যেন টিম ২০০৭। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অপ্রতিরোধ্য ধোনির ভারত। ছবি: এপি।
মহেন্দ্র সিংহ ধোনির কোনও দিনই খুব ভক্ত নন। ক্রিকেটবাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত। ভারতীয় ক্রিকেটমহলের এমন কেউ শনিবার রাতে দুই বন্ধু ক্রিকেটারের সঙ্গে ধোনির ঘরে ঢুকেছিলেন। গিয়ে দেখেন, সেখানে যুবি-সহ পরের পর ক্রিকেটারের জমায়েত। দুর্নিবার আড্ডা, হাসি, গান চলছে। একটা বড় হুঁকো রাখা। ক্রিকেটাররা কেউ কেউ সেই গড়গড়াটায় সুখটান দিচ্ছেন। দেখে কে বলবে ভারতীয় ক্রিকেট বিশাল গৃহযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে!
রোববারের মিরপুর দর্শকের নির্ঘাত মনে হয়েছে, অ্যাসেজজয়ী অস্ট্রেলিয়াকে পরে বল করেও ভারত যে ভাবে মাত্র ৮৬ অলআউট করে দিল। একচেটিয়া আধিপত্যে ৭৩ রানে জবাই করল, সেটা অবিশ্বাস্য। ধোনির ঘর সফরকারী ভদ্রলোকের অবশ্য মনে হয়েছে তার চেয়ে অনেক অবিশ্বাস্য ভারত অধিনায়কের ঘরে যে টেনশনহীন, কলেজ ক্যান্টিন মার্কা পরিবেশ তিনি দেখে এলেন!
সোনারগাঁও হোটেলের চারতলায় ধোনির ঠিক পাশেই লজিস্টিকস ম্যানেজার সতীশের ঘর। কাল রাত্তির থেকেই ভারতীয় প্রশাসনিক শিবিরে সতীশকে নিয়ে কানাকানি। মিডিয়া রিলিজ মাঝরাতে দেওয়া হলেও, ন’টা নাগাদ ঠিক হয়ে গিয়েছে, ইন্ডিয়া সিমেন্টস চাকুরে সতীশকে কোর্টের নির্দেশে ফিরে যেতে হবে। অথচ ঠিক পাশের ঘরে তার কোনও রেখাপাত নেই। অধিনায়ক নিজে একবারের জন্যও প্রসঙ্গটা তুলছেন না। টিমের বাকিদেরও সেই আবেগ আর চাপের হিমশৈলের দিকে যেতে দিচ্ছেন না। “মানতেই হবে মাহির একটা বিশেষ ক্ষমতা আছে আবেগ অ্যাবসর্ব করার। ও সত্যিই স্পেশ্যাল,” বলছিলেন ভদ্রলোক। নামটা অনিবার্য কারণে দিলাম না।
এটা ঘটনা, তার সবচেয়ে টেনশনক্ষত এবং আদালত-বিক্ষিপ্ত সময়ে ভারতীয় ক্রিকেট টিম যে ভঙ্গিতে ডারেন লেম্যানের অস্ট্রেলিয়াকে উড়িয়ে দিল, অনবদ্য। কোনও টিম আবেগবিক্ষিপ্ত, মানসিক বিশৃঙ্খল থাকলে কিছুতেই এই ক্রিকেট খেলতে পারে না। একটা সময় প্রথম ব্যাট করা ভারতকে বেশ বিপন্ন দেখাচ্ছিল। ১১ ওভারে রান তখন ৬৬-৪। জুড়ি কারা? না, এক জন চূড়ান্ত অফ ফর্মে থেকে শেষ সুযোগ পাওয়া যুবরাজ সিংহ। আর এক জন, মাত্র দু’দিন আগে সুপ্রিম কোর্টে মিথ্যে ভাষণের দায়ে অভিযুক্ত তাঁর অধিনায়ক।
রবিচন্দ্রন অশ্বিন টি-টোয়েন্টিতে জীবনের শ্রেষ্ঠ বোলিং হিসেবে চুরমার করে দিলেন ওয়াটসন-ওয়ার্নারদের। কিন্তু খেলাটা তার অনেক আগেই ঘুরিয়ে দিয়েছেন যুবি-মাহি। একটা মাঠের চাপ। একটা মাঠের বাইরের চাপ। তাঁদের আদৌ সেটা ছিল, স্কোরশিট দেখলে কে বলবে! ৪২ বলে এঁরা জুড়লেন ৮৪। স্ট্রাইকরেট দু’শো। যুবি ছ’টা ছক্কার সময়ও এত জনপ্রিয় ছিলেন না যা ক্যানসার-আইকন হয়ে উঠে এখন। এ দিন করলেন ৪৩ বলে ৬০। চারটে ওভার বাউন্ডারি। একটা ঝোড়ো ছক্কায় তাঁর পঞ্চাশ হতেই যেন গ্যালারি ভারতের দিকে ঘুরে গেল। অথচ তার আগে ঢাকার মাঠের জনসমর্থন এমন উগ্র ভারত-বিরোধী যে সময় সময় মনে হচ্ছিল, মেলবোর্নে বুঝি ম্যাচটা হচ্ছে!
ভারত ঠিক করে নেমেছিল টস জিতলেও পরে বল করবে যাতে সেমিফাইনালের জন্য প্রস্তুতিতে আরও কঠিন মাজাঘষা হয়। টস হেরে তাই করতে হল এবং তাতেও এত নিরঙ্কুশ জিতল! এর আগে পাকিস্তানও অনায়াসে হারিয়েছে বাংলাদেশকে। কিন্তু গ্রুপ লিগে যে ভাবে ভারত টানা চার ম্যাচ জিতল, তার সঙ্গে হাফিজের পাকিস্তানের কোনও তুলনাই হয় না।
বাংলাদেশি উইকেটের জন্য ধোনির টিমকে এত গোছানো লাগছে যেন একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। ম্যাচে যখন যা দরকার, তার জন্য যেন আলাদা আলাদা সেকশন রয়েছে! ধোনি নিজে করলেন ২০ বলে ২৪। কিন্তু ক্রিজে এমনই শরীরী ভাষা তাঁর যা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, কোনও কিছুই চাপ নয়। কোনও কিছুতেই আমি ঘাবড়াই না। সেমিফাইনালের দক্ষিণ আফ্রিকা (যাদের সামনে পড়ার সম্ভাবনাই বেশি) আরও কঠিন প্রতিপক্ষ। কিন্তু ভারত যে ভাবে প্রাক ৩১ মার্চ গ্রুপ লিগ ‘বার্ষিক’ হিসেব মেটাল সেটা শ্রীনি এবং তাঁর বিরোধীদের একসঙ্গে বসে হাততালি দেওয়ার মতো! বলে অশ্বিন। সামগ্রিক পরিকল্পনায় ধোনি। সব মিলিয়ে যেন সিএসকে শো। অথচ আদিত্য বর্মাদেরও নির্ঘাত সমপরিমাণ বিনোদন দিয়েছে।
পুনশ্চ: সাংবাদিক সম্মেলন শেষ করে ফেরার সময় ধোনির সঙ্গে মাঠের ধারে দেখা হয়ে গেল শেন ওয়ার্নের। ওয়ার্ন উল্টো দিক থেকে পোস্ট ম্যাচ শো করে ফিরছেন। কী কথা হতে পারে এমন একটা ম্যাচ শেষে দু’জনের যেখানে অস্ট্রেলিয়াকে সময় সময় বাংলাদেশ দেখাল? ওয়ার্ন অভিনন্দন জানালেন। ধোনি সেটাকে বিশেষ পাত্তাই দিলেন না। বরং ভারত অধিনায়ক বাইক নিয়ে কথা বললেন। টিপস দিলেন যে, ওয়ার্নের এখনই কোন বাইকটা কেনা উচিত? শুধু আবেগ অ্যাবসর্ব করা নয়। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির শীতল মাস্তানিটাও অভিভূত করার মতো!
স্কোরবোর্ড
ভারত
রোহিত ক মুইরহেড বো হজ ৫
রাহানে ক হাডিন বো বোলিঞ্জার ১৯
বিরাট ক হোয়াইট বো মুইরহেড ২৩
যুবরাজ ক ম্যাক্সওয়েল বো ওয়াটসন ৬০
রায়না ক ফিঞ্চ বো ম্যাক্সওয়েল ৬
ধোনি বো স্টার্ক ২৪
জাডেজা রান আউট ৩
অশ্বিন ন.আ ২
ভুবনেশ্বর ন.আ ০
অতিরিক্ত ১৭
মোট ১৫৯-৭
পতন: ৬, ৪৬, ৫৩, ৬৬, ১৫০, ১৫২, ১৫৮।
বোলিং: হজ ২-০-১৩-১, ম্যাক্সওয়েল ৪-০-২০-১, স্টার্ক ৪-০-৩৬-১, ওয়াটসন ৪-০-৩৬-১, বোলিঞ্জার ৪-০-২৪-১, মুইরহেড ২-০-২৪-১।
অস্ট্রেলিয়া
ফিঞ্চ ক বিরাট বো অশ্বিন ৬
ওয়ার্নার ক রোহিত বো অশ্বিন ১৯
হোয়াইট ক জাডেজা বো ভুবনেশ্বর ০
ওয়াটসন বো মেহিত ১
ম্যাক্সওয়েল বো অশ্বিন ২৩
বেইলি ক কোহলি বো জাডেজা ৮
হজ ক জাডেজা বো অমিত ১৩
হাডিন ক রাহানে বো অমিত ৬
স্টার্ক রান আউট ২
মুইরহেড ক ধোনি বো অশ্বিন ৩
বোলিঞ্জার ন. আ ১
অতিরিক্ত ৪
মোট ৮৬
পতন: ১৩, ১৯, ২১, ৪৪, ৫৫, ৬৩, ৭৫, ৭৯, ৮৩, ৮৬।
বোলিং: ভুবনেশ্বর ৩-০ -৭-১, মোহিত ২-০-১১-১, অশ্বিন ৩.২-০-১১-৪, রায়না ১-০-১৬-০, জাডেজা ৪-০-২৫-১, অমিত ৩-০-১৩-২।
নজিরে নজর
টি-টোয়েন্টিতে ভারত
সর্বোচ্চ মোট রান যুবরাজ ৯৩৯, টপকালেন
গৌতম গম্ভীরের ৯৩২।
সেরা বোলিং অশ্বিন ৪-১১, টপকালেন হরভজন সিংহের ৪-১২।
সবচেয়ে বেশি, টানা ৬ জয়। আগের সেরা ২০০৭-এ টানা ৫ জয়।