লড়াই: লকডাউনের মধ্যে চলছে রাখির অনুশীলন।
করোনা আক্রমণের ধাক্কায় বেসামাল সব খেলাই। কিন্তু ভারোত্তোলনের মতো এতটা আক্রান্ত সম্ভবত আর কোনও খেলা হয়নি। ভারোত্তোলনে একা, একা ঘরে কোনও রকম অনুশীলন করাটাও মারাত্মক রকমের ঝুঁকির। বিশাল ওজন তুলতে গিয়ে চোট লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা তো থাকেই, বড়সড় বিপদের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যে কারণে প্রায় থমকে গিয়েছে বাংলার ভারোত্তোলন। রাখি হালদারের মতো কয়েক জন এর মধ্যেও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
সমস্যাটা কোথায় বেশি? ভারোত্তোলন ঠিক ভাবে অনুশীলন করতে গেলে এক জন ভারোত্তোলকের সঙ্গে কমপক্ষে আরও চার জনকে দরকার হয়। দু’জন ‘লোডার’, দু’জন ‘ক্যাচার’। যাঁরা বারবেলে ওজন লাগানোর, এবং তোলার সময় ভারোত্তোলককে সাহায্য করবেন। এঁদের ছাড়া একা, একা অনুশীলন করতে যাওয়া মানে চোট লেগে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। পাশাপাশি একটা ক্লাবে যখন ট্রেনিং করানো হয়, তখন ৮-১০ জন ভারোত্তলককে একসঙ্গে নিয়ে অনুশীলন করানো হয়। একটা রডেই হয়তো বেশ কয়েক জন ‘লিফ্ট’ করছেন। সে ক্ষেত্রে সংক্রমণের প্রশ্ন এসে যাচ্ছে। ভারোত্তোলনের সঙ্গে জড়িত অনেকেই বলছেন, একজন ব্যবহার করার পরেই স্যানিটাইজ় করা বারবার সম্ভব নয়।
প্রাক্তন ভারোত্তোলক এবং রাজ্য ভারোত্তোলন সংস্থার সচিব রঞ্জিত ভট্টাচার্য আফসোস করছিলেন, ‘‘এ বার বাংলার খুব ভাল সময় যাচ্ছিল। অলিম্পিক্সে যোগ্যতা অর্জন করার দৌড়ে রাখি হালদার, অচিন্ত শিউলিরা দারুণ জায়গায় ছিল। কিন্তু করোনার আক্রমণে বাংলা ভীষণ ভাবে ধাক্কা খেয়ে গেল।’’
এই মুহূর্তে পাটিয়ালা সাইয়ে আছেন জাতীয় চ্যাম্পিয়ন রাখি। এবং, অত্যন্ত প্রতিকূলতার মধ্যে অলিম্পিক্স স্বপ্নকে তাড়া করে চলেছেন। পাটিয়ালা থেকে ফোনে রাখি বলছিলেন, ‘‘আমরা এখন আস্তে, আস্তে ট্রেনিং শুরু করছি। ওজন তোলা শুরু করেছি। কিন্তু কম ওজন। একা, একা করতে হচ্ছে বলে ঝুঁকি নেওয়া যাচ্ছে না। করোনার জন্য আমরা অনেকটাই পিছিয়ে যাচ্ছি।’’
রাখি তবুও জাতীয় শিবিরে কিছুটা হলেও অনুশীলন করতে পারছেন। বাংলার উঠতি এবং রাজ্য স্তরের ভারোত্তোলকদের ট্রেনিং সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ হয়ে রয়েছে। ভারতকে যুব বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম পদক এনে দিয়েছিলেন বাংলার চন্দ্রিকা তরফদার। কমনওয়েলথ, এশীয় পর্যায়েও পদক আছে তাঁর। সেই চন্দ্রিকা বলছিলেন, ‘‘কোনও রকম অনুশীলন করতে পারছি না। বাড়ি থেকে বেরোনো তো যাচ্ছেই না, তার উপরে ক্লাবগুলোও বন্ধ।’’ চন্দ্রিকার পুরো পরিবারই ভারোত্তোলনের সঙ্গে জড়িয়ে। দিদি যোগমায়াও জাতীয় স্তরে সাফল্য পেয়েছেন। তাঁর ছেলে সায়ন মল্লিক জুনিয়র জাতীয় প্রতিযোগিতা, খেলো ইন্ডিয়ায় অংশ নিয়েছে। যোগমায়া বলছিলেন, ‘‘সব কিছু বন্ধ হয়ে আছে এখন। ছেলে শুধু ফিটনেস ঠিক রাখার চেষ্টা করছে।’’
একই রকম হতাশার সুর শোনা যাচ্ছে বাংলার কোচিং মহলেও। রাখি হালদারের কোচ শিবশঙ্কর মল্লিক বলছিলেন, ‘‘কিছুই করতে পারছি না। ছেলেরা আসতেই পারছে না। এটুকু বলতে পারি, অনেক ক্ষতি হয়ে গেল।’’ বঙ্গ ভারোত্তলনের সঙ্গে বহু বছর ধরে জড়িয়ে আছেন শৈলেন ডাপসি। নিজে ভারোত্তোলক ছিলেন। কোচিং করান। এক সময়ে রাজ্য সংস্থার সচিবও ছিলেন। সেই শৈলেনবাবু বলছিলেন, ‘‘ভারোত্তোলক হল এমন একটা খেলা, যেখানে চোটের আশঙ্কা খুব বেশি থাকে। তাই সব সময় একটা টিম নিয়ে অনুশীলন করতে হয়। না হলে বড় দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থেকেই যায়। তবে বাংলার মতো গোটা দেশই তো ধাক্কা খেয়েছে।’’
ভারোত্তোলকদের অনুশীলনে ‘স্ন্যাচ’ এবং ‘ক্লিন অ্যান্ড জার্ক’— এই দু’ধরনের ‘লিফ্ট’ নিয়মিত অভ্যাস করতে হয়। কোচেদের মতে, ‘স্ন্যাচ’টা সব সময়ই খুব ঝুঁকির। শৈলেনবাবুর মন্তব্য, ‘‘স্ন্যাচটা খুব ঝুঁকির। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওজনটা মাথার উপরে তুলতে হয়। একটু ভুল হলেই চোট লেগে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সে জন্য একজন যখন ওজন তুলছে, তখন বাকিরা কড়া নজর রাখে। একটু সমস্যা দেখলেই এসে সাহায্য করে।’’
পাঁচের দশক থেকে ভারতীয় ভারোত্তোলনে বাংলা দাপট দেখিয়েছিল। অলিম্পিক্সে প্রতিনিধিত্ব করেন অনিল মণ্ডল, কমলাকান্ত সাঁতরা, লক্ষ্মীকান্ত দাস। উঠে এসেছেন জ্যোৎস্না দত্ত, ছায়া আদকরা। প্রচুর অর্জুন পুরস্কারপ্রাপকও আছেন এই রাজ্যে। নতুন প্রতিভারাও উঠে আসছে। আবার কি বাংলা স্বমহিমায় ফিরবে করোনা আতঙ্ক কাটিয়ে? রাজ্য সংস্থার চিফ পেট্রন এবং বেঙ্গল অলিম্পিক সংস্থার প্রেসিডেন্ট অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘আমাদের সঙ্গে ক্রীড়ামন্ত্রী কিরেন রিজিজুর একটা বৈঠক হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছে, জুলাই মাসের শেষে পুরো পরিস্থিতি খতিয়ে দেখা হবে। তার পরে আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারি।’’ করোনার ঝাপ্টা কাটিয়ে নতুন কোন পথে হাঁটে রাজ্যে ভারোত্তোলন, তা দেখার অপেক্ষায় বাংলার ময়দান।