মা-বাবার সঙ্গে সোমবার। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস
তিনি এখন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের টিমের হিরো!
আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের ‘নয়ন মণি’!
অথচ একটা সময়ে এই মহম্মদ রফিকই আটলেটিকো দে কলকাতা ছেড়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন!
একেই টিমে সুযোগ পাচ্ছিলেন না বলে হতাশ ছিলেন। তার উপর আবার টিম ম্যানেজমেন্টের অনুমতি ছাড়াই চাকরি বাঁচাতে অফিসের হয়ে ম্যাচ খেলতে গিয়ে তীব্র সমস্যায় পড়েছিলেন। এক রকম কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিলেন ২২ বছরের ছেলেটি। তবে এখন এ সব যন্ত্রণার দিনগুলো অতীত। গোল করে আটলেটিকোকে চ্যাম্পিয়ন করার পর এখন তাঁর চোখ জোড়া শুধুই স্বপ্ন। আরও বড় ফুটবলার হওয়ার। “একটা সময় মনে হয়েছিল আইএসএল খেলব না। খুব হতাশ লাগছিল। কিন্তু সহর্ষ পারেখ আর আমার বাবা-মা আমাকে সে সময় উজ্জীবিত করেছিলেন। বলেছিলেন, সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে। আর সুযোগ পেলেই নিজের সেরাটা দিতে। সুযোগ পেয়ে সেটা কাজে লাগাতে পেরেছি। খুব ভাল লাগছে।” নিজের বাড়িতে বসে সোমবার কথাগুলো বলছিলেন রফিক।
মা রাবিয়া বিবি রবিবার গোটা দিন ধরে তাঁর জন্য রান্না করেছিলেন। ছেলের পছন্দের মাংস, পায়েস সহ আরও অনেক কিছু। কিন্তু রবিবার তিনি এত রাতে বাড়ি ফিরেছেন যে কিছু খেতে পারেননি। আর সোমবার সকালে উঠেই দৌড়েছেন ইস্টবেঙ্গল প্র্যাকটিসে। তার পর অফিস। এখনও মায়ের হাতের রান্না খেয়ে ওঠা হয়নি তাঁর। ইস্টবেঙ্গল কোচ আর্মান্দো কোলাসো-সহ সতীর্থদের অভিনন্দনের জোয়ারে ভেসেছেন। অফিসেও একই পরিস্থিতি। সব সেরে বিকেলে যখন তিনি বাড়ি ফেরেন তখন তাঁর চোখেমুখে এতটুকু ক্লান্তি নেই। উল্টে লাজুক হেসে বললেন, “আইএসএল তো দু’মাসের। ক্লাব ফুটবল তো গোটা বছর থাকবে। এখনও তো আসল টুর্নামেন্টগুলোই শুরু হয়নি। ফেড কাপ, আই লিগেও তো র্যান্টি, ডুডুদের পাশে থেকেই গোল করতে হবে।”
এ দিন বিকেলের পড়ন্ত বেলায় বোদাই গ্রামে মহম্মদ রফিকের বাড়ি গিয়ে দেখা গেল, তিনি রাস্তার মোড়ে পাড়ার বন্ধুদের নিয়ে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। দেখে কে বলবে মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টা আগেই তাঁর গোলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আটলেটিকো দে কলকাতা! কে বলবে, গার্সিয়া, ফিকরুদের ছাপিয়ে তিনি এখন আটলেটিকোর ‘আসল হিরো’। গোল করার আগের রফিক, আর এই রফিকের মধ্যে যে কোনও পার্থক্যই নেই। শুধু তাঁর বাড়ির সামনে সংবাদমাধ্যমের ভিড়টাই যা অপরিচিত দৃশ্য।
মা রাবিয়া বিবি তো ছেলের সাফল্যে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত। তাঁর ছোট্ট রাজা যে বিশ্বকাপারদের টপকে আটলেটিকোকে চ্যাম্পিয়ন করেছে। রফিকের কথা উঠলেই গড়িয়ে পড়ছে আনন্দ্রাশ্রু। এমনকী ছেলের যে গোল আট কোটি টাকার ট্রফি এনে দিয়েছে কলকাতাকে, তা দেখার সময়ও চোখের জল আটকাতে পারেননি। বলছিলেন, “রফিককে যখন পরিবর্তে নামানো হল তখন খুব টেনশন হচ্ছিল। টিভিতে রফিকের গোল দেখার পর কেঁদেই ফেলেছিলাম। ও যখন ছোট ছিল, পড়া ছেড়ে ফুটবল খেলে বেড়াত বলে, কত বকা দিয়েছি। কিন্তু এখন বুঝি, ওকে ফুটবল না খেলতে দেওয়াটাই অন্যায় হত।”
বাবা কামরহাটি জুট মিলের সামান্য এক কর্মী। চার ভাই বোনের মধ্যে রফিক সেজ। অনেক কষ্ট করেই ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন রফিকের বাবা মহম্মদ আবুল কাশেম। কম রোজগার হওয়ার জন্য ছেলের ফুটবলের শখও সব সময় পূরণ করতে পারতেন না। রফিক নিজেই পাড়ায় পাড়ায় খেপ খেলে যে টাকা পেতেন, তাই দিয়েই নিজের ফুটবলের সরঞ্জাম কিনতেন। এ দিন যেন কিছুটা আফসোস করেই রফিকের বাবা বলছিলেন, “ওকে তো অনেক কিছুই দিতে পারিনি। অনেক লড়াই করে ও এই জায়গায় পৌঁছেছে। মাঝেমাঝে খুব খারাপ লাগে। মনে হয় ছেলেটার জন্য যদি আরও কিছু করতে পারতাম!”
শুধু ফুটবলার হিসেবেই নয়, বোদাই গ্রামে রফিকের অন্য একটি পরিচয়ও রয়েছে। তিনি বিনাপয়সায় বাচ্চাদের পড়ান। বাড়ির কাছেই তাঁর কোচিং ক্লাস। গত বছর নিজে স্নাতক হয়েছেন। কিন্তু তাঁর অনেক আগে থেকেই এই কোচিং ক্লাস চালাচ্ছেন রফিক। নিজে হাজার সমস্যায় ছিলেন। টাকার অভাবে হয়তো বুট কেনা হয়নি। বা ফুটবলের অন্য কোনও সরঞ্জাম। অনেক সময় ছেঁড়া বুট পরেই খেলতে যেতে হয়েছে। তবু বিনা পয়সায় পড়ানো বন্ধ করেননি। তাই নিজের গ্রামে তিনি ভীষণ জনপ্রিয়। তবে শুধুমাত্র ফুটবলার হিসেবে নয়, মানুষ রফিক হিসেবেও।