শনিবার রাতে ইডেন ছেড়ে বেরনোর সময় অত আনন্দের মধ্যেও একটা কাঁটা কোথাও যেন খচখচ করছিল। ভারত এত ভাল খেলল। পাকিস্তানকে দাঁড়াতেই দিল না। বিরাট কোহালির দুর্দান্ত একটা ইনিংস দেখা গেল। আবার একই সঙ্গে অমিতাভ বচ্চন থেকে সচিন তেন্ডুলকর— সবাইকে দেখে নিল ইডেন, একজন ভারতবাসীর কাছে এর চেয়ে বেশি আর কী চাওয়ার থাকতে পারে? কিন্তু বিরাটদের জয় ভারতীয় হিসেবে আমাকে আনন্দ দিলেও, পুরোপুরি খুশি হতে পারছি না। বরং গত রাত থেকে একটা প্রশ্ন ক্রমাগত আমাকে তাড়া করছে।
ইডেনে ভারত জিতল। কিন্তু ক্রিকেট জিতল কি?
শনিবার ইডেন পিচের কথা বলতে চাইছি। একটা টি-টোয়েন্টি ম্যাচে লোকে কী দেখতে আসে? এক কথায়, বিনোদন। বড় রান দেখতে চায়, যে কারণে দরকার একটা ভাল পিচ। সেখানে শনিবারের ইডেন উইকেট দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছি। বল কি না প্রথম ইনিংস থেকে একহাত করে ঘুরছে! ব্যাটসম্যান কাট মারতে গিয়ে দেখছে যে, বল তার গায়ে আছড়ে পড়ছে!
পরিষ্কার বলছি, আমি এখানে কারও সমালোচনা করতে বসিনি। সিএবি আমার নিজের সংস্থা। নিজে এখানে খেলেছি। কিন্তু একটা কথা ভেবে দেখুন, গত কাল ভারত হেরে গেলে কী হত? লোকে তো তখন ছিঁড়ে ফেলত এই ইডেন পিচকে। ইডেন উইকেট যে আগে দুর্দান্ত ছিল এখন জঘন্য, বলছি না। আমি জানি যে ইডেনের পক্ষে কোনও দিন ওয়াংখেড়ে হওয়া সম্ভব নয়। ইডেনের উইকেট বরাবরের স্লো। এখানে কখনও একটা টিমের পক্ষে ২৩০ তাড়া করে জিতে চলে যাওয়া সম্ভব নয়। যেটা ক’দিন আগে ওয়াংখেড়েতে দক্ষিণ আফ্রিকা-ইংল্যান্ড ম্যাচে হয়েছে। কিন্তু ইডেন উইকেট এতটাও খারাপ নয় যে শট খেলা যাবে না। এমন নয় যে, ড্রাইভ মারলে সেটা কভার বা একস্ট্রা কভারের হাতে চলে যাবে। দু’শো না হোক, অন্তত ১৬০-১৭০ রানের উইকেট তো একটা টি-টোয়েন্টি ম্যাচে দেবে ইডেন? এত বড় বড় তারকাদের আনা হল ম্যাচে। ষাট হাজার লোক একসঙ্গে সারাক্ষণ শনিবার চেঁচিয়ে গেল। কিন্তু এ সবে কী লাভ যদি ভাল ক্রিকেটই না দেখা যায়? পাকিস্তানের তো ১১৮ তুলতে কালঘাম ছুটে গেল! পরে ধোনিকে বলতে শুনলাম যে, ও ধারণা করতে পারেনি উইকেটে এতটা টার্ন থাকবে। ঠিকই তো বলেছে ধোনি। এক মিটার করে বল গত কাল টার্ন করেছে। আমি তো বলব, ই়ডেনের ভাগ্য ভাল যে বিরাট কোহালি ও রকম একটা ইনিংস খেলে দিয়েছে। ও শুধু দেশকে জেতায়নি, ইডেনকেও বিরাট লজ্জা থেকে বাঁচিয়ে দিয়ে গিয়েছে।
আর এটা আজকের নয়, বহু দিনের রোগ। আজ পর্যন্ত কাউকে দেখিনি ইডেনের উইকেট নিয়ে ভাবতে। ’৯৬ বিশ্বকাপ মনে করে দেখুন। উইকেটে তখন আবার ম্যারাপ বেঁধে রাখা হয়েছিল। ম্যাচের আগে দেখেছিলাম উইকেটটা কী রকম ধূসর হয়ে রয়েছে। তখনই মনে হয়েছিল ভারত পরে ব্যাট করলে ভোগান্তি আছে। সে দিন সচিন ছাড়া কেউ লড়তেই পারেনি শেষ পর্যন্ত। ভারত পরেই ব্যাট করেছিল, আর শ্রীলঙ্কা স্পিনার আনতেই সব শেষ। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এটা বছরের পর বছর চলবে কেন? কেন উইকেটের দিকে নজর দেওয়া হবে না? কেন প্রফেশনাল কাউকে আনা হবে না কিউরেটরের দায়িত্ব দিয়ে? পিচ তৈরি করাটা সহজ নয়, এটাও বিজ্ঞান। কিন্তু ঠিকঠাক জানলে রকেট সায়েন্সও নয়।
খারাপ লাগে দেখলে যে, সেই ভাবনাটাই কেউ কোনও দিন ভাবল না। আউটফিল্ডকে দুর্দান্ত করে তোলা হল, কিন্তু পিচ আগে যা ছিল, আজও তাই। আরও শুনলাম, ম্যাচের আগের দিন নাকি পিচে জল দেওয়া হয়েছিল। মানে? যেখানে তুমি দেখছ যে পূর্বাভাসে বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানে পিচে জল দেওয়ার অর্থ কী? আরও একটা জিনিস বুঝে পেলাম না। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ মানছি ধর্মশালা থেকে ঘুরে এসেছে। কিন্তু সিএবি তো জানত যে, ইডেনে বিশ্বকাপের ম্যাচ হবে। স্থানীয় ক্রিকেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এত দিন সময় পাওয়া গিয়েছিল পিচ তৈরির। তার পরে এই হাল হবে কেন? আমার বক্তব্য খুব পরিষ্কার। ক্রিকেটটা বাইশ জনের খেলা। বাইশ জনকেই খেলতে দাও। ওটাকে একজনের বানিয়ে ফেলো না। বিরাট কোহালি গত রাতের ম্যাচটা নিজের জিনিয়াসে বার করেছে। বাকিদের পক্ষে ওটা সম্ভব হবে না। গাওস্কর-সচিন-বিরাট এরা প্রত্যেকে জিনিয়াস। খারাপ পিচেও এরা ঠিক ম্যাচ বার করে ফেলতে পারবে। কিন্তু বাকিরা? তারা যখন দেখবে অফস্টাম্পে পড়ে বল টার্ন করে লেগস্টাম্পের দিকে চলে গেল, বুঝতেই তো পারবে না খেলবে কী ভাবে? ভারতীয় ক্রিকেটের এখন একটা ট্রেন্ড দেখছি যে ঘূর্ণি বানিয়ে বিপক্ষকে ওড়াচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা, সবার একই অবস্থা হয়েছে। কিন্তু কোনও আইসিসি টুর্নামেন্টে এটা চলতে পারে না। ইডেনে ম্যাচ রেফারি ক্রিস ব্রড ছিলেন। তাঁকেও ইডেন পিচ নিয়ে রিপোর্ট পাঠাতে হবে আইসিসিকে। একটা খারাপ কিছু যদি তার পর হয়ে যায়, কার অপমান হবে? মুখ কার পুড়বে?
আগেই বলেছি, আমি এখানে কারও সমালোচনা করতে বসিনি। সিএবির নয়, কারও নয়। কিন্তু হ্যাঁ, আমি সতর্ক করে দিতে চাই। বলতে চাই যে, এ বার অন্তত একটা ভাল পিচ বানানোর দিকে মন দিক ইডেন। পেশাদার কাউকে এনে। অভিজ্ঞ কারও হাতে দায়িত্ব ছেড়ে। একটা ভাল ক্রিকেট ম্যাচ দেখার অধিকার কিন্তু আমাদের সবার আছে।