওয়ার কী হল?”
বিরোধীদের অভিমত বোর্ড আজ কোন পর্যায়ে নেমেছে, এই লোকটি তারই প্রোটোটাইপ।
সবচেয়ে সাঙ্ঘাতিক অভিযোগ অবশ্য এখন আদালতের সামনে যে, মুদগল কমিশন সাক্ষ্য নেওয়ার সময় কিছু অডিও ক্যাসেট নাকি বাইরে পাচার হয়ে গিয়েছে। অডিও রেকর্ডিং সিডিতে ট্রান্সফার করার সময় হার্ড ড্রাইভটা বাইরে বের করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ যারা কাজটা করেছে, তারা ঘরে বসে প্রত্যেকে গোপন সাক্ষ্য শুনতে পেয়েছে। গত বছরের ১৩ নভেম্বর থেকে ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত এ ভাবে অডিও রেকর্ডিং করা হচ্ছিল। এর পর কোনও ভাবে বিচারপতি মুদগলের সন্দেহ হয়। পরবর্তী পর্যায়ে তাই কলকাতা, বেঙ্গালুরু-সহ নানা জায়গায় অডিও রেকর্ডিং করা হয়নি। তাই মুদগল কমিটির সামনে সৌরভ কী বলেছেন বা রাহুল, সেটা সিডি-র মাধ্যমে বাইরে লিক হওয়ার প্রশ্ন নেই। কিন্তু তার আগের লোকেদের ক্ষেত্রে সেই সম্ভাবনাটা থেকেই যায়। মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে এ নিয়েও সামান্য আলোচনা হয়েছে।
আগামী মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে সম্ভাব্য রায়ের দিনে শ্রীনির আইসিসি যাত্রা স্থগিত হয় কি না-র মতো সিডি লিক প্রসঙ্গও চাঞ্চল্যকর হয়ে উঠতে পারে।