হতাশ: যথেষ্ট সমর্থন নেই, খেলাই ছেড়ে দিতে চান রাখি। নিজস্ব চিত্র
অলিম্পিক্স-স্বপ্নকে তাড়া করে চলা মেয়েটি হঠাৎ আছড়ে পড়েছে বাস্তবের রুক্ষ্ম জমিতে। সবটুকু নিংড়ে লড়াই করেও হতাশার অন্ধকারে ডুবে গিয়েছে বাংলার এই তরুণী। যন্ত্রণা এতটাই যে, পাটিয়ালা সাইয়ের প্রস্তুতি শিবির ছেড়ে বাড়ি ফিরে আসার কথাও ভাবছেন ভারোত্তোলক রাখি হালদার। এমনকি, অবসরের ভাবনাও তাড়া করছে ২৭ বছরের রাখিকে।
করোনায় ক্রীড়া দুনিয়া স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার আগে টোকিয়ো অলিম্পিক্সের যোগ্যতা অর্জনের লড়াইয়ে ভাল জায়গাতেই ছিলেন রাখি। এখনও আছেন। ভারতীয় ভারোত্তোলন সংস্থার সচিব সহদেব যাদব ফোনে বলছিলেন, ‘‘রাখি অবশ্যই খুব ভাল করছে। আমরা আশাবাদী। ভারত থেকে চার জন অলিম্পিক্সে যেতে পারবে।’’ জাতীয় ভারোত্তোলন কোচ বিজয় শর্মা পাটিয়ালা থেকে ফোনে আনন্দবাজারকে শনিবার বলেন, ‘‘এ বছর অলিম্পিক্স বাতিল হওয়ায় আইওসি নতুন যোগ্যতামান ঠিক করেছে। সেই অনুযায়ী আমাদের হাতে দুটো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা থাকবে। সেখানে ভাল করার জন্য রাখিকে তৈরি হতে হবে।’’
অলিম্পিক্সের সামনে দাঁড়িয়ে কেন এ ভাবে চলে আসতে চাইছেন? পাটিয়ালা থেকে হতাশ গলায় রাখি বলছিলেন, ‘‘আমি উপযুক্ত খাদ্যসামগ্রী কিছুতেই পাচ্ছি না। সাপ্লিমেন্টও নেই। এই অবস্থায় বড় ওজন তোলার জন্য আমার শরীর তৈরি নেই। ভয় পাচ্ছি, বড় কোনও চোট না লেগে যায়। তা হলে জীবনটাও সঙ্কটে পড়ে যেতে পারে।’’
তিনি এখন সাইয়ে অনুশীলন করছেন। সাইয়ের ডায়েট কী রকম? রাখির কথায় জানা যাচ্ছে, দুধ, ডিম, ফল, মুরগির মাংস, বাদাম, ডাল, ভাত— এ সব পাওয়া যায়। কিন্তু সর্বোচ্চ পর্যায়ের ভারোত্তোলনের জন্য বাড়তি অনেক কিছু প্রয়োজন। রাখির কথায়, ‘‘বিদেশ থেকে স্যামন মাছ, পর্ক এবং আরও কিছু খাদ্যসামগ্রী আমাদের দরকার। সঙ্গে বিদেশি সাপ্লিমেন্ট। না হলে পেশির জোরই বাড়বে না।’’
রাখির কথায়, ঠিকঠাক ডায়েটের জন্য মাসে প্রায় ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়। দু’মাসের বিদেশি সাপ্লিমেন্টের দাম লাখ টাকা। রাখির আক্ষেপ, ‘‘২৬-২৭ হাজার টাকা মাইনে পাই। বাবা-মাকে টাকা পাঠাতে হয়। অন্যান্য খরচ আছে। এর পরে কোথা থেকে কী করব!’’
রাখি বলে চলেন, ‘‘কোনও স্পনসর নেই আমার। যার ফলে ভুগতে হচ্ছে। রাজ্য সরকারের থেকে সাহায্য পেয়েছিলাম, যা গত জাতীয় প্রতিযোগিতায় তৈরি হতে কাজে লাগে। এখন আর মাস খানেক দেখব। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে লিখিত চিঠি দিয়ে ভারতীয় শিবির থেকে চলে আসতে হবে।’’ কিন্তু তার মানে তো অলিম্পিক্স স্বপ্ন শেষ? পাঁচ বারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন, কমনওয়েলথ ভারোত্তোলনে পদকজয়ী, গত বছর কাতার কাপে ব্রোঞ্জজয়ী এবং কর্নম মালেশ্বরীর কুড়ি বছরের জাতীয় রেকর্ড ভাঙা রাখি বললেন, ‘‘শুধু অলিম্পিক্স স্বপ্ন কেন, আমার ভারোত্তোলন জীবনই হয়তো শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু এই ডায়েট নিয়ে ১০০, ১২০ কেজি ওজন তোলার চেষ্টা করলে চোট পাওয়ার বিরাট আশঙ্কা। আর ওই ওজন বা তার বেশি না তুললে অলিম্পিক্স যাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই।’’
এ বছরের ক্রীড়া বাজেটে সাইয়ের জন্য অনুদান আগের থেকে প্রায় একশো কোটি টাকা কমেছে। জানা যাচ্ছে, আগে সাইয়ে প্রত্যেক ভারোত্তোলক পিছু রোজ যা খাওয়ার বাজেট ছিল, তা অর্ধেকেরও কম হয়ে গিয়েছে। সহদেব যাদব বলছেন, ‘‘ক্রীড়াবিদদের সমস্যা হলে আমরা সাহায্য করতে তৈরি।’’ জাতীয় কোচের মন্তব্য, ‘‘লকডাউনের আগে সাপ্লিমেন্ট আসত। এখন বন্ধ আছে। আবার ঠিক হয়ে যাবে।’’
রাজ্য সংস্থা কী ভাবছে? রাজ্য ভারোত্তোলন সংস্থার সচিব রঞ্জিত ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘আমরা সব সময়ই খেলোয়াড়দের পাশে থাকার চেষ্টা করি। রাজ্য সরকার, মুখ্যমন্ত্রীর থেকে সব সাহায্য পাই। কিন্তু স্পনসরের অভাব। স্পনসররা এগিয়ে এলে অনেক দূর যাবে বাংলার ভারোত্তোলকরা।’’ সংস্থার প্রেসিডেন্ট চন্দন রায়চৌধুরীর মন্তব্য, ‘‘কেউ সমস্যার কথা জানালে নিশ্চয়ই সমাধানের চেষ্টা করব।’’ পাল্টা প্রশ্ন উঠছে, জানাতে হবে কেন? কর্তারা নিজেরা কেন উদ্যোগী হবেন না?
প্রাক্তন ভারোত্তোলক এবং আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির কোর্স করা কোচ শৈলেন ডাবসি বলছিলেন, ‘‘সাপ্লিমেন্ট ছাড়া একজন ভারোত্তোলক এক পা এগোতে পারবে না। আর সেরা সাপ্লিমেন্ট আসে জার্মানি থেকে। বিশাল খরচ।’’ ভারোত্তোলনের সঙ্গে জড়িত কারও কারও আক্ষেপ, সবাই পদক চায়। কিন্তু পদক জিততে গেলে যে প্রক্রিয়া, যে অর্থ দরকার, সে দিকে কারও নজর নেই। যে কারণেই হারিয়ে যান রাখিরা।