শহরে আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের বৈঠক শেষে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ও রবি শাস্ত্রী। —নিজস্ব চিত্র
মুম্বই ছিল এই মরসুমের সবচেয়ে প্রিয় সন্তান। প্রাথমিক বিপর্যয়ের ঝড়ে বিধ্বস্ত টিমটা প্রায় ডুবতে বসেছিল। সেখান থেকে নিজেদের হাতগুলোকে নৌকোর দাঁড়ের মতো ব্যবহার করে ডাঙায় সাঁতরে উঠেছে। আইপিএলের মঞ্চে এ রকম রূপকথা কেউ কখনও দেখেনি।
আমরা সবাই জানি মুম্বই কী ভাবে ধরাশায়ী হয়ে পড়েছিল। কী ভাবে দর্শক-গর্জনের মধ্যে চেন্নাই, রাজস্থান আর কলকাতা ওদের চারপাশে রোমান যোদ্ধার মতো ঘুরছিল। কী ভাবে মুম্বই নিয়ে জোক তৈরি করে রেডিও জকিরা নিজেদের কেরিয়ার তৈরি করছিল। কিন্তু তার পর ছবিটা পাল্টে গেল। সব বিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দিল মুম্বই। আমাদের বিধ্বস্ত নায়ক ধ্বংসের ছাই থেকে উঠে দাঁড়াল। তার সঙ্গে হাত ধরাধরি করে জয়ের দেবী। আর দু’জনে স্বর্গীয় একটা সূর্যাস্তের দিকে হেঁটে চলে গেল! তফাত বলতে এটা সিনেমা নয়, সত্যি ঘটনা।
এটা নিশ্চয়ই যে কোনও টিমের কাছে সবচেয়ে লম্বা আইপিএল। প্রতি দিন মনে হচ্ছিল, আজই বোধহয় টিম মুম্বইয়ের শেষ দিন। প্রতি রাত ওদের নিশ্চয়ই কেটেছে পরের দিনের চিন্তা করতে করতে। সত্যি সত্যিই প্রায় আঙুলের ডগা দিয়ে আইপিএল খাদ থেকে ঝুলে ছিল মুম্বই। প্রতি সেকেন্ড, প্রতি ইঞ্চির জন্য কী ভাবে লড়াই করে ওরা নিজেদের টেনে তুলল, আমরা কোনও দিন জানতে পারব না। আমরা ফলাফলটা দেখতে পাচ্ছি, তার পেছনের যন্ত্রণাটা নয়। এই জয়টা ওদের নেতৃত্বের প্রতি উৎসর্গ করা উচিত। মাঠে নেতৃত্ব, মাঠের বাইরেও। যে ছেলেরা নিজেদের ক্ষমতার বাইরে গিয়ে দুর্দান্ত খেলেছে, তাদের স্যালুট করা উচিত। কে বলেছে কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে সাহস লাগে না?
আইপিএল যদি একটা মহাভোজ হয় আর মুম্বই ইন্ডিয়ান্স সেখানে একটা বিশাল কেক, তা হলে ভোজে কয়েকটা আধ-সেদ্ধ খাবারের হাঁড়িও ছিল। যেগুলো আমাদের কোনও স্বাদের সন্ধান দিতে পারেনি। যুবরাজ সিংহ, মিচেল জনসন, স্টিভ স্মিথ, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল— কেউ দারুণ কিছু দিতে পারল না। কয়েক জন নিয়মিত ভারতীয় প্লেয়ারকে মনে হল ঝাঁঝ ছাড়া পানীয়। কয়েকটা হজমি গুলির বেশ কিছু উপকরণ নিখোঁজ ছিল। প্রায় সব বছরের মতো এ বারও দিল্লি সবার কাছে উপেক্ষিত হয়ে ঘরের একটা কোনায় দাঁড়িয়ে থাকল। এ বার অবশ্য ওদের সঙ্গ দেওয়ার কাজটা করল কিংগস ইলেভেন পঞ্জাব।
পরীক্ষানিরীক্ষার অনেক মরসুম পেরনো আন্দ্রে রাসেল এখন দুর্দান্ত স্বাদের পুডিংয়ে পরিণত হয়েছে। সরফরাজ আর হার্দিকের মতো কয়েক জন নতুন মুখ পরের বার ওদের দোকানের সামনে অনেক বেশি ক্রেতা পাবে। সন্দীপ শর্মার একটা টকমিষ্টি ব্যাপার আছে, যেটা অনেকক্ষণ জিভে থেকে যায়। নমন ওঝা একজন ডিজে যে এখন কিপিং গ্লাভস পরে বেশি স্বচ্ছন্দ!
টেকনিক আর স্ট্র্যাটেজির বিচারে কি এ বার আমরা নতুন কিছু দেখতে পেলাম? ব্যাটসম্যানদের দিক থেকে দেখলে ষষ্ঠ স্টাম্পের কাছাকাছির বলে পড়তে পড়তেও সুইপ করে ফাইন লেগের ওপর দিয়ে ছয় মারাটা সত্যিই ঔদ্ধত্যের প্রকাশ। ঠিকঠাক ব্যাটিং স্টান্স নিয়ে স্লিপের ওপর দিয়ে সরফরাজের ছোট একটা স্কুপ দেখে তো স্বয়ং এবি ডে’ভিলিয়ার্স মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। বোলাররাও এখন ব্যাট থেকে দূরে আইনি ডেলিভারি করার ব্যাপারে অনেক উন্নত। ফিল্ডিং তো অসাধারণ হয়েছে। কয়েকটা ক্যাচ যেমন মাধ্যাকর্ষণকে হারিয়ে দিয়েছে। দশ-দশ বার যেগুলোর হাইলাইটস দেখার পরেও মনে হয় হৃদপিণ্ড বুঝি মুখে চলে এল।
আইপিএল এখন তার নিন্দুকদের ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছে। এখন এটা একটা নিমন্ত্রণ, যার জন্য সবাই অপেক্ষা করে থাকে। আইপিএল ছাড়া আমাদের গ্রীষ্মের কোনও মানেই থাকে না।