নিক কিরিয়স ও নোভাক জোকোভিচ। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ফেসবুক পেজ থেকে
এক
সেন্টার কোর্ট কানায় কানায় পূর্ণ। বেলা তখন দুটো। ঘটনাটা ঘটল টস হওয়ার ঠিক পরে। তিনি টসে জিতে পছন্দের দিক মনস্থ করেছেন সবে। কোর্টের একেবারে মাঝামাঝি, রয়্যাল বক্সের দিকে পিঠ করে, নেটের উপর হাল্কা গা ছুঁইয়ে দু’-এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন, তার পরেই হঠাৎ শুরু করলেন একটা ছোট দৌড়! ছ’ফুট চার ইঞ্চি হিলহিলে শরীরটা এগিয়ে আসছে আমার দিকে মুখ করে। অদ্ভুত সেই দৌড়ের ভঙ্গি। চাবুকের মতো তেজি, টান টান নয়, আবার কোন শ্লথ ভাবও নেই সেই দৌড়ে। বরঞ্চ একটা অন্য রকম বার্তা আছে। ‘ইটস আ গেম ব্রো!’ আজ শুধুই খেলার দিন বন্ধুরা, চিন্তা নয়, শুধু উপভোগ করো এই মুহূর্তগুলোকে।
দৌড়ের একেবারে শেষ পর্বে মুখটা একটু উঁচিয়ে মাঝের গ্যালারির দিকে চাইলেন তিনি। যেখানে আমি বসে আছি অধীর আগ্রহে। এক লহমার জন্য চোখে চোখ পড়ল, আর আমি তাঁকে অচেনা ইথারে পাঠিয়ে দিলাম আমার মনের কথা। জানবেন, এই মাঠে অন্তত এক জন আছে, যে আপনার জন্য গলা ফাটাবে আজ। আপনার দিকেই চোখ থাকবে সারাক্ষণ।
খুব ভাল করে লক্ষ্য করলাম তাঁকে। মাথার চুল মিহি করে কাটা, আমাদের বাচ্চা বয়সের কদম ছাঁটের মতো খানিকটা। টুপিটা পরেছেন ঘুরিয়ে, রোদ আটকানোর আচ্ছাদনটা মাথার পিছনে শোভা পাচ্ছে। ফ্রেঞ্চকাট দাড়িতে একটু গ্যাংস্টার ভাব, যাকে এই শহরের গরিব পাড়ায় বলে ‘ওয়াগওয়ান’ লোকজন! আজানুলম্বিত দু’হাতে সব জায়গায় এই ইমেজের সঙ্গে মানানসই উল্কি।
সোজা হয়ে দাঁড়ালেন তিনি, বিপক্ষের দিকে তাকিয়ে। পিঠের দুটো পাখনার মাঝ বরাবর থেকে ঘাড় অবধি বেশ ঝুঁকে আছে সামনে। আমি তখন বিড়বিড় করে উপদেশ দিচ্ছি, সারা জীবন ঘাড় সোজা রাখার জন্য। সেই সময়, ঠিক সেই সময় তাঁর বাঁ হাতে ধরা বল আলতো করে উপরে উঠে গেল, আর তার উপর নেমে এল ডান হাতে ধরা র্যাকেট। মাঠের ছবিটা পাল্টে গেল সেই মুহূর্ত থেকে। গ্যালারির প্রতিটি কোনা থেকে দর্শকের কলরব শোনা যাচ্ছে। শুধু আমি নই, সবাই তাঁকেই উৎসাহ দিতে চায়। সবাই চাইছে আজ একটু অন্য রকম হোক। এই মনোরম দিনে, পড়ন্ত রোদ্দুরকে সাক্ষী রেখে একটা রূপকথার সৃষ্টি হয়ে যাক এই ৪১ মিটার লম্বা আর ২২ মিটার চওড়া ভূখণ্ডে।
প্রথম সেটটা জিতলেন হেলায়। তখন তূণ থেকে তিনি নামিয়ে আনছেন একের পর এক বিদ্যুত-গতির সার্ভিস। আমরা, মানে মাঠের প্রায় সকলেই, যারা তাঁর সমর্থনে গলা ফাটাচ্ছিলাম, তাদের মনে হতে শুরু করল খেলা হয়তো এবার হাতের মুঠোয়। তিনিও কি সেই ভুল করলেন? নয়ত, এমন মরণপণ যুদ্ধে কেন তাঁর মনঃসংযোগ নষ্ট হবে বার বার। কেনই বা তিনি আন্ডারহ্যান্ড সার্ভিস করার মতো সস্তা চটকের লোভের ফাঁদে পা দেবেন? কেনই বা নিষ্ফলা তর্কে জড়িয়ে পড়বেন আম্পায়ারের সঙ্গে? খেলা চলাকালীন প্রতি বার সার্ভিস করলে তাঁর প্লেয়ার্স বক্সের সবাইকে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে উৎসাহ দিতে হবে। প্রতি বার তিনি ফিরে ফিরে চাইবেন নিজের কোচ আর মনস্তত্ত্ববিদের দিকে। নিজের দাদার দিকেও। যখন তিনি একের পর এক ভুল করছেন, চাইবেন তাঁরা যেন প্রতিনিয়ত তাঁকে আশ্বাস দেন ‘সব ঠিক আছে’। তিনি নিকোলাস হিলমি কিরিয়স। তাঁর এখনও অনেক পথ চলা বাকি।
খেলা শেষ হওয়ার পর কিরিয়স বলেছেন মাঠে অগ্রজের মধ্যে উনি আজ ভগবান দর্শন করেছেন। আর সেই অগ্রজ রবিবার মাঠে খেলার শেষে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, কিরিয়স এই মাঠে ফিরে আসবেন বার বার, অনেক অনেক দূর যাবেন।
নিক কিরিয়স ও নোভাক জোকোভিচ। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ফেসবুক পেজ থেকে
দুই
জয়ের শেষে তিনি মাটিতে নিচু হয়ে বসলেন। যে ভাবে আমরা ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে প্রিয়জনের শরীরে হাত রাখি, অনেকটা সে ভাবে বাঁ হাত দিয়ে ধরিত্রীকে স্পর্শ করলেন। তারপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন সেই ঘাসের গালিচার উপর, যেখানে একটু আগেই তিনি আরও এক বার, এই নিয়ে সপ্তম বার নিজের মালিকানা কায়েম করেছেন। গত চার বছর এখানকার একছত্র অধিপতি যে তিনিই। কয়েক মুহূর্ত শুয়ে থেকে পা দুটি নাড়ালেন অলস ভাবে যেন ঘাসের মাটিতে সাঁতার কাটছেন তিনি। কিন্তু ব্যাস, ওই বিরল দু’-একটা মুহূর্তই মাত্র। জনতা তার মধ্যেই দেখল তিনিও ছেলেমানুষি করতে পারেন অন্যদের মতো! নিজেকে নিমেষে সংযত করে জমি ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। সামনের দিকে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে রিস্টব্যান্ড খুলে হেলায় দান করলেন এক ভাগ্যবান দর্শককে। তারপর গ্যালারি টপকে উঠে গেলেন উপরের দিকে, নিজের প্লেয়ার্স বক্স লক্ষ্য করে।
সমস্ত সেন্টার কোর্ট দেখছে তিনি গভীর আলিঙ্গনপাশে বেঁধে রেখেছেন তাঁর কাছের মানুষদের। যে মানুষগুলো তাঁর জন্য নিবেদিতপ্রাণ। তাঁরা সবাই কি কানে কানে তাঁকে বললেন, একুশটা গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতার পর এখন এক মাত্র রাফা আছেন তাঁর সামনে। তিনি পারবেন আরও এগিয়ে যেতে। তিনি পারবেন নিজেকে এক অবিশ্বাস্য উচ্চতায় তুলে ধরতে। তাঁকে দেখার জন্য, বোঝার জন্য টেনিসের মহাকাল সৃষ্টি করবে নতুন দূরবীন।
প্রথম সেটে হারার আগে আর পরে তাঁর শরীরের ভাষা লক্ষ্য করছিলাম প্রাণপণ। পড়ার চেষ্টা করছিলাম তাঁর মনের কথা। এত সহজে প্রথম সেট হেরে তিনি কি কিঞ্চিৎ বিচলিত? কান পেতে শোনার চেষ্টা করছিলাম যদি টের পাই। হয়ত বা ধমনীতে রক্ত একটু চলকে উঠল যেন। হৃদয়ের লাব-ডুব সংকেত কি একটু গাঢ় হল অকস্মাৎ? চার সেটের খেলায় কিরিয়স এস সার্ভিস করেছেন সম্ভবত ত্রিশ বার। আর উনি? তার অর্ধেক, বা আরও কম! তা হলে কিসের জোরে স্কোরবোর্ডের সংখ্যাগুলো ওঁর পক্ষে গেল?
আসলে উইম্বলডন ফাইনালে টেনিস ততটাই মানসিক দ্বৈরথ, যতটা শারীরিক ক্ষমতা আর উৎকর্ষের প্রতিযোগিতা। আর এখানেই তিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর থেকে অযুত যোজন এগিয়ে ছিলেন খেলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। তার সঙ্গে যোগ করতে হবে অসামান্য শারীরিক ভারসাম্য, দ্রুত বেস লাইন থেকে নেটে পৌঁছে যাওয়ার ক্ষমতা। কিরিয়সের ড্রপ শটগুলো কাজ করল না মোটেই, আর খেলাটা একটু একটু করে চলে গেল তাঁর নাগালে।
আসলে এ বারের ফাইনালে নোভাক জোকোভিচ ছিলেন আগাগোড়া ১০০ শতাংশ নোভাক জোকোভিচ! হিমশীতল। ধীর-স্থির। প্রত্যয়ী। নির্ভুল। প্রতিটি মুহূর্তে নিখুঁত হওয়ার সাধনায় নিমগ্ন। চতুর্থ সেটে এক বার কিরিয়সের শট প্লেসমেন্ট তাঁকে সম্পূর্ণ বোকা বানিয়ে দেওয়ায় দেখলাম চকিতে এক বার তাকালেন তাঁর দিকে প্রশংসাসূচক দৃষ্টি নিয়ে। এক বার হাত জোড় করলেন মুহূর্তের জন্য। কিন্তু ওইটুকুই। তা বাদে সারাটা দুপুর জোকোভিচ খেললেন নিজের বিরুদ্ধে। যাতে উনি শুক্রবারের নোভাককে রবিবার পরাস্ত করতে পারেন নিজেকে আরেকটু উন্নত করার সফল প্রচেষ্টায়। বিশ্বসেরারা যেমন হয়ে থাকেন আর কি।
খেলা শেষ। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আমরা সবে জেনেছি এক নতুন ব্রোমান্সের কথা। দু’জন সম্পূর্ণ ভিন্ন গোত্রের মানুষ, যাঁদের মধ্যে ফারাক রয়েছে একটা মহাদেশ আর এক যুগের, নিজেদের বন্ধুত্বকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। এ বার যে যাঁর পথ ধরবেন। আলোকচিত্রীদের ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর আগে দু’জন পাশাপাশি দাঁড়ালেন রয়্যাল বক্সের দিকে মুখ করে। অগ্রজের হাত অনুজের কাঁধে। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম সেই হাত কিরিয়সকে একটু নিজের কাছে টেনে নিচ্ছেন। দৃষ্টিবিভ্রম নয়, সত্যিই জোকোভিচ তাঁকে একটু নিজের দিকে টেনে নিলেন সেই সময়। ভবিষ্যতের চ্যাম্পিয়নকে আমরা সবাই যেমন একটু কাছে কাছে রাখতে চাই।
রোদ ঢলে পড়েছে এ বার। মাঠ থেকে বেরনোর পালা। অবাক হয়ে আবার দেখলাম আমার পাশের সিটের ব্রিটিশ বৃদ্ধাকে। যিনি খেলা চলাকালীন পুরোটা সময় খেলা না দেখে বাইনোকুলারে চোখ রেখে এক মনে রাজদর্শন করেছেন! ভিড়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে স্টেশনের পথে চলেছি, টিউব ধরে হোটেলে ফিরতে হবে। হঠাৎ মনে পড়ল এই যাহ্, স্ট্রবেরি আর ক্রিম খাওয়া হল না তো! তবে কি পরের বার?