অতর্কিত তিন ধাক্কায় ফের চাপে শ্রীনি

গত এক মাস ধরে কোন নামটা নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসনের অপছন্দের তালিকার শীর্ষে? শশাঙ্ক মনোহর? না। ভারতীয় মিডিয়া? কাছাকাছি হল। তবে সঠিক উত্তর নয়। মুকুল মুদগল? একেবারেই তাই! মাত্র দু’দিন আগে বোর্ডের যে কার্যনির্বাহী কমিটির জরুরি সভা শ্রীনিকে একচ্ছত্র সম্রাট হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিল, তার প্রধান স্লোগান ছিল— মুদগল হটাও, বোর্ড বাঁচাও। পরিস্থিতির মহানাটকীয় পট পরিবর্তনে আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে শ্রীনির তীব্র অপছন্দের সেই মুদগলই কি না ফের ক্ষমতার শীর্ষে!

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৪ ০২:৫৩
Share:

গত এক মাস ধরে কোন নামটা নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসনের অপছন্দের তালিকার শীর্ষে?

Advertisement

শশাঙ্ক মনোহর? না।

ভারতীয় মিডিয়া? কাছাকাছি হল। তবে সঠিক উত্তর নয়।

Advertisement

মুকুল মুদগল? একেবারেই তাই!

মাত্র দু’দিন আগে বোর্ডের যে কার্যনির্বাহী কমিটির জরুরি সভা শ্রীনিকে একচ্ছত্র সম্রাট হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিল, তার প্রধান স্লোগান ছিল— মুদগল হটাও, বোর্ড বাঁচাও। পরিস্থিতির মহানাটকীয় পট পরিবর্তনে আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে শ্রীনির তীব্র অপছন্দের সেই মুদগলই কি না ফের ক্ষমতার শীর্ষে!

ভারতীয় ক্রিকেটে সাড়া ফেলে দেওয়া মঙ্গলবারের সকাল-দুপুরে সুপ্রিম কোর্ট যা নির্দেশ দিয়েছে এবং যা মন্তব্য করেছে, তা গত রোববার মুম্বইয়ের ঠিক বিপরীত। সে দিন আনন্দবাজারে কপি শেষ হয়েছিল এই বলে যে, অ্যাডভান্টেজ শ্রীনিবাসন। অথচ এ দিনের পর যা পরিস্থিতি, তাতে বিরোধীরা গেম জিতে নিয়ে সেটের জন্য ব্রেক পয়েন্টের সার্ভ করছেন। সারা দেশের যে জনা চল্লিশেক ক্রিকেট কর্তা সে দিন শশাঙ্ক মনোহরকে এক রকম চক্রব্যূহে ফেলে দিয়েছিলেন, এ দিন তাঁরাই বিস্ফারিত। বলছেন, এটা কী হল? কী ভাবে হল?

মঙ্গলবার সকাল ন’টায় আদিত্য বর্মা যখন সুপ্রিম কোর্টের উদ্দেশে গাড়িতে, তখন তিনিই বলতে গেলে বিরোধীদের লাস্ট উইকেট স্ট্যান্ডিং। মুম্বইয়ের পর বিরোধীরা এমনই হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন যে, আদালতের দিকেও খুব আশাব্যঞ্জক ভাবে তাকিয়ে ছিলেন এমন নয়। তাঁরা ধরেই নিয়েছিলেন শ্রীনি ম্যাচ নিয়ে গেলেন। আর পাঁচ দিনের মতো দুঁদে আইনজীবী হরিশ সালভেও এ দিন আদালত কক্ষে ছিলেন না।

সকালে তবু আদিত্য বর্মা যে ভাবে গজরাচ্ছিলেন, তাতে তাঁকে টেল এন্ডার মনে হচ্ছিল। বলছিলেন, “দক্ষিণেশ্বরে মা কালীকে পুজো দিয়ে এসেছি। ফল হবেই। মা বিহিত করবেন।”

আদিত্য যতই বলুন, মঙ্গলবারের সুপ্রিম কোর্ট ভারতীয় ক্রিকেট প্রশাসনে এ রকম সাড়া ফেলে দেবে কেউ ভাবেনি। মনোহররা তিনটে উদ্দেশ্য নিয়ে বোর্ডের বৈঠকে গিয়েছিলেন, এবং সম্পূর্ণ খালি হাতে সেখান থেকে ফেরেন। কে জানত, আদালত কক্ষেই সেগুলোর ফয়সালা হয়ে যাবে! তিন সদস্যের কমিটি একেবারেই নিরপেক্ষ নয়, এই মর্মে অভিযোগ এনেছিলেন আদিত্য। শুনানি শুরু হয় সকাল সাড়ে দশটায়। সকাল এগারোটার মধ্যে ভারতীয় ক্রিকেট অলিন্দে খবর ছড়িয়ে পড়ে, রবি শাস্ত্রীদের কমিটি নাকচ হয়ে গিয়েছে। কারণ, শাস্ত্রীর সঙ্গে বোর্ডের সম্পর্ক রয়েছে। রাঘবন তামিলনাড়ু ক্রিকেট সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। এবং জয়নারায়ণ পটেল বোর্ডের অর্ন্তবর্তিকালীন প্রেসিডেন্ট শিবলাল যাদবের জামাইবাবু।

আদালত এই সময় বিচারপতি মুদগলকেই অনুরোধ করে, তিনি যদি আইপিএল তদন্তের ভার নেন এবং আরও বেশি ক্ষমতার সঙ্গে। যেখানে তিনি পুলিশ এবং সিবিআই বা অন্য যে কোনও তদন্তকারী সংস্থার সাহায্য প্রয়োজনে নিতে পারবেন। দুপুর দু’টোর মধ্যে আদালত মুদগলকে সিদ্ধান্ত জানাতে বলে। আর এই মাঝখানের সময়েই চাঞ্চল্য শুরু হয়ে যায়। মুদগল কি নেবেন? না প্রত্যাখ্যান করবেন?

রানি মুখোপাধ্যায়ের যে আদিত্য চোপড়ার সঙ্গে একদিন না একদিন বিয়ে হবে, তা নিয়ে কোনও সাসপেন্স ছিল না। প্রিয়ঙ্কা বঢরা যে প্রচারে এসেই সাড়া ফেলবেন, তা নিয়েও নয়। ডেভিড মোয়েস যে কোনও না কোনও দিন ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের কোচের পদ থেকে বরখাস্ত হবেন, সেটাও অবশ্যম্ভাবী ব্যাপার ছিল। কিন্তু গত ক’দিন ধরে বোর্ডের অলিন্দে তীব্র ধিকৃত মুদগল যে শাসনের রাশ ফেরত পাবেন আর শ্রীনির আইসিসি যাত্রা সম্পর্কে তীব্র মম্তব্য করবেন বিচারপতিরা, এটা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। আগামী মঙ্গলবার মামলার চূড়ান্ত শুনানি। সে দিন জানা যাবে শ্রীনির আইসিসি যাওয়া হবে কি না। এ দিন আইনজীবী নলিনী চিদম্বরম আদালত কক্ষে বলেন, ‘‘স্যার যে লোকটা হাইকোর্টে জজ হতে পারছে না, আইনে আটকে যাচ্ছে, সে কী করে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হয়?’’ বিচারপতি তখন বলেন, ‘‘ঠিক, ঠিক।’’ আর বলেন, ‘‘সত্যিই তো ওঁর আইসিসি যাওয়া উচিত নয়।’’

এই সময় বোর্ডের কৌঁসুলি সুন্দরম বলতে থাকেন, ‘‘স্যার এটা করবেন না, এটা করবেন না। ওঁকে আইসিসি যাওয়া থেকে আটকাবেন না।’’ বিচারপতিরা তখন তাঁকে বলেন, ‘‘মিস্টার সুন্দরম আপনি কি শ্রীনিবাসনের উকিল? না ভারতীয় বোর্ডের উকিল? সেটা তো বোঝা যাচ্ছে না।’’ বিষয়টা আগামী মঙ্গলবার নিষ্পত্তি করবেন, তীব্র ব্যঙ্গের সঙ্গে জানিয়ে দেন বিচারপতিরা। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটমহলে সাড়া পড়ে গিয়েছে যে, এর পর শ্রীনির আইসিসি যাওয়াটা বোধহয় আটকে গেল।

দুপুর দু’টো নাগাদ মুদগল জানিয়ে দেন, তিনি রাজি আছেন। নাটক আরও জমে যায়। এই সময় অনেকে মুদগলকে বলেন, আপনার দুই সদস্যের কমিশনে রদবদল করতে হবে। আপনার কমিশনের অন্যতম সদস্য নিলয় দত্ত তো সুনীল গাওস্করের আমন্ত্রণে ইতিমধ্যে আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিলে যোগ দিয়েছেন। ফলে তাঁর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। তিনি কী করে থাকতে পারেন?

এই মুদগল নিয়েই শ্রীনি শিবিরের একাংশ অবহেলার সুরে বলেছিলেন, ওর উপরেই একটা ভিডিও তৈরি করে আদালতে দেখাব! কেউ কেউ এমনও বলেছিলেন, বোর্ডের তদন্ত কমিটি হলে ওই লোকটাকে প্রথমেই জেরা করতে ডাকো। তদন্ত কমিটিতে কার কার নাম যাবে সেই প্রশ্ন ওঠায় হরিয়ানার শীর্ষ কর্তা বলেছিলেন, “ও নাম আর কী আছে? করিনা, প্রিয়ঙ্কা আর দীপিকাকে করে দিলেই তো হয়!” যা শুনে সে দিন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন মনোহর। এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে এরা বলছে কী! এমন কথাও সে দিন শোনা গিয়েছিল যে, সুপ্রিম কোর্টে পেশ হওয়া অডিও রিপোর্টের কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। জমা দেওয়া বন্ধ খাম নিয়েও ভাবা উচিত। পরিস্থিতি একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যাওয়ার দিনে আদালত জানাল, সবই ঠিকঠাক রয়েছে। এমনকী শ্রীনির কৌঁসুলি সওয়াল করেছিলেন, শুনানি হোক রুদ্ধদ্বার। তদন্তের স্বার্থে মিডিয়াকে কোনও কিছু না জানিয়ে। মিডিয়া যেন আদালতে কী হচ্ছে, কিছুই লিখতে না পারে। বিচারপতি এটাকে একেবারে নস্যাৎ করে দিয়ে বলেন, “মার্কিন আদালতে অনেক বড় বড় ব্যাপারেও মিডিয়ার উপরে নিষেধাজ্ঞা হয়নি। তা হলে এখানে হবে কেন?”

সুতরাং মঙ্গলবারের স্কোরশিট দেখাচ্ছে শ্রীনির ত্রিদফা হার।

মনমতো তদন্ত কমিটি চেয়েছিলেন। পেলেন না। উল্টে অপছন্দের লোক ঘাড়ে চাপল।

আইসিসিতে অবাধে যেতে চেয়েছিলেন। সাত দিনের নিষেধাজ্ঞা হয়ে ব্যাপারটা পুরো মেঘে ঢেকে গেল।

মিডিয়াকে আদালত বিবরণী লেখা থেকে বিরত করতে চেয়েছিলেন। সেটাও পারলেন না।

শশাঙ্ক মনোহর সম্পূর্ণ কোণঠাসা হয়ে সে দিন ১-১৪ ভোটে হারার পর অনেকেই গভীর দুঃখের সঙ্গে বলেছিলেন, আমাদের দেশে এ রকমই হয়। এখানে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। কে জানত, আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে কথাগুলো এমন উল্টে যাবে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement