স্মৃতি: ২০১১ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে জয়ের পরে যুবরাজের উচ্ছ্বাস। ফাইল চিত্র
দেশের মাটিতে ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক। ২০০৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও ভারতকে কাপ জেতানোর অন্যতম কারিগরও তিনি।
ভারতের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার সেই যুবরাজ সিংহ সোমবার অবসর নিলেন সব ধরনের ক্রিকেট থেকেই। তবে বিদেশের ক্রিকেট লিগে নিজের খেলার সম্ভাবনা জিইয়ে রেখেছেন তিনি। ভারতীয় ক্রিকেট থেকে যুবরাজ অবসর নিলেও স্মরণীয় হয়ে থাকবে তাঁর লড়াই।
এ দিন মুম্বইয়ে অবসর ঘোষণা করতে আবেগপ্রবণ যুবরাজ বলেন, ‘‘এটাই সরে যাওয়ার সেরা সময়। মা ও স্ত্রী-র সঙ্গে কথা বলেছি। বাবাও দিন কয়েক বললেন এ বার ছাড়তে পারি। সচিন, হরভজন, সহবাগদের সঙ্গেও কথা বলেছি।’’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘‘ক্রিকেট আমাকে শিখিয়েছে লড়াই, জয় পেয়েও সংযত থাকা, ব্যর্থতা সামলানো, চূর্ণ হয়েও ফের মাথা উঁচু করে উঠে দাঁড়ানো। খেলতে গিয়ে ব্যর্থতাই এসেছে বেশি। কিন্তু আমি কখনও হাল ছাড়িনি। ছাড়বও না।’’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘‘ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের কাউকেই বলিনি যে বিদায়ী ম্যাচ চাই। বলা হয়েছিল, ইয়ো ইয়ো টেস্টে পাশ করতে না পারলে আমার বিদায়ী ম্যাচ আয়োজন করা হবে। জবাব দিই, ইয়ো ইয়ো টেস্টে পাশ করতে না পারলে নিঃশব্দেই বাড়ি চলে যাব।’’
ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যুবরাজ বলে দেন, ‘‘গত বছরেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এ বছরের পরে আইপিএল খেলব না। এ বার বিদেশের টি-টোয়েন্টি লিগে খেলতে পারি।’’ যোগ করেন, ‘‘এই বয়সে এসে আইপিএলের মতো বড় প্রতিযোগিতার চেয়ে বিদেশে ‘ফান ক্রিকেট’ খেলে বাকি জীবনটা উপভোগ করতে চাই।’’
২০১১ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পরে ক্যানসারকেও হারিয়েছিলেন এই ক্রিকেটার। সুস্থ হয়ে ভারতীয় দলে ফিরলেও স্থায়ী হতে পারেননি। শেষ টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলেন পাঁচ বছর আগে। ২০১৭ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলা টি-টোয়েন্টি ম্যাচই দেশের হয়ে শেষ ম্যাচ যুবরাজের। এ বছর আইপিএল চ্যাম্পিয়ন মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে চার ম্যাচ খেলেছিলেন যুবি।
দেশের হয়ে ৪০টি টেস্ট ও ৩০৪টি ওয়ান ডে ও ৫৮টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন যুবরাজ। টেস্টে তাঁর রান ১৯০০। যার মধ্যে তিনটি শতরান। ওয়ান ডে ক্রিকেটে ভারতের হয়ে ৮৭০১ রান করেছেন তিনি। সঙ্গে ১১১টি উইকেট। যে প্রসঙ্গে যুবি বলছেন, ‘‘ভাগ্যবান যে ভারতের হয়ে ৪০০টি ম্যাচে খেলতে পেরেছি। দেশের হয়ে যখনই খেলেছি, ঘাম-রক্ত ঝরিয়ে নিজের সেরাটা দিয়েছি। সৌরভের অবসরের পরে টেস্ট দলে যখন নিয়মিত হচ্ছি, তখনই ধরা পড়ল ক্যানসার। ৪০টা টেস্ট খেলেছি দেশের হয়ে। আরও ৪০টা খেলতে পারলে দারুণ হত।’’ টেস্ট দলে নিয়মিত না হতে পারার যন্ত্রণাও ব্যক্ত করেছেন বিদায়বেলায়। যুবরাজের কথায়, ‘‘খেদটা থেকেই যাবে। যখন খেলতাম টেস্ট দলে জায়গা পাওয়াটা খুব কঠিন ছিল। ভি ভি এস লক্ষ্মণ, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, সচিন তেন্ডুলকর, রাহুল দ্রাবিড়, বীরেন্দ্র সহবাগরা তখন দলে নিয়মিত। এখন নিজেকে প্রমাণ করার জন্য কেউ কেউ ১০-১৫টা টেস্ট পায়। কিন্তু আমার সময়ে সেই সংখ্যাটা একটা বা দু’টোর বেশি ছিল না।’’
১৭ বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কেরিয়ারে যুবরাজের সেরা তিন মুহূর্ত ২০১১ সালের বিশ্বকাপে প্রতিযোগিতার সেরা ক্রিকেটার হওয়া। যেখানে তিনশোর বেশি রান করার পাশাপাশি ১৫টি উইকেট নিয়ে নজির গড়েছিলেন যুবি। ২০০৭ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড পেসার স্টুয়ার্ট ব্রডকে ছয় বলে ছ’টি ছক্কা মারা। ২০০৪ সালে লাহৌর টেস্টে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জীবনের প্রথম টেস্ট শতরান করা। ক্রিকেটজীবনে রাজকীয় শাসন থেকে ক্যানসারের বিরুদ্ধে যুবরাজের হার না মানা লড়াই, সমস্ত কিছুর সাক্ষী ছিলেন সতীর্থ সচিন তেন্ডুলকর। যুবির অবসরের দিনে ২০১১ সালের ঐতিহাসিক বিশ্বকাপ হাতে যুবরাজের সঙ্গে নিজের ছবি সচিন পোস্ট করেছেন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ওয়েবসাইটে। সঙ্গে টুইট, ‘‘প্রত্যেকটি মুহূর্তে যখনই দলের প্রয়োজন পড়েছে, তুমি আক্ষরিক অর্থে চ্যাম্পিয়নের মেজাজে নিজেকে মেলে ধরেছ।’’
শুধু মাঠেই নয়। মাঠের বাইরেও যুবরাজের সঙ্গে সচিনের আন্তরিকতা ছিল গভীর। ২০১১ বিশ্বকাপ জয়ের পরেই ক্যানসার আক্রান্ত যুবরাজের লড়াইয়ের সাক্ষীও ছিলেন মাস্টার ব্লাস্টার। সেই সময়ে তিনি বলেছিলেন, ‘‘লন্ডনে ওর সঙ্গে যখন দেখা করতে গিয়েছিলাম, তার আগে স্ত্রী অঞ্জলিকে বলেছিলাম, ওর সামনে গিয়ে কোনও অবস্থাতেই ভেঙে পড়ব না। ঘটনা হল, ওর সামনে গিয়ে আমি কেঁদে ফেলি।’’
সোমবারের টুইটে সচিন লিখেছেন, ‘‘মাঠে এবং মাঠের বাইরে তুমি যে ভাবে উত্থান-পতনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছ, তা অকল্পনীয়।’’ পাল্টা টুইটে যুবরাজ লেখেন, ‘‘মাস্টার তোমার সঙ্গে এতদিন ধরে খেলার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করি। তোমাকে বিশ্বকাপ উপহার দিতে পেরে আমিও কৃতজ্ঞ।’’