তাঁকে দেখা মাত্রই ছুটে এল ইতালিয়ান পুলিশের গোটা টিম। নিরাপত্তার কঠিন কাঁটাতারে মহানায়ককে ঘিরে ফেলার ফাঁকে আবদার, একটা ছবি তুলবেন প্লিজ?
রোম বিমানবন্দরে ওই মহিলা কোথায় ছিলেন কে জানে! আর্জেন্তিনীয় ফুটবল-ঈশ্বরকে দেখামাত্র হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। একটা ছোট ব্যাগ এনেছেন, দিতে হবে। ওটা উপহার। ফুটবল-ঈশ্বরের সদ্যোজাতের জন্য। মাতেও-র জন্য।
ভিড়ে ঠাসা সাংবাদিক সম্মেলনে প্রশ্নটা শুনে একটা অসাধারণ উত্তর দিলেন বার্সেলোনা কোচ। লুইস এনরিকে-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনার কোচিংয়ে খেলা ফুটবলারদের মধ্যে কি মেসিই সেরা? শুনে বার্সা কোচের উত্তর, ‘‘আমার কোচিংয়ে তো বটেই। মেসি ইতিহাসের সেরা!’’
প্রত্যেক মানুষের জীবনেই কোনও না কোনও স্বপ্নের মাইলস্টোন থাকে। যা সে কখনও ছোঁয়, কখনও ছোঁয়ার স্বপ্নে ছোটে। অভীষ্ট লক্ষ্যপূরণের আবেগটাও আলাদা হয়। কিন্তু সেটা সাধারণের জীবনে। অ-সাধারণের ব্যক্তিগত মাইলফলক কখনও ব্যক্তিগত থাকে না। ওটা সার্বজনীন। আনন্দ মুহূর্তে ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়ে যায়।
লিওনেল মেসিকে বিমানবন্দরে দেখলে লোকে ছুটে আসবে। ছবি তুলবে। উপহার দেবে। কিন্তু রোম যে ভাবে প্রতিনিয়ত তাঁকে ঘিরে মায়াবী ফ্রেম রচনা হয়ে চলেছে, সেই আবেগের ছবিটা একটু আলাদা। একটু অন্য রকম। বুধবার দিনটাও যে তাই। একটু অন্য রকম।
লিওনেল মেসি আজ সেঞ্চুরি করবেন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ম্যাচের সেঞ্চুরি।
একশো ম্যাচ যখন, দর্শকের প্রত্যাশা যে চূড়োয় পৌঁছবে, না বললেও চলে। লিও-র ফর্ম দেখলে বাড়বে, আশ্বস্তও লাগবে যে বড় কিছু একটা আসছে। রোমার বিরুদ্ধে যে লিও মেসি নামবেন, তিনি মাত্র ক’দিন আগে আটলেটিকো মাদ্রিদের বিরুদ্ধে রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে নেমে গোল করে এসেছেন। যা নিয়ে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে রসালো একটা চুটকিও বেরিয়েছে যে, দুর্দান্ত গোলে ফের্নান্দো তোরেস আটলেটিকোকে ম্যাচে ফেরালেও কোচ দিয়েগো সিমিওনের মুখ নাকি গোমড়া ছিল। কারণ সহজ। তিনি লিও মেসিকে ওয়ার্ম আপ করতে দেখেছিলেন!
রুডি গার্সিয়ারও একই অবস্থা হওয়া উচিত। প্রাক্-ম্যাচ তাঁর যে অবস্থান, সেটা সত্যিকারের আতঙ্ক নাকি অ্যাডভান্টেজ মেসি বলে আর্জেন্তিনীয়কে আগাম চাপে রাখার কূটনীতি— নিশ্চিত করে বলা যায় না। রোমা কোচ গার্সিয়া এ দিন বলে রেখেছেন, ‘‘মেসিকে আটকানো নিয়ে ভেবে কী হবে? বিশ্বসেরা ফুটবলারদের নিয়ে কোনও স্ট্র্যাটেজি হয় নাকি?’’ এটা প্রতিভাকে কুর্নিশ হতে পারে। আবার লোক দেখানো অতিরিক্ত বিনয়ও হতে পারে। যা খুশি হোক। মেসির দিকে ম্যাচের আগেই একটা ব্যাপার কিন্তু থাকবে আজ। রোমের স্টাডিও অলিম্পিকো বার্সা রাজপুত্রের পয়া মাঠ। ছ’বছর আগে এখানেই ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতা।
ভুল হল। কেউ কেউ বলছেন, আরও একটা ব্যাপার মেসির দিকে যেতে পারে। তা হল তাঁর মর্যাদায় আঘাতের পরিনাম। লুইস এনরিকে মেসিকে এ দিন উত্তুঙ্গ প্রশংসায় ভরিয়ে গেলেন যেমন ঠিক, তেমন এটাও ঠিক যে আটলেটিকোর বিরুদ্ধে তিনি মেসিকে রিজার্ভ বেঞ্চে রেখেছিলেন। সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যাখ্যাটা হল, শিশুপুত্রের জন্মের সময় বান্ধবীর পাশে থাকতে মেসি বার্সা প্র্যাক্টিসে ছিলেন না। ফিরে এলে এনরিকেও তাই তাঁকে নামাননি। বলাবলি চলছে, কোচের যে সিদ্ধান্ত খুব ভাল মনে নেননি মেসি। ইনিয়েস্তা বলে দিয়েছেন, মেসি রাগ করেননি। বলেছেন, ‘‘না, না ও সব কিছু নয়। লম্বা সফরের পর ওকে একটু বিশ্রাম দেওয়া হয়েছিল। আর দেখাই তো গেল লিও কত বড় প্লেয়ার। ম্যাচের রেজাল্ট যখনই নামুক, পাল্টে দিতে পারে একাই।’’ সবই ঠিক আছে। কিন্তু মেসি এ নিয়ে একটা কথাও বলেননি। এনরিকের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বরাবরই অম্ল-মধুর। অতীতে অনেক বার নানা ব্যাপার নিয়ে লেগেছে। কারও কারও মনে হচ্ছে, বিতর্কের কারণে মুখ খুলছেন না মেসি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এনরিকে নিয়ে তিনি প্রীত। এটাও মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, মেসির ইগোয় আঘাত করলে ফল কোনও দিনই ভাল হয়নি। প্রমাণ— আর্সেন ওয়েঙ্গার। আর্সেনাল কোচ একবার মেসিকে ‘প্লে স্টেশন প্লেয়ার’ বলে ব্যঙ্গ করেছিলেন। পরে ঠিক প্লে স্টেশনের স্টাইলেই ওয়েঙ্গারের টিমকে চার গোল দিয়েছিলেন মেসি! ইতিমধ্যে বলা হচ্ছে, ওয়েঙ্গার সে দিন যেমন হাড়ে হাড়ে বুঝিয়েছিলেন, মহানায়কদের অপমান করলে কী হয়, এ বার সেটা এনরিকেও বুঝবেন। আটলেটিকো ম্যাচ রিজার্ভ থেকে নেমে জিতিয়ে বুঝিয়েছেন, টিমের বস্ কে। রোমার বিরুদ্ধে সেটা আরও বিরাট ভাবে আসছে।
খারাপ কী? এনরিকে-কে ‘চিরকালীন শিক্ষা’ প্রদানের খুনে ইচ্ছেতেই হোক বা নিজের শততম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ম্যাচকে স্মরণীয় করে রাখার খিদে— বুধবার রাতের রোমে লিওনেল মেসি যেটা নিয়েই নামুন, লাভ তো ফুটবলের। লাভ তো বার্সেলোনা সমর্থকদের। এনরিকে না অন্য কিছু, কে দেখতে যাচ্ছে? রোমে রোমা পুড়লেই হল। গোটা কয়েক গোল তাঁর পা থেকে এলেই হল। যে ভাবেই হোক রাতটা শুধু হয়ে যাক ‘স্পেশ্যাল ওয়ান!’
চ্যাম্পিয়ন্স লিগে
এএস রোমা বনাম বার্সেলোনা
রাত ১২-১৫
টেন অ্যাকশন