ইউসুফ পাঠান নাকি বদলে গিয়েছেন!
নতুন বছরে কেকেআর নিয়ে নতুন ধারণা বলুন। নাইট সমর্থকদের সমর্থনের নতুন ভাষা বলুন। ব্যাপারটা কিন্তু চলছে। মাসখানেক হয়ে গেল, চলছে। ময়দানে। ক্রিকেটমহলে। সমর্থকদের ড্রয়িংরুমে। ব্যাপারটা কিন্তু চলছে।
ইউসুফ পাঠানকে আর দুমদাম চালিয়ে পাঁচ বলের মাথায় চলে যেতে দেখা যাচ্ছে না। বরং শেষ পর্যন্ত থেকে ম্যাচ জিতিয়ে ফিরতে দেখা যাচ্ছে। ‘কবে খেলবে, কবে নয়’—ইউসুফ পাঠানকে ঘিরে এত দিনের নানা রকম মুখরোচক ঠাট্টা-ইয়ার্কির ব্যবহার সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে আর করা যাচ্ছে না। কারণ, প্রায় রোজই তিনি খেলছেন। নারকীয় ভাবে বোলার ওড়াচ্ছেন। আর আশ্চর্য, কিছুতেই দ্রুত আউট করা যাচ্ছে না। তিনটে ম্যাচ কিন্তু হয়ে গেল। আরসিবি। গুজরাত লায়ন্স। পুণে সুপারজায়ান্টস। শনিবার অত চাপ। টিম ৮-২। অশ্বিনের দুরন্ত ঘূর্ণিতে কালঘাম ছুটছে। কিন্তু পাঠান— তাঁকে একটাও সুযোগ দিতে দেখা গেল? ছক্কা মারছেন, কিন্তু সব ক্লিন হিট। আকাশে থেকে ফিল্ডারের হাতে নেমে আসার কোনও ব্যাপারই নেই।
ইউসুফ পাঠান তা হলে সত্যিই বদলে গেলেন? বাহ্যিক ভাবে কতটা, বলা কঠিন। কথাবার্তা তো একই রকম আজও। রবিবার দুপুরে যেমন। টিম হোটেল থেকে আধ কিলোমিটারের মধ্যে এক অনুষ্ঠানে যে ইউসুফ পাঠানকে পাওয়া গেল, তাঁকে দেখলে কোনও চমক মনে হবে না। গত রাতে টিম ৮-২, কী ভাবছিলেন? বল পড়ামাত্র ‘আউট অব দ্য পার্ক’— ‘‘কী ভাবব আবার? উইকেট পড়া-টড়া নিয়ে ভাবিনি। নিজের খেলাটা খেলেছি!’’ স্টিভন ফ্লেমিংয়ের ডিআরএস নিয়ে গজগজের প্রসঙ্গ উঠল আর পরিণাম এক। মাঠের বাইরে। পরিষ্কার বলে দিলেন, ও সব নিয়ে ভাবা তাঁর ভাবনা নয়। ‘‘আমার কাজ ব্যাট করা। আমি সেটা করি। ডিআরএস নিয়ে বিশদে জানতে গেলে যিনি বানিয়েছেন, তাঁকে জিজ্ঞেস করতে হবে!’’ বিরাট কোহালি-এবি ডে’ভিলিয়ার্সের জোড়া সেঞ্চুরির রক্তচক্ষু, সেটাও এল। কিন্তু লাভ হল না। টুপি খুলে সেলাম জানিয়েও যেটা বললেন তার নির্যাস, ইডেনের পিচ আলাদা। পরিবেশ আলাদা। খেলাও আলাদা হবে।
কিন্তু ইউসুফ পাঠানের তো কিছু না কিছু বদলেছে। আসলে তাঁর ব্যাটিংটাই বদলে গিয়েছে। বোলারদের নিয়ে অপারেশনের ধরন পাল্টেছে।
‘‘ক্রিকেট আমি প্রচুর খেলেছি। কিন্তু এখন আমি ক্রিকেট নিয়ে রিসার্চ করি। গত এক-দেড় বছর ধরে এটা চলছে। খুঁজে খুঁজে বার করেছি কী ভাবে খেললে আমার পক্ষে আরও সফল হওয়া সম্ভব,’’ কেকেআর টিম হোটেলে বসে বলছিলেন ইউসুফ। একটু পর আবার যোগ করেন, ‘‘আসলে একজন ব্যাটসম্যান কতটা সফল হবে তা কিন্তু অনেকটা নির্ভর করে সে ক’টা ওভার পাচ্ছে তার উপর। প্রথম প্রথম দশ-বারো ওভার করে পেতাম। মাঝে সেটা তিন-চার ওভারে নেমে গেল। নেমেই তখন চালাতে হত। এখন আবার বেশি ওভার পাচ্ছি।’’
কিন্তু পরিবর্তনের ইউসুফকে এতটা সরলীকরণে ফেলার বোধহয় প্রয়োজন নেই। কারণ পরিবর্তন এত সরল ভাবে মোটেও ঘটেনি। বরং গত দু’এক বছরে অক্লান্ত ভাবে দু’টো চেষ্টা করে যেতে হয়েছে পাঠানকে।
এক, অহেতুক ওভার বাউন্ডারির পিছনে দৌড়োব না। যে রানটা দু’টো ছক্কায় আসবে, সেটা তিনটে বাউন্ডারিতেও আসবে। লাভ যেটা হবে তা হল, ঝুঁকি অনেক কমে যাবে। ছক্কা মারতে গেলে যা বাড়ে।
দুই, নেমেই চালানোর দরকার নেই। কিছু খুচরো নাও। স্ট্রাইক রোটেট করো। উইকেটটা গিফট না করে বিপক্ষের মনে আতঙ্ক ছড়াও যে, ইউসুফ এখনও আছে। বিপক্ষকে টেনশনে রেখে শেষে প্রহারে গেলে সে স্রেফ দিশেহারা হয়ে যাবে।
‘‘আমি চাইলে আগের মতো খেলতে পারি। প্রতি বলে ছক্কার জন্য যেতে পারি। আমি জানি যে, এক ওভারে পঁচিশ বা দু’ওভারে পঞ্চাশ তোলার মতো ব্যাটসম্যান খুব বেশি নেই বিশ্বে। যেটা আমি পারি,’’ বলে ফের ইউসুফ যোগ করেন, ‘‘ভাবার কোনও কারণ নেই যে আমি নিজের খেলা পাল্টেছি। পাল্টেছি, নিজের অপারেশন মেথড। ভেবেছি, নিজের খেলাকে কী ভাবে আরও উন্নত করা যায়। খেটেছি। ভাইয়ের (ইরফান) সঙ্গে বসেছি। আপনি যখন একটু অন্য রকম চেষ্টা করবেন, দেখবেন একটা দু’টো স্টেপ এমনিই এগিয়ে গিয়েছেন। আমার নিজেরই এখন মনে হয়, মাঠে অন্য ইউসুফ খেলছে!’’
স্তম্ভিত লাগে শুনলে। ভারতীয় ক্রিকেটের অতীতের তারা। ক্ষয়িষ্ণুই বলা যায়। তবু তিনি পড়ে থাকেন, পড়ে থাকেন নিজের ক্রিকেট-রসায়নগারে। শুদ্ধকরণ করেন নিজের ক্রিকেটীয় ভঙ্গিমার। নীল জার্সি আবার গায়ে উঠবে কি না নিশ্চয়তা নেই, তবু। অবাধ্য বয়সকে চ্যালেঞ্জ করে নতুন প্রতিভা প্রতি বছর উঠে আসে, তবু। দেখলে, শুনলে মনে হয় এই দু’টো মাস। এই দু’টো মাসই যেন তাঁর জীবন, বাকি দশ মাস বেঁচে থাকার জীবনশক্তি। যেখানে ভারতীয় ক্রিকেটের অতীত তারা প্রাণান্ত চেষ্টা করেন একের পর এক ‘সুপারনোভা এক্সপ্লোশনে’ বাকি ক্রিকেট পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিতে।