Serena Williams

কেন অবসর? আমেরিকার পত্রিকায় লেখা সেরিনা উইলিয়ামসের কলাম তুলে ধরল আনন্দবাজার অনলাইন

ইউএস ওপেনের আগে সেরিনা উইলিয়ামস জানিয়ে দিয়েছিলেন, বছরের শেষ গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেলেই সরে দাঁড়াবেন। কী বলেছিলেন তিনি?

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৮:৫৮
Share:

অবসরের ইঙ্গিত অনেক আগেই দিয়েছিলেন সেরিনা। ছবি রয়টার্স।

আমেরিকার পত্রিকায় নিজের অবসরের কথা সবার আগে জানিয়েছিলেন সেরিনা উইলিয়ামস। সেই কলামের নির্বাচিত অংশ তুলে ধরা হল:

Advertisement

ইউরোপে যাওয়ার আগে সে দিন সকালে আমি আমার মেয়ে অলিম্পিয়ার পাসপোর্ট করাতে যাচ্ছিলাম। নিজের গাড়িতেই বসেছিলাম। তখন অলিম্পিয়ার হাতে আমার ফোনটা ছিল এবং সেখানে ও শিক্ষা সম্পর্কিত একটা অ্যাপ খুলে দেখছিল। হঠাৎই ফোন থেকে রোবটের মতো একটা কণ্ঠস্বর ওকে জিজ্ঞাসা করল, ‘বড় হয়ে তুমি কী হতে চাও?’ ও জানতো না যে আমি শুনছি। ফিসফিস করে ফোনে ও যে কথাটা বলল, সেটা আমি শুনতে পেয়েছিলাম। ও বলল, ‘আমি একজন বড় বোন হতে চাই।’

অলিম্পিয়া এটা মাঝে মাঝেই বলে থাকে। এমনকি যখন আমি শুনতে পাই তখনও। কখনও কখনও শুতে যাওয়ার আগে প্রার্থনা করার সময় ঈশ্বরকে বলে, ওকে একটা ছোট বোন এনে দেওয়া হোক। ছেলে নিয়ে ওর কোনও আগ্রহ নেই। পাঁচ বোনের মধ্যে আমি সব থেকে ছোট এবং আমার বোনেরা আমার কাছে নায়কের মতো। তাই আমার মনে হয়েছে, এটা এমন একটা আব্দার যা আমার গুরুত্ব দিয়ে শোনা উচিত।

Advertisement

বিশ্বাস করুন, কখনও এরকম পরিস্থিতি চাইনি যেখানে টেনিস এবং পরিবারের মধ্যে যে কোনও একটা আমায় বেছে নিতে হবে। আমার মতে, ব্যাপারটা ঠিক নয়। আমি যদি ছেলে হতাম তা হলে আমাকে এটা লিখতে হত না। তখন আমি কোর্টে নেমে অনায়াসে খেলতে পারতাম এবং জিততাম। পরিবার বাড়ানোর জন্য আমার স্ত্রী অসহ্য শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করত। ছেলে হলে আমি হয়তো টম ব্র্যাডির মতো হতে পারতাম। দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না। মেয়ে হয়ে আমি খুশি। অলিম্পিয়া গর্ভে থাকার সময় প্রতিটা সেকেন্ড আমি উপভোগ করেছি। আমি হলাম সেই মেয়েদের একজন, যে গর্ভবতী হওয়াটাকে ভাল চোখে দেখেছে এবং হাসপাতালে যাওয়ার আগে পর্যন্ত নিজের কাজটা করে গিয়েছে। কিন্তু অন্য দিকে পরিস্থিতি খুবই কঠিন ছিল। অসম্ভবকে সম্ভব করেছি আমি। অনেকেই হয়তো বিশ্বাস করবেন না যে ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জেতার সময় আমি দু’মাসের গর্ভবতী ছিলাম। এই মাসে আমার ৪১ বছর বয়স হচ্ছে এবং এখনও আমার কিছু দেওয়ার আছে।

অবসর কথাটা আমি কোনও দিনই পছন্দ করি না। আমার কাছে এটা মোটেই আধুনিক কোনও শব্দ নয়। আমি বরং এটাকে একটা রূপান্তর হিসেবেই দেখতে চাইছি। কখন কী ভাবে এই শব্দটা ব্যবহার করছি সে বিষয়ে আমি সতর্ক থাকতে চাই। মানুষের কাছে স্পষ্ট একটা বার্তা দিতে চাই। হয়তো আমি যেটা চাইছি, তার সঠিক প্রতিশব্দ হলো ‘বিবর্তন’। আমি আপনাদের জানাতে চাই যে, টেনিসের বাইরেও আমার একটা জীবন তৈরি হচ্ছে। এমন কিছু নিয়ে, যা আমার জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিছুদিন আগে নিঃশব্দে আমি ‘সেরেনা ভেঞ্চার্স’ নামে একটা সংস্থা তৈরি করেছি। তার পরেই পরিবার তৈরি করি। সেই পরিবার এ বার আমি বাড়াতে চাই।

নিজের কাছে এবং বাকি সবার কাছে আমি এখনও স্বীকার করতে রাজি নই যে, আমাকে টেনিস খেলা থেকে দূরে সরে যেতে হবে। আমার স্বামী আলেক্সিসের সঙ্গে এটা নিয়ে খুব একটা কথা হয়নি। বাবা-মায়ের সঙ্গেও এ নিয়ে কথা হওয়ার কোনও উপায় নেই। এটা এমন একটা বিষয় যা চিৎকার করে না বললে হয়তো কেউ সত্যি বলে মেনে নেবে না। যখনই এই প্রসঙ্গ ওঠে, তখনই আমার গলার কাছে একটা অস্বস্তিকর দলার মতো তৈরি হয় এবং আমি কাঁদতে থাকি। একমাত্র আমার থেরাপিস্টের সঙ্গেই এ বিষয়ে কথা বলতে পেরেছি। কোনও ভাবে রেখে ঢেকে এই কথা বলতে চাই না। আমি জানি অনেকেই অবসরের দিকে আগ্রহ ভরে তাকিয়ে থাকেন। খুব ভাল হত যদি আমিও ওদের মতো ভাবতাম। মার্চ মাসে অ্যাশলে বার্টি যখন টেনিস থেকে বিদায় নিল, তখন ও বিশ্বের এক নম্বর খেলোয়াড় ছিল। আমার বিশ্বাস ও অবসর নেওয়ার জন্য মনে মনে তৈরি ছিল। আমার অন্যতম প্রিয় বন্ধু ক্যারোলিন ওজনিয়াকি ২০২০ সালে অবসর নেওয়ার সময় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল।

ওদেরকে অবশ্যই তারিফ করা উচিত। কিন্তু আমি এই ব্যাপারে সৎ থাকতে চাই । এই প্রসঙ্গে কথা বললে আমি মোটেই খুশি হই না। জানি যে ধরনের কথা খুব বেশি মানুষের মুখে শুনতে পাবেন না। কিন্তু আমার মনে খুব ব্যথা হয়। অবসর আমার কাছে এমন একটা জিনিস, যা আমি ভাবতেও পারিনি কোনও দিন ঘটতে পারে। অবসরকে ঘৃণা করি। আমি ভাবতে ঘৃণা করি যে আমার জীবনে এই সময়টা চলে এসেছে। যদি কোনও দিন সামলে নিতে পারতাম, তা হলে খুব ভাল হত। তা হয়নি। এখন যে সময়টা কাটাচ্ছি, চাই না সেটা কোনও দিন শেষ হোক। তবে একই সঙ্গে আগামী দিনে যে সময়টা আসতে চলেছে তার জন্য আমি তৈরি। জানি না এই ম্যাগাজিনটা প্রকাশ হওয়ার পর কী ভাবে এর দিকে তাকিয়ে থাকব। কারণ আমি জানি এর ভেতরে কী রয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার কম্পটনের যে ছোট্ট মেয়েটা শুধু টেনিস খেলতে চেয়েছিল, তারই গল্প এখানে লেখা। এই খেলা আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। আমি জিততে ভালোবাসি। লড়াই করতে ভালোবাসি। বিনোদন দিতে ভালবাসি। আমি জানি না সবাই এ ভাবেই ভাবে কিনা। কিন্তু নিজের খেলা নিয়ে বিশ্লেষণ করতে এবং সপ্তাহের পর সপ্তাহ বিনোদন উপহার দিতে আমি ভালবাসি। মেলবোর্নের হলওয়েতে অপেক্ষা করা, কানে ইয়ারফোন গুঁজে রড লেভার অ্যারেনায় হেঁটে আসা, ম্যাচের মধ্যে ফোকাস করার চেষ্টা, কিন্তু দর্শকদের চিৎকারে সব কিছু হারিয়ে যাওয়া— আমার এগুলো জীবনের অন্যতম সেরা মুহূর্ত। আর্থার অ্যাশ স্টেডিয়ামে রাতের ম্যাচগুলোই বা কী করে ভুলব। সেট পয়েন্টের সময় সেই ‘এস’ সার্ভিস মারা!

এখনও পর্যন্ত আমার গোটা জীবনটাই টেনিসে ভরা। বাবা বলেছিলেন, তিন বছর বয়সে আমি প্রথম বার টেনিস র‌্যাকেট হাতে নিয়েছিলাম। আমার মনে হয়, সময়টা আরও আগে। পুরনো একটা ছবি রয়েছে যেখানে ভিনাস টেনিস কোর্টে একটা স্ট্রলার দিয়ে আমাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। দেখে মনে হয়েছে, আমার বয়স ১৮ মাসের বেশি কোনও মতেই নয়। ভিনাস বরাবরই কঠিন মানসিকতার খেলোয়াড়। কিন্তু আমি কোনও দিন নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারিনি। মনে আছে, কিন্ডারগার্টেনে পড়ার সময় অক্ষর ভাল করে লিখতে পারতাম না এবং সারা রাত ধরে কাঁদতাম। বার বার ইংরেজির ‘এ’ অক্ষরটা লিখতাম আর মুছতাম। বাকি বোনেরা যখন শুতে চলে যেত, তখন আমায় মা সারা রাত জাগিয়ে রাখত। এটাই আমি ছিলাম। সব সময় বিখ্যাত হতে চাইতাম। নিখুঁত হতে চাইতাম। জানি নিখুঁত বলে কোনও শব্দ নেই। কিন্তু আমার কাছে এই শব্দটার অন্য মানে রয়েছে। যত ক্ষণ না সব কিছু ঠিক ঠাক হচ্ছে, তত ক্ষণ আমি থামতে চাইতাম না।

আমার কাছে এটাই সেরিনা হওয়ার আসল অর্থ। নিজের থেকে সেরাটা বের করে আনা এবং লোককে ভুল প্রমাণ করা। এমন অনেক ম্যাচ জিতেছি, যেখানে কেউ আমাকে রাগিয়ে দিয়েছিল অথবা হিসাবে বাইরে ফেলে দিয়েছিল। ওটাই আমার চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করেছে। রাগকে কাজে লাগিয়ে এবং নেতিবাচক মানসিকতাকে ইতিবাচক মানসিকতায় পরিণত করে ভাল কিছু করার চেষ্টা করেছি। আমার দিদি একবার বলেছিল, কেউ যদি তোমায় বলে ‘তুমি এটা করতে পারবে না’, তার মানে হল সে নিজেই ওই কাজ করতে পারবে না। কিন্তু আমি সব কাজ করতে পেরেছি। তাই বিশ্বাস করি অন্য কেউও করতে পারবে।

আপনারা যদি ‘কিং রিচার্ড’ ছবিটা দেখে থাকেন তা হলে জানবেন যে, যখন আমি ছোট ছিলাম তখন খুব একটা ভাল টেনিস খেলতে পারতাম না। ভিনাস যে সুযোগটা পেত, সেটা আমি পেতাম না। মনমরা হয়ে থাকতাম সারা ক্ষণ। পরে এটাই আমাকে চাঙ্গা করে তুলেছিল। কঠোর পরিশ্রম করতে এবং লড়াকু মানসিকতার খেলোয়াড় হিসাবে নিজেকে তৈরি করতে সাহায্য করেছিল। ভিনাসের হিটিং পার্টনার হিসেবে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় যেতাম। সেখানে কেউ খেলতে না এলে তাঁর জায়গায় খেলতাম। গোটা বিশ্বে আমি ভিনাসের সঙ্গে গিয়েছি এবং ওর খেলা দেখেছি। যখন ও হেরে যেত, তখন নিজেই হারের কারণ খুঁজে বের করতাম এবং চেষ্টা করতাম যাতে আমি কোনও দিন ও ভাবে না হারি। এই মানসিকতার কারণে র‌্যাঙ্কিংয়ে এত দ্রুত উত্থান হয় আমার। ভিনাসের প্রতিটা হার থেকে শিক্ষা নিয়েছিলাম আমি। মনে হত আমিই ম্যাচ খেলছি। ছোটবেলায় পিট সাম্প্রাসকে অনুকরণ করে বড় হয়ে উঠেছি। মণিকা সেলেসকে ভাল লাগত। ওর ব্যাপারে অনেক কিছু পড়েছি, দেখেছি এবং শুনেছি। ওর দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে ওকে হারিয়েছি। তবে ভিনাস না থাকত, তা হলে আজ আমি যেখানে আছি, সেখানে কোনও দিন থাকতে পারতাম না। যখন কেউ নেহাতই ভিনাসের ছোট বোন হিসাবে পরিচয় দিত, তখন খুব রাগ হত।

টেনিস খেলার শুরু থেকেই আমার লক্ষ্য ছিল ইউএস ওপেন জেতা। তার বাইরে কোনও দিন ভাবিনি। একটা সময় এল, যখন জিতেই যাচ্ছি। মার্টিনা হিঙ্গিসের গ্র্যান্ড স্লামের সংখ্যা পেরিয়ে যাওয়ার দিনটা আজও মনে আছে। তার পরে সেলেসকে টপকালাম। তার পরে বিলি জিন কিং, যে আমার কাছে অনুপ্রেরণা ছিল। খেলাধুলার জগতে লিঙ্গসাম্য এনে দিয়েছে কিংই। ওঁর পরে ক্রিস এভার্ট, মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা সংখ্যাও টপকে যাই। অনেকেই বলেন, আমি সর্বকালের অন্যতম সেরা নই। কারণ আমি মার্গারেট কোর্টের ২৪টা গ্র্যান্ড স্ল্যামের রেকর্ড পেরিয়ে যেতে পারিনি। ১৯৬৮ সালের ‘ওপেন যুগ’ শুরু হওয়ার আগে উনি এই কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। সেই রেকর্ড আমার লক্ষ্য ছিল না, এটা বললে মিথ্যা বলা হবে। এখনও সেই রেকর্ড আমার লক্ষ্য। তবে যত দিন যাচ্ছে, চেষ্টা করছি সে সব নিয়ে না ভাবতে। আগে ফাইনালে উঠলে রেকর্ডের কথা মনে পড়ত। হয়তো রেকর্ড একটু বেশি ভেবেছিলাম বলেই ওকে টপকাতে পারিনি। নিজেই বলছি, ৩০-এর বেশি গ্র্যান্ড স্ল্যাম পাওয়া উচিত ছিল আমার। মেয়ের জন্মের পরও সুযোগ পেয়েছিলাম। ‘সি-সেকশন’-এর মতো অস্ত্রোপচারের পরেও গ্র্যান্ড স্লামের ফাইনালে উঠি। স্তন্যপান করানোর পর কোর্টে নেমে খেলেছি। সন্তান জন্মের পর যে হতাশা তৈরি হয় (পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন) সেই সময়ের মধ্যেও খেলেছি। কিন্তু ওকে ছুঁতে পারিনি। যে ভাবে আমার খেলা উচিত ছিল সে ভাবে খেলতে পারিনি। তা সত্ত্বেও আমি যে ২৩ বার বিজয়ী হয়েছি, এটাই যথেষ্ট। আমার মতে, অসাধারণ কৃতিত্ব। তবে এই মুহূর্তে যদি আমাকে বলা হয়, টেনিস জীবন এবং পরিবারের মধ্যে কোনও একটা বেছে নিতে, আমি পরেরটাই বেছে নেব।

জীবনের শুরুর দিকে আমি কখনওই ভাবিনি আমার সন্তান হবে। এমনও সময় গিয়েছে, যখন ভাবতাম আদৌ আমি কোনও দিন সন্তানের মা হতে পারব কি না। বিশেষত, আমার শরীরে যে সব সমস্যা ছিল তাতে সন্তান হওয়ার ব্যাপারে কোনও দিনই খুব একটা আত্মবিশ্বাসী ছিলাম না। ভেবেছিলাম, এর পরেও যদি কোনও দিন আমার সন্তান হয়, তা হলে তার সর্ব ক্ষণের খেয়াল রাখার জন্য কাউকে রাখতে হবে। মিথ্যা কথা বলব না, আমার পাশে অনেকে রয়েছে। কিন্তু আমি নিজেও একজন দক্ষ মা, যে সন্তানের খেয়াল রাখতে পারে। আমার স্বামীও সেটা স্বীকার করবে। গত পাঁচ বছরে অলিম্পিয়া আমার থেকে সবচেয়ে বেশি ২৪ ঘণ্টা আলাদা থেকেছে। গত বছরে চোট সারানোর সময় আমি সপ্তাহে ৪-৫ দিন ওকে স্কুল থেকে আনতে যেতাম। স্কুল থেকে বেরিয়ে আমাকে বাইরে অপেক্ষা করতে দেখার পর ওর মুখের হাসিটা দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতাম। অলিম্পিয়াকে দেখলে মনে হয় আত্মত্যাগ আমার জীবনে কিছুই নয়। মা হিসাবে কী ভাবে জুতোর ফিতে বাঁধতে হয়, সেটা ওকে শেখাতে চাই। কী ভাবে পড়তে হয়, কী ভাবে সন্তানের জন্ম হয় সেগুলোও। ঠিক যে ভাবে আমার মা আমাকে শিখিয়েছিলেন। এখন অলিম্পিয়া বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক মাসে আমার ভূমিকা বদলে যায়। সম্প্রতি ও বেকিং নিয়ে উৎসাহ দেখাচ্ছে। আমরা একসঙ্গেই বেকিং করার চেষ্টা করি। এখন আমরা একটা নতুন জিনিস বেকিং করছি। খুব মজা লাগছে করতে। এ ছাড়া, বেশ মজার একটা গেম রয়েছে যেটা ও খেলতে খুব ভালবাসে। সেটা এমন একটা গেম, যেখানে মাটি না স্পর্শ করে যা খুশি কাজ করা যায়। আমার জিমটাকে সেই গেমের মতো করে তৈরি করে নিয়েছি। এখন আমার মেয়ের যেটা ভাল লাগে, সেটা আমারও ভাল লাগে।

আমার মনে হয় টেনিস খেলা অনেক বেশি আত্মত্যাগের কাজ। বরাবরই আমি সেটা করতে ভালবেসেছি। ছোটবেলায় দেখতাম আমার সমবয়সীরা মজা করছে। আমারও ইচ্ছা হত। তখনই মনে পড়ত, আমাকে কোর্টে যেতে হবে। আশা করতাম যে পরিশ্রম করছি, সেটা এক দিন যেন কাজে দেয়। আমার বাবা-মা আমাকে খুব সাহায্য করতেন। এখন অনেকেই বলেন, তোমার ছেলে-মেয়ে যা চায় তাকে সেটাই করতে দাও। আমার জীবনে সেটা হয়নি। ছোটবেলায় আমি প্রতিবাদও করিনি। বরং কঠোর পরিশ্রম করেছি এবং নিয়ম মেনে চলেছি। তবে নিজের ক্ষেত্রে, অলিম্পিয়াকে শুধু টেনিস নয়, যেটা ওর ভালো লাগে সেই বিষয়ে সমর্থন করতে চাই। অতিরিক্ত চাপ দিতে চাই না। একটা ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করব।

নিজের জীবনে এখন সেই ভারসাম্যটা ক্রমশ ‘সেরেনা ভেঞ্চার্সের’ দিকে এগোচ্ছে। আমি এখন একটা স্পঞ্জের মতো। রাতে বিছানায় শুতে চাই এবং নিজেকে নিংড়ে ফেলি, যাতে পরের দিন যত বেশি সম্ভব জিনিস জানতে পারি। রোজ সকালে নীচে নেমে নিজের অফিসে যাওয়ার সময় খুব উত্তেজিত হয়ে থাকি। জুম কলে পরিকল্পনা করি, কোন কোন সংস্থায় বিনিয়োগ করা যেতে পারে।

গত বছর থেকে আমি এবং আলেক্সিস আর একটা সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করছি। সম্প্রতি ডাক্তারের থেকে এমন কিছু জিনিস জানতে পেরেছি, যা শুনে আমার মন শান্ত হয়েছে। বুঝতে পেরেছি, যখনই আমরা তৈরি থাকব তখনই আর একটা সন্তান নিতে পারি। তবে খেলাধুলো করতে করতে আর অন্তঃসত্ত্বা হতে চাই না।

কিছু দিন আগে সাত মাস পর প্রথম বার কোর্টে ফিরলাম। বন্ধু টাইগার উডসের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ওকে বললাম, আমার টেনিস জীবনের ব্যাপারে ওর পরামর্শ চাই। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আমি জানি না এখন কী করব। মনে হচ্ছে আমার জীবন শেষ। কিন্তু এখনো হয়তো আমার মধ্যে টেনিস ফুরিয়ে যায়নি।’ শুধু নামেই টাইগার নয়, উডস নিজেও থাকে বাঘের মতোই। ও চায় আমিও ওর মতো হিংস্র হই। আমাকে বলল, ‘সেরিনা, দু’সপ্তাহ কি তুমি টেনিসকে দিতে পারবে? কারওর কাছে কোনও ব্যাপারে দায়বদ্ধ থাকার দরকার নেই। দু’সপ্তাহ ধরে শুধু কোর্টে গিয়ে নিজের সেরাটা দাও। দেখোই না কী হয়।’ আমি বললাম, ‘ঠিক আছে। সেটা করতেই পারি।’ তবে সত্যিটা হল, আমি সেটা করিনি। এক মাস পর চেষ্টা শুরু করলাম। র‌্যাকেট হাতে নিয়ে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল। খুবই ভাল খেলছিলাম। ভাবছিলাম যে, উইম্বলডন বা ইউএস ওপেনে খেলব কি না। আগেই বলেছি, এই ‘বিবর্তন’ আমার পক্ষে সহজ ছিল না।

উত্তরাধিকার নিয়ে আমার খুব একটা মাথাব্যথা কোনও দিনই নেই। অনেক বার এই প্রশ্নের সামনে পড়তে হয়েছে। কোনও বারই সঠিক জবাব দিতে পারিনি। তবে আমি জানি মেয়ে হিসেবে যে সুযোগ পেয়েছি, সেটা বাকি মহিলারা পেতেই পারে। তারা খেলতে পারে। একই সঙ্গে শক্তিশালী এবং সুন্দর হতে পারে, যা মন চায় তাই পরতে পারে, যা মন চায় তাই বলতে পারে এবং সেটা নিয়ে গর্ব করতে পারে। আমি জীবনে অনেক ভুল করেছি। প্রতিটা ভুলই একটা শিক্ষা ছিল। আমি সেই মুহূর্তগুলোকে মনে রেখেছি। আমি নিখুঁত নই। অনেক সমালোচনা হয়েছে আমায় নিয়ে। অনেক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছি। বছরের পর বছর ধরে মানুষ আমাকে টেনিসের থেকেও বড় কিছু হিসেবে ভেবে এসেছেন। বিলি জিন কিংকে এই কারণেই এত সমীহ করি। উনি খেলাটাকে একটা অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন। আমার শুনতে ভাল লাগবে যদি লোকে বলে, সেরিনা দারুণ টেনিস খেলোয়াড় ছিল। এত গুলো গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছে।

দুর্ভাগ্যবশত এ বছর উইম্বলডন জেতার জন্য তৈরি ছিলাম না। নিউ ইয়র্কেও জিতব কি না জানি না। তবে চেষ্টা করব। জানি সমর্থকরা আমাকে নিয়ে অনেক চর্চা করবেন। ওরা হয়তো ভেবেছিলেন লন্ডনে আমি মার্গারেট কোর্টকে ছুঁয়ে ফেলব এবং নিউ ইয়র্কে ওকে পেরিয়ে যাব। ট্রফি হাতে নিয়ে বলব, ‘আবার দেখা হচ্ছে।’ বাস্তবে আমার কাছে এটা বেশ ভাল স্বপ্ন। তবে আমি কোর্টে শেষ মুহূর্ত কাটানোর অভিজ্ঞতা পেতে চাই না। বিদায় জানানোর ব্যাপারে আমি ভয়ঙ্কর। তবে এটা জেনে রাখুন, শব্দে যা বর্ণনা করি, সমর্থকদের প্রতি তার থেকেও বেশি কৃতজ্ঞ আমি। এত জয় এবং এত ট্রফি ওদের জন্যই সম্ভব হয়েছে। যে ছোট্ট মেয়েটা টেনিস খেলত, তাকে খুব মিস্ করব। আপনাদের সবাইকে খুব মিস্ করব।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement