আরব্য উপন্যাসের চরিত্রদের মতো আমোদ-প্রমোদে ভাসিয়ে রাখতে তাঁর ভোটারদের একেক জনকে আমিরশাহি উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন নায়ায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন। তাঁর ধারণা ছিল, আরব দেশে জৌলুস ভরা ‘অল এক্সপেনসেস পেইড’ আইপিএল-আতিথেয়তা ক্রিকেট বোর্ডে তাঁর ভক্ত সংখ্যা বরাবরের মতোই দুর্জেয় রেখে দেবে। কে জানত আইপিএল-উৎসবের মধ্যে মরুভূমির চোরাবালির মতোই এমন অপ্রত্যাশিত বিপদ আবির্ভূত হবে। আর আতঙ্কে সাময়িক দিশেহারা করে দেবে ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বময় প্রভুকে!
“চেক মেট। আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। রাজা এ বার যে ঘরেই যাবে কিস্তিমাত,” সোৎসাহে বললেন পশ্চিম ভারতের ক্রিকেট কর্তা।
“এ বার কী হবে? এ বার বাঁচবে কী করে,” জানতে চাইলেন উত্তরাঞ্চলের ডাকসাইটে ক্রিকেট কর্তা।
“এখনই বলা মুশকিল কী হবে। শ্রীনি ঘুরিয়েও দিতে পারে। তবে এ বার যে জোর প্যাঁচে পড়েছে সন্দেহ নেই,” বলছেন পূর্ব ভারতের বিখ্যাত প্রশাসক।
ভারতীয় ক্রিকেটের মহাব্যতিক্রমী ঝড় বইয়ে দেওয়া বৃহস্পতিবারের মূল নির্যাস হল, খোদ শ্রীনির বোর্ডেই শ্রীনির বিরুদ্ধে বিচারসভা ডাকার ব্যবস্থা হয়েছে। যা বসবে রোববার মুম্বইয়ে ভারতীয় বোর্ডের ক্রিকেট সেন্টারে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী সেই সভায় থাকতে পারবেন না শ্রীনি নিজে। কিন্তু যোগ দেবেন বিরোধী শিবিরের প্রধান সেনাপতি শশাঙ্ক মনোহর।
সেই ২০১১-তে বোর্ডের শীর্ষ পদ ছেড়ে দেওয়ার পর আর কখনও বোর্ডের বৈঠকে দেখা যায়নি মনোহরকে। বলেছিলেন, আর কখনও এই চত্বর মাড়াবেন না। অথচ এ বার বিদর্ভের হয়ে তিনি বৈঠকে থাকবেন। ওয়ার্কিং কমিটির যে জরুরি বৈঠক এ দিন বিরোধীদের প্রচণ্ড চাপে ডাকতে বাধ্য হলেন শ্রীনির-ই পরম অনুগত সচিব সঞ্জয় পটেল।
এত দিন ধরে লড়াইটা হচ্ছিল ভারতীয় ক্রিকেট মিডিয়া বনাম শ্রীনি। বড়জোর সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের মন্তব্য বা মুদগল রিপোর্টের বিরুদ্ধে শ্রীনি। বোর্ড সদস্যদের বিরুদ্ধে সরাসরি তাঁকে লড়তে হচ্ছিল না। বোর্ডে যাঁরা বিরোধিতা করছিলেন তাঁরা অনেকটাই মেঘের আড়াল থেকে। বোর্ডে তাই নিজের অনুগত সচিব এবং কোষাধ্যক্ষ ইস্তফা দেওয়ার পরেও প্রখর অন্তর্লীন চাপে কখনও পড়তে হয়নি শ্রীনিকে। এই প্রথম শ্রীনির বিরুদ্ধে তাঁরই পরিচালিত তিরিশ সদস্য সংস্থার এগারোজন সরকারি ভাবে বিরুদ্ধে আবির্ভূত। আর এরা মেঘনাদ নন। সরাসরি লড়তে নেমে গেলেন।
এঁরা লিখিত ভাবে অভিযোগ করেছেন বোর্ডের এমন আপৎকালীন অবস্থাতেও ওয়ার্কিং কমিটির কোনও বৈঠক ডাকা হচ্ছে না। সদস্যদের সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে বোর্ড পরিচালিত হচ্ছে। অবিলম্বে জরুরি সভা ডাকা হোক। প্রথমে এই চিঠি পেয়েও সভা ডাকতে চাননি বোর্ড সচিব। কিন্তু পরের পর ক্রিকেট সংস্থা বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে দেখে ডাকতে বাধ্য হন।
রোববার দুপুর তিনটে থেকে অনুষ্ঠেয় মুম্বইয়ের মহাতাৎপর্যপূর্ণ বৈঠকে বিরোধীদের স্ট্র্যাটেজি খুব পরিষ্কার— শ্রীনির বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অনাস্থা প্রস্তাব এনে তাঁকে শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির সামনে নিয়ে যাওয়া। আর তাঁর বিরুদ্ধে গৃহীত প্রস্তাবগুলো এফিডেবিট করিয়ে মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে নিয়ে ফেলা। যে দিন শ্রীনি মামলার নতুন শুনানির দিন ঠিক আছে। বিরোধীদের উদ্দেশ্য ধরতে পেরে শ্রীনি পাল্টা চাল দেন। সচিবের মাধ্যমে বলে পাঠান বৈঠক হবে সোমবার বিকেলে। যাতে মঙ্গলবার সকালের আগে সভায় গৃহীত প্রস্তাব এফিডেবিট করে সুপ্রিম কোর্টে জমা দেওয়ার সময় না থাকে। কিন্তু বিরোধীদের সমবেত আপত্তিতে তা ধোপে টেকেনি। এমনকী শ্রীনির নিজের অত্যন্ত পছন্দের শিবলাল যাদব বলতে থাকেন, সভা ডাকতে হবে। আইপিএলের পর শিবলালই বোর্ডের অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন। তাঁর কথা অগ্রাহ্য করতে পারেননি বোর্ড সচিব।
শ্রীনির বিরুদ্ধে তীব্র অনাস্থাসূচক প্রস্তাব আনা ছাড়াও বিরোধীদের লক্ষ্য হবে তাঁর আইসিসি অভিযান বিফল করা। ওয়ার্কিং কমিটিতে এমন প্রস্তাব আনা যে, এই লোককে আমরা আইসিসি-তে ভারতীয় প্রতিনিধিত্ব করতে দেব না। আগামী ক’দিনে এমন কিছু হতে পারে আন্দাজে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মহলেও গুঞ্জন ছড়িয়ে যায়। কলম্বোতে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট কর্তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসে যান। আইসিসি-তে শ্রীনি-মডেল মেনে নিলেও বাংলাদেশের মতোই শ্রীলঙ্কাতেও এই নিয়ে ক্রিকেট মহলে তীব্র ক্ষোভ রয়েছে যে, ভারতকে কেন দাদাগিরি করতে দেওয়া হচ্ছে? কেন বিশেষ তিনটে দেশ আইসিসিতে বাড়তি সুবিধা পাবে? সেই ক্ষোভের টার্গেট যেহেতু শ্রীনি, রোববারের বৈঠক নিয়ে তাই কলম্বো থেকে লাহৌর, ঢাকা থেকে কুয়ালা লামপুর একই রকম আলোড়িত।
সকলেরই প্রথম জিজ্ঞাস্য, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার সাহস দেখালেন ভারতের কোন কোন ক্রিকেট কর্তা? যতদূর জানা গেল, শ্রীনির বিরুদ্ধে সভা ডাকতে চেয়ে চিঠি দিয়েছে সবার আগে ললিত মোদীর রাজস্থান। তার পর বিদর্ভ, মুম্বই, পঞ্জাব, মহারাষ্ট্র, গোয়া, কর্নাটক, সৌরাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, হায়দরাবাদ, গুজরাত। পূর্বাঞ্চলের কোনও রাজ্য এই বিরোধী তালিকায় নেই। জগমোহন ডালমিয়ার সিএবি-ও না।
শ্রীনি সমর্থকেরা এখনও মনে করেন, মোট ভোট যেখানে ৩১, সেখানে এগারো জন সদস্যের চিঠি চূড়ান্ত নির্ণায়ক নয়। শ্রীনি এখনও অঙ্কের হিসেবে আগে। বিরোধীরা পাল্টা বলছেন, ওয়ার্কিং কমিটিতে তো আর একত্রিশ জন থাকবে না। সেটা ২৪ জনকে নিয়ে। আর সেখানে সংখ্যাধিক্য বিরোধীদের। সিএবি আর এনসিসি যেমন চিঠি লেখায় সামিল না হয়েও নীতিগত ভাবে বিরোধীদের সঙ্গে।
বিষ্যুদবার ফোনে দীর্ঘক্ষণ কথা হয় ডালমিয়া আর শশাঙ্ক মনোহরের। এই কথা হওয়াটা অসম্ভব তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, তারপর রাতে ডালমিয়া একটা বিবৃতি দেন। তাতে বলা, ‘আমি সুখী যে শেষ পর্যন্ত শুভবুদ্ধির উদয় হয়ে ওয়ার্কিং কমিটির সভা ডাকা হয়েছে। কারণ পরিস্থিতি এতই গুরুতর যে কিছু বিষয় আলোচনা না হলেই নয়। কোনও সন্দেহ নেই যে সাম্প্রতিক ঘটনায় বোর্ডের ভাবমূর্তি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভারতীয় ক্রিকেট জনতার সামনে সেই ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব বোর্ডকেই নিতে হবে।’
বিবৃতির অর্থ খুব পরিষ্কার যে, এগারো বিরোধীর সঙ্গে সিএবি এবং এনসিসি-ও যুক্ত হল। অর্থাৎ তেরো এখানেই হয়ে গেল। রাতে এক ক্রিকেটকর্তা বললেন, “প্রকাশ্যেই যদি তেরো হয়, আড়ালে আরও চার-পাঁচটা ভোট থাকবেই থাকবে। আর ম্যাজিক নাম্বার তো ষোলো।”
সবাই জানত শ্রীনি নাটকের পরের পর্দা উঠবে মঙ্গলবার নয়াদিল্লির সুপ্রিম কোর্টে। বৃহস্পতিবার দিনটা যে আচমকা বিরোধীদের পাওয়ার প্লে হয়ে দাঁড়াবে কেউ কল্পনাও করেনি। নাটকীয় পট পরিবর্তনে শ্রীনির পরের তাস কী, বিরোধীরা আন্দাজের বিশেষ চেষ্টা করছেন না। তাঁদের মতে, কিস্তি মাত হল বলে।
এটা কি আত্মতুষ্টি? অতীতের মতো শ্রীনি পিছলে যাবেন? কেউ জানে না। তবে রোববার ক্রিকেটমহল মুম্বইয়েই আইপিএল দেখবে। আমিরশাহিতে নয়।