একান্ত আলোচনা সৌরভ-কোহালির।
শীতের ইডেনে শনিবার সকালে এলে নির্ঘাৎ চোখে পড়ত তরুণীকে! অবাঙালি। অফিস ছিল, কিন্তু যাননি। সব ফেলে ছুটে এসেছেন স্বপ্নের মহানায়ককে একবার দেখবেন বলে। আশ্চর্যের হল, এত কিছুর পরেও তিনি কাঁদছেন। অঝোরে। অবিরাম।
কেন? না, মহেন্দ্র সিংহ ধোনি তাঁর দিকে তাকিয়ে হাত নেড়েছেন! সমুদ্রসম আবেগ এর পর বন্দি থাকে কী করে?
শীতের শনিবাসরীয় সন্ধেয় যদি ভারতীয় টিম হোটেলে উপস্থিত থাকলে নির্ঘাৎ স্যুট পরা ভদ্রলোককেও চোখে পড়ত। ভারতীয় ক্রিকেটের এক সময়ের দুর্ধর্ষ ওপেনার তো বটেই, নৃশংসতায় সম্ভবত অবিসংবাদী শ্রেষ্ঠ। কিশোরকুমারের গান গাইতে-গাইতে বোলারকে মাঠের বাইরে তাঁর ছুড়ে ফেলাটা তো লোকগাথা। কিন্তু তার পরেও পাশে বসা ছেলেটার জন্য কিশোরের একটা গানও ভেবে উঠতে পারছেন না বীরেন্দ্র সহবাগ। কিশোরের যে কোনও একটা গান দিয়ে বিরাট কোহালিকে ধরা তাঁর পক্ষে নাকি সম্ভব নয়। অন্তত চার-পাঁচটা নিয়ে বসতে হবে!
গান দিয়ে হয়নি। কিন্তু উপমা? সহবাগকে সেখানে আটকাবে কে? কোহালি নিয়ে যা বললেন সহবাগ, তাঁর টুইটের মতোই ভাইরাল হয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। গান-টান নয়, কোহালি সহবাগের কাছে ভারতীয় ক্রিকেটের কিশোরকুমার!
এক-এক সময় ধন্ধ লাগতে পারে। গোটা দিন মাঠ ও মাঠের বাইরের ভারতীয় সংসারকে দেখলে যা আশ্চর্য নয়। শনিবাসরীয় শহরে আবেগের মুখ হিসেবে কাকে এগিয়ে রাখা যায়? প্রাক্তন ভারত অধিনায়ককে? না কি বর্তমান ক্যাপ্টেনকে? কাকে পরিয়ে দেওয়া যায় আবেগ-যুদ্ধ জয়ীর তাজ? মাঠের ধোনিকে, নাকি মাঠের বাইরের কোহালিকে?
মীমাংসা পাঠকের আদালতে ঠেলে দেওয়া ভাল। তুলে ধরা ভাল বরং দুই মহাতারকার পূর্ণাঙ্গ ছবিটা। যা এক আপাত-নিষ্প্রাণ ক্রিকেট-যুদ্ধের ক্যানভাসেও আবেগের রং-তুলি হাজির করে চলে গেল। শুরুতে যা লেখা হয়েছে, মুখবন্ধ মাত্র। পরিপূর্ণ কাহিনি অনেক বেশি মোহিনী, অনেক বেশি রোমাঞ্চকর।
‘বীরু’ বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানে সৌরভ-কোহালির সঙ্গে বীরু সহবাগ। টিম হোটেলে শনিবার।
দিনের ধোনি ছিলেন একমুখী আবেগ। অপশনাল প্র্যাকটিসে বিরাট, যুবরাজ কেউ আসেননি। ধোনিকেও কারও সঙ্গে তাই আবেগের সিংহাসন ভাগাভাগি করে নিতে হয়নি। সন্ধের কোহালিকে কিন্তু সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়তে হয়। টিম হোটেলের অনুষ্ঠানে তাঁর পাশে যে দুই বসে থাকলেন, তাঁদের নাম সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এবং বীরেন্দ্র সহবাগ। তাঁরাও ভারতীয় ক্রিকেটের সমান দাপুটে মহারথী।
অনুষ্ঠানটা আদতে চিত্রসাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায়ের সহবাগের উপর বই-প্রকাশের। বইয়ের নাম ‘বীরু’। যেখানে চ্যাট শো-র শুরু কোহালি ও কিশোর দিয়ে। সহবাগকে জিজ্ঞেস করা হল, ব্যাট করার সময় কিশোরের গান গাইতেন। কোহালিকে কিশোরের একটা গান দিয়ে ধরুন। সহবাগ বলে দেন, ‘‘একটা গান দিয়ে ওর মতো প্রতিভাকে বোঝানো সম্ভব নয়। তবে এটা বলতে পারি, কোহালিই ভারতীয় ক্রিকেটের কিশোরকুমার!’’
হোটেল ব্যাঙ্কোয়েটে শব্দব্রহ্ম যার পর স্রেফ দানবীয় হয়ে দাঁড়াল। এর পর বীরু-সৌরভ কথোপকথনও যথেষ্ট আকর্ষণীয়। সহবাগ নাটকীয় ভাবেই বলে চলেছিলেন যে, প্রথম অস্ট্রেলিয়া সফরে ব্যাট করার সময় ‘আ দেখে জরা, কিসমে কিতনা হ্যায় দম’ গাইতে গাইতে বোলার-নিধন যজ্ঞে নামতেন! তা, দশে গায়ক বীরুকে কত দেবেন সৌরভ, সঞ্চালক জিজ্ঞেস করায় উত্তর এল, ‘‘জিরো!’’ ব্যাটিংয়ে দশে নয়, টুইটে দশে দশ, কিন্তু গানে দশে শূন্য!
‘‘এক-এক সময় রাগই হত বীরুর গান গাওয়া দেখে। লর্ডসে ৩২৫ তাড়া করতে আমি আর ও নেমেছি। দেখলাম গান গাইছে,’’ ছদ্ম রাগে বলে চলেন সৌরভ। মুহূর্তে সহবাগের পাল্টা, ‘‘দাদা, আমরা দিল্লিওয়ালারা রান তাড়া নিয়ে টেনশন করি না। দশ ওভারের ম্যাচে দিল্লিতে একশো তাড়া করি!’’ সৌরভ এর পর লর্ডস ফাইনালে বীরুর রান তাড়ার নমুনাটা পেশ করলেন। রনি ইরানিকে দেখে কী ভাবে ‘‘হ্যাঁ দাদা, ধরে খেলছি’’ বলে-টলেও সহবাগ কোন আক্রোশে পরপর চারটে চার মেরেছিলেন, তার নমুনা। চতুর্দিকের অট্টহাস্যের মধ্যে সৌরভ বলেন, ‘‘চার নম্বর বাউন্ডারি মারার পর ওকে গিয়ে বললাম, তোর যা ইচ্ছে হয় কর। বুঝতেই পারছি আমি তোর ক্যাপ্টেন নই।’’
কোহালিকে এ সবের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। দর্শক-আগ্রহ নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত পেরেছেন কোহালি। পেরেছেন, ঝাঁঝালো জবাবে উপস্থিতদের বিস্মিত করতে। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, সাফল্যের শিখরে থেকে কোনও ভয়, উদ্বেগ তাঁর মধ্যে কাজ করে? কোহালির সপাট ড্রাইভ, ‘‘একদমই না। আমি শুধু জীবনকে উপভোগ করি, জীবন থেকে পুরোটা নিই। কোনও আফশোস নেই। খেলা ছেড়ে দেব যে দিন, সে দিনও থাকবে না।’’ কোহালিকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়, তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাতের দিনটার কথা। বাড়িতে প্রয়াত বাবাকে রেখে যে দিন রঞ্জি ম্যাচে তাঁকে মাঠে ফিরতে হয়েছিল। কতটা কঠিন ছিল? ‘‘খুব সম্ভবত কঠিনতম দিন। কিন্তু কিছু ঘটে গেলে তাকে তো আর বদলানো যায় না। আর ম্যাচ অর্ধেক রেখে আসাটা আমার কাছে অপরাধ। আমার কোনও ডিগ্রি নেই। শুধু ক্রিকেটটাই খেলতে পারি। ক্রিকেটের কাছে আমি দায়বদ্ধ।’’
আজ ইডেনে ইংল্যান্ড সিরিজের শেষ ম্যাচ। শনিবারের প্র্যাকটিসে ধোনি।
এক কথায়, অবিশ্বাস্য। ধোনি—তিনিও রং ছড়ালেন, রাঙিয়ে গেলেন ক্রিকেট-মাঠ। প্রাক্তন বঙ্গ পেসার শিবশঙ্কর পাল এ দিন ইডেনে এসেছিলেন, ধোনির সঙ্গে আড্ডা দিতে। কিন্তু সেই আড্ডা যে ক্রমশ অতীতের সরণি ধরে মাসাইমারার জঙ্গলে শেষ হবে, কে জানত!
বহু বছর আগে ভারত ‘এ’-র হয়ে খেলতে কেনিয়ায় গিয়েছিলেন দু’জন। সেখান থেকেই মাসাইমারা। বহু বছর পর দুই বন্ধুর কথোপকথনে নাকি সেই অভিজ্ঞতা নির্ভুল ফিরে এসেছে। জঙ্গলে রাত্রিবাস, সতীর্থদের ভয় দেখানো— বাদ যায়নি কিছু। শুধু তাই? এক সময় দলীপ ট্রফির রুমমেট শিবকে শোনা গেল ধোনি জিজ্ঞেস করেছেন, ‘‘ক্লাব ক্রিকেট ছেড়ে দিয়েছিস?’’ দিয়েছেন শুনে আবার জিজ্ঞেস করেন, ‘‘কী করিস এখন? কোচিং?’’ আড্ডার শেষ পর্বটুকুও মুগ্ধ করার মতো। আবেগতাড়িত বঙ্গ পেসার ধোনিকে বলে দেন, এত দিন তুই সানগ্লাস উপহার দিতি আমাকে। অনেক দিন বাদে বড় সেঞ্চুরি করলি। আজ আমি দিই, নিবি?
পরে ড্রেসিংরুমের বাইরে অভিভূত দেখায় শিবকে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো বলতে থাকেন, ‘‘চুলের স্টাইল ছাড়া কিছুই পাল্টাল না ওর।’’ ধোনি তখন পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। শ’তিনেকের তীব্র হর্ষধ্বনির মধ্যে দিয়ে, এক অমোঘ বার্তা ছেড়ে।
আজ, রবিবার আবেগের শহর কোহালির দিকে অবশ্যই থাকবে। ওয়ান ডে ক্যাপ্টেন হিসেবে প্রথম ইডেনে নামবেন বিরাট, থাকবে তো বটেই। কিন্তু মাহি-মাহাত্ম্যকেও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া বোধহয় যাবে না!
ছবি: উৎপল সরকার