আমেরের শাপমোচন, ক্রিকেটের ধাত্রীগৃহে অভিনব জয়োৎসব

ঐতিহাসিক লর্ডস টেস্ট জয়কে পাকিস্তান ক্রিকেট শুধুমাত্র একটা কারণের জন্যই বোধহয় চিরকাল মনে রাখতে পারে। ইয়াসির শাহ এবং স্বপ্নের ডেলিভারি সহ তাঁর দশ উইকেট? নাহ্। টেস্ট জিতে উঠে গোটা পাকিস্তান টিমের সর্বাত্মক পুশ আপ, লাফ ও স্যালুটে উৎসবের আবেগস্নান? না, এটাও না।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০১৬ ০৫:০৯
Share:

লর্ডসে ইংল্যান্ডকে চার দিনে হারিয়ে উঠে পাক ক্রিকেটারদের পুশ আপ। (ডান দিকে) কলঙ্কের মাঠে আমেরের সোনার দৌড়। ছবি: এএফপি, রয়টার্স

ঐতিহাসিক লর্ডস টেস্ট জয়কে পাকিস্তান ক্রিকেট শুধুমাত্র একটা কারণের জন্যই বোধহয় চিরকাল মনে রাখতে পারে।

Advertisement

ইয়াসির শাহ এবং স্বপ্নের ডেলিভারি সহ তাঁর দশ উইকেট?

নাহ্।

Advertisement

টেস্ট জিতে উঠে গোটা পাকিস্তান টিমের সর্বাত্মক পুশ আপ, লাফ ও স্যালুটে উৎসবের আবেগস্নান?

না, এটাও না।

তবে কি মহম্মদ আমের? লর্ডসেই যাঁর ক্রিকেটজীবনের পোয়েটিক জাস্টিস খুঁজে পাওয়া?

একদম ঠিক।

ইয়াসির শাহ যে স্পিন-ঘূর্ণিতে ইংরেজ ব্যাটিংকে দু-দু’বার লণ্ডভণ্ড করে ছাড়লেন, তার আক্রোশের পাশে আমেরের কৃতিত্ব কোথাও থাকারই কথা নয়। ’৯৬ সালের পর লর্ডসে প্রথম টেস্ট জয় ঘিরে যে আবেগের ছবি সৃষ্টি হল, তার পাশেও রবিবারের আমের কোথাও থাকেন না। ইয়াসির দশটা উইকেট তুলেছেন দু’টো ইনিংস মিলে। গ্যারি ব্যালান্সকে যে বলটা তিনি করলেন, তা মাইক গ্যাটিংকে করা শেন ওয়ার্নের শতাব্দী সেরা ডেলিভারি মনে পড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু নিখাদ ক্রিকেটীয় পারফরম্যান্সের বাইরেও একটা পৃথিবী থাকে। জীবনের অন্ধকারতম পর্বের সঙ্গে হিসেব মেটানোর একটা ব্যাপার থাকে। মহম্মদ আমের যেখানে স্মরণীয় থেকে যাবেন। তিনটে উইকেট স্রেফ সংখ্যা শুধু, ইতিহাস তো মনে রাখবে ‘কলঙ্কের’ মাঠে তাঁর প্রত্যাবর্তনের দিনটা, অবিশ্বাস্য এক ডেলিভারিতে স্টুয়ার্ট ব্রডকে বোল্ড করে দেওয়ার ওয়াসিম আক্রমের বিমুগ্ধ টুইটটা।

ব্রডকে বোল্ড করার ডেলিভারিটা দেখে আক্রম লিখে ফেলেছেন, আমেরের অবিশ্বাস্য ডেলিভারিটা আমাকে আমার সোনার সময় মনে করিয়ে দিল! পাকিস্তান ক্রিকেটে আক্রমে ছায়া তাঁর মধ্যে দেখেন অনেকে। কোনও সন্দেহ নেই, পাক কিংবদন্তির টুইট আমেরকে খুশি করবে। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি কি ছ’বছর আগের লর্ডসেও ফিরে যাবেন না? যে লর্ডস তাঁর ক্রিকেটজীবন থেকে পাঁচ-পাঁচটা বছর কেড়ে নিয়েছিল। যে লর্ডস মহম্মদ আমের নামটার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিল ‘স্পট ফিক্সিং’ নামের কলঙ্কের শব্দটা। ইয়াসির যদি আজ পাকিস্তান ক্রিকেটকে কোনও এক সঈদ আজমল হারানোর যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিয়ে থাকেন, তা হলে আমের তাঁর ক্রিকেটজীবনের শাপমোচনটাও ঘটিয়ে গেলেন একই মাঠে, ইংল্যান্ড ইনিংসের শেষ উইকেটটা নিজের নামের পাশে রেখে দিয়ে।

লর্ডসে চতুর্থ ইনিংসে ২৮৩ তাড়া করে জেতা খুব সহজ ছিল না। অ্যালিস্টার কুকরা পারলেনও না। টেস্ট হারতে হল ৭৫ রানে। আসলে ইয়াসিরের লেগস্পিন আর আমেরের পেস সামলানো সম্ভব হয়নি ইংল্যান্ডের পক্ষে। প্রথম ইনিংসে ছ’টার পর দ্বিতীয় ইনিংসে চারটে উইকেট নেন ইয়াসির। তার মধ্যে ব্যালান্সকে করা ডেলিভারিটা বাঁ হাতি ব্যাটসম্যানের অফস্টাম্পের বাইরে পড়ে লেগস্টাম্প নিয়ে চলে যায়। লেগস্টাম্পের বাইরে ফেলে গ্যাটিংয়ের অফস্টাম্প যেমন নড়িয়ে দিয়েছিলেন ওয়ার্ন। ভাবা যায়, মাত্র চার দিনে লর্ডস টেস্ট শেষ করে দিল পাকিস্তান!

ইয়াসির স্বাভাবিক কারণেই ম্যাচের সেরা নির্বাচিত হয়েছেন। আল্লাহ্-কে ধন্যবাদ দিয়ে ইয়াসির বলে গেলেন, ‘‘লর্ডসে আমার প্রথম টেস্ট ছিল। সেখানে এমন পারফরম্যান্স করতে পেরে খুব ভাল লাগছে। আমি আমার পারফরম্যান্স টিমকে উৎসর্গ করছি। প্রথম দিকে উইকেট থেকে তেমন টার্ন পাচ্ছিলাম না। লাইন লেংথের উপরেই জোর দিয়েছিলাম। ভাগ্য ভাল বলতে হবে যে, প্রথম ইনিংসে অতগুলো উইকেট পেয়েছি।’’ মিসবা-উল-হক—তিনিও বললেন। বিয়াল্লিশ বছরেও যাঁর অসাধারণ টেস্ট সেঞ্চুরি করে যেতে অসুবিধে হয় না। বললেন, ‘‘টিমের জন্য অসম্ভব গর্ব হচ্ছে। ক্যাপ্টেন হিসেবেও এটা আমার কাছে অসাধারণ একটা জয়।’’

পাকিস্তানের প্রাক্তনরাও উচ্ছ্বসিত। যেমন আজহার মেহমুদ টুইট করলেন, দুর্দান্ত টিম এফর্ট। সেলিব্রেশনটাও দেখার মতো। আর শাহিদ আফ্রিদি লিখে ফেললেন, ‘‘ইংল্যান্ডের মাঠে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে সমালোচকদের মুখের উপর জবাব দিল পাকিস্তান। ওয়েল ডান বয়েজ। তোমাদের জন্য গর্ব হচ্ছে।’’ বলছেন কুমার সঙ্গকারাও, ‘‘কী দুরন্ত জয় পাকিস্তানের! এই জয় দেখার অভিজ্ঞতা অসাধারণ। ইংল্যান্ড প্রায় উড়ে গেল। কুর্নিশ। এ বার পুশ-আপের পালা।’’

শুধু আমেরকে কিছু বলতে শোনা যায়নি। ম্যাচ শেষে তাঁর কিছু বলার ডাকও পড়েনি। যদিও ডাকাই যেত। কিছু বলতে অনুরোধ করাই যেত।

ইয়াসির পৌনে দু’বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটজীবনে যে স্পিন–সম্মোহন দেখাচ্ছেন, তাতে ভবিষ্যতে এমন দশ উইকেট তাঁর হয়তো আরও আসবে। মিসবা— তিনিও ক্রিকেট-সায়াহ্নে পৌঁছে হয়তো আরও কিছু বিস্ময় সৃষ্টি করবেন। কিন্তু কলঙ্ক-অপমানে শরবিদ্ধ এক ক্রিকেটারের শাপমোচনের দিন— তা রোজ রোজ আসবে তো?

সংক্ষিপ্ত স্কোর: পাকিস্তান ৩৩৯ ও ২১৫। ইংল্যান্ড ২৭২ ও ২০৭ (ইয়াসির ৪-৬৯, আমের ২-৩৯, বেয়ারস্টো ৪৮)।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement