কালো অন্তর্বাস পরে উইম্বলডনে খেলছেন এলিনা রিবাকিনা। ছবি: রয়টার্স
চারটি গ্র্যান্ড স্ল্যামের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ। অথচ সেই উইম্বলডনেরই সাবালক হতে লেগে গেল ১৪৬ বছর । ১৮৭৭ সালে যে প্রতিযোগিতার জন্ম, তারা ২০২৩ সালে এসে জানাল, এ বার থেকে মহিলা প্রতিযোগীরা সাদা ছেড়ে রঙিন অন্তর্বাস পরে খেলতে পারবেন। ঋতুস্রাবের সময় মহিলারা যাতে নিশ্চিন্ত হয়ে খেলতে পারেন, সেই কারণেই এই সিদ্ধান্ত।
দীর্ঘ দিন ধরেই এই দাবিতে সরব জুডি মারে (ব্রিটেনের মহিলা টেনিস দলের প্রাক্তন অধিনায়ক এবং অ্যান্ডি মারের মা) ও আমেরিকার প্রাক্তন মহিলা টেনিস খেলোয়াড় বিলি জিন কিং। তাঁদের দাবিকে অবশেষে মান্যতা দিল উইম্বলডন। নাকউঁচু সাহেবরা এত দিন ধরে আঁকড়ে ধরে থাকা গোঁড়ামির বর্ম খুলে আধুনিক হল। কিং গত বছর একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘আমাদের সময়ে শুধু সাদা পরে খেলার অনুমতি ছিল। সব কিছু সাদা পরে খেলতে হত। ঋতুস্রাবের সময় অন্তর্বাস নিয়ে মাথা ঘামাতে হত। সব সময় খেয়াল রাখতে হত, কিছু বোঝা যাচ্ছে না তো? দাগ লাগছে না তো? ওই দিনগুলোতে সারাক্ষণ একটা উৎকণ্ঠা থাকত। আসলে আমরা তো মানুষকে বিনোদন দিই। তাই পোশাক নিয়ে বাড়তি সতর্ক থাকতে হত। সব কিছু নিখুঁত আছে কি না, বার বার দেখে নিতে হত।’’
হয়তো এ বার ‘দাগমুক্ত’ হল উইম্বলডন। অল ইংল্যান্ড ক্লাব জানিয়েছে, আর কোনও ছুঁতমার্গ রাখবে না তারা। উইম্বলডনের সিইও স্যালি বোল্টন খানিকটা প্রায়শ্চিত্ত করার ভঙ্গিতেই বলেছেন, ‘‘আমাদের নীতিই হল, প্লেয়ারদের পাশে থাকা। তাদের সুযোগ-সুবিধা দেখা। যাতে সবাই নিজের সেরাটা দিতে পারে। বরাবর আমরা এই মানসিকতা নিয়েই চলেছি।’’ জুডি, কিং ছাড়াও স্বাভাবিক ভাবেই এখনকার খেলোয়াড়দের তরফেও চাপ ছিল। বোল্টনের কথাতেই সেটা পরিষ্কার। তিনি বলেছেন, ‘‘প্লেয়ারদের সঙ্গে আমরা অনেক বার কথা বলেছি। তাদের মতামত নেওয়ার পরে আমরা বিষয়টা নিয়ে অনেক ভেবেছি। শেষ পর্যন্ত আমাদের ক্লাব কমিটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সত্যি বলতে কী, এই সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব একটা কঠিন ছিল না।’’ যদি কঠিনই না হয়, তা হলে সিদ্ধান্ত নিতে ১৪৬ বছর লেগে গেল কেন, তা নিয়ে অবশ্য অল ইংল্যান্ড ক্লাব কর্তৃপক্ষ চুপ।
উইম্বলডনে লাল অন্তর্বাস পরে একবার শুধু পার পেয়েছিলেন সেরিনা উইলিয়ামস। হয়ত তিনি সেরিনা বলেই। উইম্বলডন কর্তৃপক্ষ এতটাই গোঁড়া ছিলেন, ২০১৩ সালে রজার ফেডেরারকে কমলা রঙের সুখতলা ওলা জুতো খুলিয়েছিলেন। তত দিনে ফেডেরারের ৭টি উইম্বলডন-সহ ১৭টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতা হয়ে গিয়েছে। গত বছর ফাইনালে নোভাক জোকোভিচের কাছে হারার পর নিক কিরিয়স লাল টুপি পরে রানার-আপের ট্রফি নিতে গিয়েছিলেন। তাঁকে মোটা টাকা জরিমানা দিতে হয়েছিল। এই কঠোর নীতিই এত বছর ধরে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন সাহেবরা। এখন মহিলাদের ক্ষেত্রে নরম হয়েছেন।
এখনকার খেলোয়াড়েরা যে অন্তর্বাস সংক্রান্ত নিয়ম তুলে দেওয়ার পক্ষে, তা অনেক আগেই বোঝা গিয়েছিল। ব্রিটিশ খেলোয়াড় হেথার ওয়াটসন বলেছেন, ‘‘গত বছর আমাকে ওষুধ খেয়ে নামতে হয়েছিল। কারণ, সাদা ছাড়া অন্য কোনও রঙের অন্তর্বাস পরার অনুমতি ছিল না। চাইনি, আমাকে নিয়ে হাসাহাসি হোক।’’ অস্ট্রেলিয়ার দারিয়া সাভিলে বলেছেন, ‘‘প্রথম প্রথম সব কিছু সাদা পরে খেলতে ভালই লাগত। একটা অন্য রকম ব্যাপার। বন্ধুদেরও সেটা বলছিলাম। কিন্তু কয়েক জন বলল, উইম্বলডন এলে ঋতুস্রাবের কথা ভেবে তারা আতঙ্কে থাকে। আমারও একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমাকে ঋতুস্রাব পিছিয়ে দিতে হয়েছিল। এমনিতেই অনেক কিছু নিয়ে ভাবতে হয়। তাই ঋতুস্রাবের দাগ নিয়ে আর বাড়তি ভাবতে চাইনি।’’
এখন ওয়াটসন ও তাঁর সহ-খেলোয়াড়েরা খুশি। নতুন নিয়ম চালু হওয়ার পরে ওয়াটসন বলেছেন, ‘‘এটা মেয়েদের পারফরম্যান্সে বিরাট তফাত গড়ে দেবে। যত দূর মনে হয়, এ বারও উইম্বলডনের সময়ই আমার পিরিয়ড হবে। কিন্তু গত বারের মতো এ বার আর আমাকে ওষুধ খেয়ে পিরিয়ড পিছিয়ে দিতে হবে না। সত্যিই ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত উইম্বলডনকে অনেকটা এগিয়ে দেবে।’’
উইম্বলডন অনেকটা এগিয়ে গেল নিঃসন্দেহে। কিন্তু এগোতে লাগল ১৪৬ বছর। এর মধ্যে হয়তো অসংখ্য সাভিলে, ওয়াটসনরা খেলে গিয়েছেন, যাঁদের বয়ে বেড়াতে হয়েছে এই অযাচিত মানসিক উদ্বেগ ও সঙ্কোচ। এ বার উইম্বলডনে মহিলা খেলোয়াড়দের কালো এবং আরও বিভিন্ন গাঢ় রঙের অন্তর্বাস পরে খেলতে দেখা যাচ্ছে। ওই কালো রঙেই রয়েছে তাঁদের ‘মুক্তির’ আনন্দ।