ফরাসি পতাকা, তেরঙা বেলুন, শিকলিতে সেজে উঠেছে চন্দননগর। নিজস্ব চিত্র।
চার্চের গেটটা খুলে সটান এগিয়ে গেলেন কলুপুকুরের দিলীপকুমার দত্ত। চার্চের ভিতরে রাখা ফ্রান্সের পতাকাটার কাছে দাঁড়ালেন খানিক ক্ষণ।
‘এমবাপে পারবে তো?’ বিড়বিড় করে উঠলেন নিজের মনেই। যেন ’৯৮-এর পর দুই দশকের ‘শাপমুক্তি’র আকুল আবেদন!একা তিনি নন, রবিবার ফাইনালের ভাবনা গ্রাস করেছে গোটা চন্দননগরকেই।
সপ্তদশ শতকে চন্দননগরেই উপনিবেশ গড়েছিল ফরাসিরা। শতকের পর শতক পেরিয়ে বহু জল গড়িয়েছে গঙ্গা দিয়ে, তবু ফরাসি কলোনির ইতিহাস, তার আভিজাত্য আজও ভোলেনি চন্দননগর। ফাইনালের আগে বনেদি কিছু পাড়ায় পা দিলেই তা মালুম হয়। ফ্রান্সের পতাকার রং নীল-সাদা-লাল তেরঙায় ছেয়ে গিয়েছে রাস্তার এধার-ওধার। রং মিলিয়ে বেলুন কিনে সাজানো হচ্ছে পাড়া। রঙিন শিকলি কাগজের চাঁদোয়া ঝুলছে রাস্তায়। এক ঝলক দেখলে মনে হতেই পারে, এ যেন এক টুকরো ফ্রান্স!
আরও পড়ুন: মদ্রিচদের এই অদম্য মনের জোরই ফারাক গড়ে দিয়েছে
চার্চও সাক্ষী ফরাসি ফুটবল আবেগের। নিজস্ব চিত্র।
ঠিক কী উপায়ে ক্রোট ডিফেন্স তছনছ করে দিতে হবে আর কোন কোন সময়ে আনতে হবে মোক্ষম আঘাত— এ সব নিয়েই অক্লান্ত আলোচনায় মজে পাড়ার কলেজ ক্যান্টিন থেকে পাড়ার রক। হাতে গোনা যে কয়েক জন ব্রাজিল-আর্জেন্তিনা নিয়ে আসর মাতাচ্ছিলেন, ফাইনালের আগে মানে মানে তাঁরাও নাম লিখিয়েছেন ফ্রান্স শিবিরে।
চন্দননগর কলেজের ইতিহাস বিভাগের সুদীপ-শুভম-সুব্রতরা এককাট্টা ফাইনালের দিন ফরাসি আধিপত্য নিয়ে। তাদের এ বছরের বাজি এমবাপে, হুগো লরিস। ফরাসি সাহিত্যেরই ছাত্র সৌমাভ। তাঁর সাফ কথা, ‘‘কেন ফ্রান্সকে সমর্থন করব না বলুন তো? এই শহরের সংস্কৃতি, স্কুল-কলেজ প্রায় সবই তো ফরাসি হাতে তৈরি। জানেন, আমি ফরাসি সাহিত্য পড়ি বলে, পড়াশোনার কিছুটা ভর্তুকিও আসে ফ্রান্স সরকারের থেকে।’’
হ্যাঁ, আজও এমনটাই রেওয়াজ চন্দননগরের ফরাসি অধ্যয়নের ক্ষেত্রে। চন্দননগর কলেজ, অরবিন্দ, গঙ্গার ধারের মিশনারি স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাও এই বিষয়ে যেন ফরাসি তারুণ্যের প্রতীক। এখানে ছেলে-মেয়ে ভেদ নেই। সিপিএম-তৃণমূলেও খুব বনিবনা। নইলে কি আর তালপুকুর ধারের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর অজয় ঘোষ সমর্থকদের নিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ফুটবল আলোচনায় মাতেন তাঁরই বিরোধী পক্ষের ভোটারের সঙ্গে! জানিয়ে দিলেন, তাঁর পাড়ায় রবিবারই বসবে প্রজেক্টর। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে মাথায় থাকবে চাঁদোয়া। পাড়ার সকলেই একসঙ্গে সেলিব্রেট করবেন ফ্রান্সের জয়! অরিন্দম চক্রবর্তী, দেবাশিস মুখোপাধ্যায়, সুব্রত পালিতদের উৎসাহে পাড়ার ছেলে অনিন্দ্য ঘোষ বানিয়ে ফেলেছে বিশ্বকাপের রেপ্লিকা।
দেখুন ভিডিয়ো:
আরও পড়ুন: এমবাপে এক আতঙ্কের নাম, মত রিয়ো ফার্ডিনান্ডের
‘‘কিন্তু ভারত তো কবে খেলবে ঠিক নেই!’’ শুনেই ফ্রান্সের, বলা ভাল, জিদানের অন্ধ ভক্ত পাদ্রীপাড়ার তরুণ অধ্যাপক পিনাকী দে রে রে করে উঠলেন, ‘‘আরে, ভারত খেলে না বলেই তো ফ্রান্সকে আজও নিজের দেশ ভাবতে পারি। তবে ভারতেরও জার্সির রং নীল কি না, তাই আশা রাখব অন্তত আমার মৃত্যুর আগে যেন ভারতকেও দেখে যেতে পারি খেলতে। তবে আপাতত শুধু ফ্রান্স ছাড়া আর কিছুই ভাবছি না।’’ পারিবারিক ক্ষেত্রেও ফ্রান্সের ছাপ রেথেছেন তিনি। এইটে পড়া ফুটবল-পাগল ছেলের ডাকনামও রেখেছিলেন ‘জ়িজ়ু’, যা কিনা জিদানেরও ডাকনাম!
পাদ্রিপাড়া থেকে লক্ষ্মীগঞ্জ বাজার— ফাইনালের আগে ফরাসি প্রেমে মাতোয়ারা চন্দননগরের সব প্রজন্ম। লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারের পুরনো ব্যবসায়ী অনুভব দাস সাফ জানালেন, রবিবার বিকেলে দোকান বন্ধ থাকবে। বাজার অঞ্চলে কোনও প্রোজেক্টর লাগানো যায় কি না সেটাও ভেবে দেখছে স্থানীয় বাজার সমিতি।
ইতিহাসকে সঙ্গে রেখে, বর্তমানের আভিজাত্য রাঙিয়ে ফরাসি ভালবাসায় সেজে ওঠা চন্দননগর এখন অপেক্ষায় রবিবার ঘড়ির কাঁটা কখন ঢলে পড়বে আটটা ত্রিশের ঘরে! দেশঁর ছেলেরা ওই সময়েই যে লুঝনিকির সবুজ ঘাসে স্বপ্নের ছুট শুরু করবে!